ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জন্মাষ্টমী

ন্যায়ের পথে অটল থাকার শিক্ষা

ন্যায়ের পথে অটল থাকার শিক্ষা

গোপাল অধিকারী

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন শুভ জন্মাষ্টমী। সংস্কৃতে ‘কৃষ্ণ’ শব্দের অর্থ ‘কালো’। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে কৃষ্ণকে নীল মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুসারে দ্বাপর যুগের শেষভাগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মথুরায় কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণের এই জন্মতিথি ঘিরে উৎসবের আয়োজন করা হয়।
ইতিহাসবিদদের বিবেচনায় ১০০০-৯০০ খ্রিষ্টপূর্বে সনাতম ধর্মের প্রাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর জন্মের সময় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পাপ ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ ছিল। তাই মানব জাতিকে রক্ষার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মানব জাতির কাছে জীবনধারণের অনন্য উদাহরণ রেখে গেছেন।
হিন্দু পঞ্জিকামতে, ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার হয়ে শ্রীকৃষ্ণ এই দিন জন্ম নিয়েছিলেন মা দেবকীর গর্ভে। ছোটবেলায় তাঁকে সবাই আদর করে গোপাল বলে ডাকত। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে এই দিন শ্রীকৃষ্ণ বা গোপালপূজার আয়োজন করা হয়। তিনি গোবর্ধন পর্বতকে এক আঙুলে তুলেছিলেন বলে তাঁর আরেক নাম গোবর্ধন। কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীকে কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী এবং শ্রীজয়ন্তীও বলা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে, কৃষ্ণ ছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর। দুষ্টের দমন করে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন।

দ্বাপরের যুগসন্ধিক্ষণে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে জন্ম নেন সনাতন ধর্মের মহাবতার শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করেই জন্মাষ্টমী উৎসব উদযাপিত হয়। দ্বাপর যুগে অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে। ধার্মিকরা অসহায় হয়ে পড়েন। বসুমতী পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা মিলে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে সবাই মিলে বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরণীর দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তাদের অভয়বাণী শোনান এই বলে– অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ।

ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দেন ধরাধামে তাঁর লীলার সহচর হওয়ার জন্য। বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা তাদের নিজ নিজ পত্নীসহ ভগবানের কাঙ্ক্ষিত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলে বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নেন। এভাবে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতাদের মর্ত্যলোকে অবতরণ। গীতায় স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্ত্রা স্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তি) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।’
পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দরকে দমন করে মানব জাতিকে রক্ষা এবং শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবতগীতার শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে বিশৃঙ্খল ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীতে মানবপ্রেমের অমিত বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ অবতারেরও দুটি উদ্দেশ্যের দুটি দিক হলো– অন্তর্জগতে মানবাত্মার উন্নতি সাধন ও বাহ্যজগতে মানবসমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন। পুরাণে একে ধরাভারহরণ, অসুর নিধনাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে।

বেদে বলা আছে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার, জ্যোতির্ময়, সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বশক্তিমান। বেদজ্ঞ জ্ঞানী ঋষিরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের উপলব্ধি খুবই কঠিন কাজ। মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত; আমরা তাঁকেই ভগবান বা ঈশ্বর নামে ডেকে থাকি। কেবল সনাতনীকল্প মনীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শতনামে সম্ভাষিত। ভক্তরা তাঁকে যে নামে ডাকেন, তিনি সে নামে সাড়া দেন। যেভাবে তাঁকে পেতে চান সেভাবেই তিনি ধরা দেন। তাই তো তিনি দেবকী ও বসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাকক্ষে তাদের সামনে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণ নামে। তাঁর জন্মলীলাই জন্মাষ্টমী নামে অভিহিত ও স্মরণীয়।

আমরা যে ধর্মের কথাই বলি না কেন, সারকথা একই। অন্যায়ের সঙ্গে আদিকাল থেকেই ন্যায়ের যুদ্ধ চলে আসছে। অন্যায় যে কোনোদিন টিকতে পারেনি– ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে। শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিত আমাদের এই শিক্ষা দেয়– সবসময় ন্যায়ের পথে চলতে হবে। তুমি নিষ্কাম হও এবং কাজ করে যাও। ফলের আশা করো না– কৃষ্ণ এবং অর্জুনের এই মিথলজিক্যাল সংলাপটি যোগাযোগবিদ্যার জায়গা থেকে ভীষণ শক্তিশালী একটি উক্তি। সনাতন ধর্মমতে, অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশ এবং ধর্ম ও সুজনের রক্ষায় কৃষ্ণ যুগে যুগে পৃথিবীতে আসেন। অপশক্তির হাত থেকে শুভশক্তিকে রক্ষার জন্য শ্রীকৃষ্ণ মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসকে হত্যা করে শান্তি স্থাপন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের ভাব ও দর্শন যুগ যুগ ধরে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। কৃষ্ণের প্রেমিকরূপের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বৃন্দাবন লীলায়, যা বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল প্রেরণা। জন্মাষ্টমী ন্যায়ের পথে অটল থাকার শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় শিক্ষা যদি আমরা গ্রহণ করি, তবে অবক্ষয় কমবে; জাগ্রত হবে সচেতনতাবোধ। সমাজ হবে সুস্থ ও সুন্দর।

গোপাল অধিকারী: প্রাবন্ধিক
[email protected]


আরও পড়ুন

×