শিক্ষক দিবস
শিক্ষকতা পেশার উন্নয়নে আন্তর্জাতিক প্রয়াস

কাজী ফারুক আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ | ২০:২৮ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ | ২০:২৮
শিক্ষার জন্য কাঙ্ক্ষিত শিক্ষকের স্বল্পতা নিরসনে বৈশ্বিক করণীয়– এ প্রতিপাদ্যে আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপিত হচ্ছে। তবে ভারতে এক মাস আগেই প্রয়াত রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনে দিনটি পালিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এবার প্রথম শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দিবসটি পালনের সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং শিক্ষকদের প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সচেতনতা তৈরিতে প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অংশীজনের অংশগ্রহণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে র্যালি/আলোচনা সভা/সেমিনারের আয়োজন করছে। ব্লাস্ট সচিবালয়ের সহায়তায় শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিরসনে গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে দিবসটি উপলক্ষে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং অভিভাবকদের সহায়তায় শিক্ষকরা কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নিপীড়ন ও শাস্তি বন্ধ করবেন– সে বিষয়ে শিক্ষক-অভিভাবক-বিশিষ্টজন মত ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন আজ নানা কর্মসূচি পালন করবে।
শিক্ষকদের উদ্দেশে নিবেদিত ঐতিহাসিক দিনটি এবার বেশি তাৎপর্যমণ্ডিত হয়েছে আন্তর্জাতিক একটি উদ্যোগের ধারাবাহিক কার্যক্রমের ফলে। গত বছর জাতিসংঘের উদ্যোগে শিক্ষার রূপান্তর নিয়ে যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তার পর্যায়ক্রমিকতায় শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা উন্নয়নে প্রতিবন্ধকগুলো চিহ্নিতকরণ ও প্রতিকারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বিশ্বব্যাপী শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি বেশি করে আকৃষ্ট হয়েছে। শিক্ষা মানবতার উন্নয়ন সূচিত করে; শিক্ষকতা পেশা মানবতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত মানুষদের ন্যায়সংগত অধিকার ও মানবিক প্রত্যাশা যথাযথভাবে মূল্যায়িত না হওয়ায় এ পেশার প্রতি নতুনদের অনীহা এবং কর্মরতদের পেশা ত্যাগের ঘটনা বৈশ্বিক সংকটের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
উল্লেখ্য, শিক্ষার রূপান্তরে ২০২২ সালে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে সম্ভাব্য ও বিরাজিত প্রতিবন্ধকগুলো চিহ্নিতকালে দেখা যায়, শিক্ষকতা পেশায় নানামুখী সংকট। কর্মরত শিক্ষকের পেশাগত হতাশা ও নতুনদের পেশার প্রতি বিরূপ মনোভাব অব্যাহত থাকলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর কীভাবে সম্ভব হবে? এ জিজ্ঞাসার সদুত্তর পেতে বিশ্বব্যাপী শিক্ষকস্বল্পতার কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকারে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ১৮ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের এক প্যানেল গঠন করেন। এ সময় শতাধিক দেশের পক্ষ থেকে শিক্ষকতা পেশার অগ্রবর্তিতা নিশ্চিতকরণ, শিক্ষায় অর্থায়ন এবং ডিজিটাল শিক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মহাসচিব ঘোষিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এমনভাবে সুপারিশমালা তৈরি করার কথা, যার ফলে প্রত্যেক শিক্ষার্থী দক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন এবং সুসমর্থিত শিক্ষকের পাঠ গ্রহণ করতে পারবে। এর দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত রূপান্তর সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সুপারিশগুলো ২০২৩-এর মধ্যে চূড়ান্ত হওয়ার পর জাতিসংঘের পরবর্তী শীর্ষ বৈঠকে ২০২৪ সালে তা উপস্থাপিত হবে। উল্লেখ্য, এ প্যানেল দু’জন রাষ্ট্রপ্রধানকে কো-চেয়ারম্যান করে গঠিত এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষক, শিক্ষক সংগঠন, সিভিল সোসাইটি এবং যুবসমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত।
শিক্ষা কীভাবে মানবতার উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটায়; শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত মানুষ কীভাবে শ্রম, ত্যাগ স্বীকার ও মেধা দিয়ে মানবতা সৃজনে ভূমিকা পালন করলেও যুগের পর যুগ প্রাপ্য মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, তা তুলে ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্ববিবেকবোধ আজ শিক্ষকতা পেশার প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতে এবং শিক্ষকতা পেশাকে সামাজিক প্রগতির ধারক-বাহক হিসেবে নতুনভাবে আবিষ্কারে সচেষ্ট। তারই প্রতিফলন ঘটেছে জাতিসংঘ মহাসচিব গঠিত উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের অন্যতম সদস্য, নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাওয়ার্ড স্টিভেনসনের বক্তব্যে: “১৯৬৮ সালে মেমফিসে ধর্মঘটি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের উদ্দেশে মার্টিন লুথার কিং যা বলেছিলেন, তা আজ বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের কাছে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে: ‘আপনারা যে যেখানেই কাজ করেন তা মানবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত, মানবতার সৃজনে সহায়ক এবং মর্যাদাকর।’ বিশ্বব্যাপী যখন শিক্ষকের স্বল্পতাজনিত সংকট তীব্র তখন অনেক দেশেই শিক্ষকরা তাদের পেশাগত মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন নন।”
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ১০ লক্ষাধিক শিক্ষকের জীবনে এই বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবস কী বার্তা বহন করছে? শতাব্দীকাল ধরে চলে আসা বঞ্চনা ও অমর্যাদার অবসান, শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদাপ্রাপ্তি কতটা নিশ্চিত হয়েছে? তাদের মতামত কতটা আনুকূল্য ও গুরুত্ব পাচ্ছে? তারা কি শিক্ষার ভিত্তিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছেন? ইউনেস্কো-আইএলও প্রণীত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালে শিক্ষকদের করণীয়, মর্যাদা সুরক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশমালা স্মরণীয় করার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে দেশে দেশে উদযাপিত বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এসবের সদুত্তর পাওয়া বড় বেশি দরকার।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ: ’৬২ শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য