স্মরণ
মানব ধর্মের রূপকার

রেজাউল করিম
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০
মানুষের আসল পরিচয়- সে মানুষ। প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রভাবে মানুষ তা ভুলে গিয়ে হচ্ছে হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান। ফলে মানুষ ধর্ম ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। একজনের সঙ্গে অন্যজনের দেখা হলে জানতে চায়- সে হিন্দু, না মুসলমান; বৌদ্ধ, না খ্রিষ্টান। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে, এক ধর্ম অন্য ধর্মকে সহ্য করতে পারে না। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঈর্ষা, রেষারেষি বেড়েই চলেছে। সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ দখল হচ্ছে- এমনকি দেশছাড়াও করা হচ্ছে। এক সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভিন্নমতকে সহ্য করা হচ্ছে না। সমাজে মনুষ্যত্ব ও মানবিক বোধ লোপ পাচ্ছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? মুক্তির উপায় হচ্ছে একটা মানবতাবাদ বা মানব ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা, যার ভিত্তি হবে যুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ, দার্শনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টি। মানুষের পরিচয় হবে মানুষ হিসেবে। মনুষ্যত্ব অর্জনই হবে মানুষের মূল লক্ষ্য।
মানব ধর্মের রূপকার, প্রবর্তক ও অবতার হলেন লালন ফকির। প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি তার কোনো আস্থা ছিল না। লালন প্রচলিত ধর্মের বিলুপ্তি কামনা করে মানব ধর্মের প্রত্যাশা করে বলেন, 'এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান/ জাতি গোত্র নাহি রবে।' লালনের কাছে মানুষই মুখ্য, মানুষই সব কিছু। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। মানুষের মাধ্যমেই মিলবে মানুষের মুক্তি। তাই তো তিনি বলেছেন, 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ মানুষ ছাড়া খেপা রে তুই মূল হারাবি'
লালন বিশ্বাস করতেন, মানুষের মুক্তি মানুষের মাধ্যমেই। এ জন্য তিনি মানুষ ভজনের কথা বলেছেন; গুরু তথা জ্ঞানীর কাছে দীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন। দেহ ছাড়া পরমের অস্তিত্ব নেই। মানবদেহেই সে পরম বিরাজ করে। আর গুরুই দিতে পারে সে পরমের সন্ধান। লালনের ভাষায়, 'ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/ সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার'
লালন নিজেকে মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। নিজে যেখানে প্রচলিত জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ মানেননি, সেখানে এক দল গবেষক তাকে হিন্দ; আরেক দল গবেষক তাকে মুসলমান বানাতে উঠেপড়ে লেগেছেন, যা দুঃখজনক। মানুষ কোনো ধর্ম নিয়ে জন্মায় না। ধর্ম তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আবার মানুষ যখন মারা যায় তখনও তার ধর্ম থাকে না। মৃতদেহ মানুষ নয়, সেটি হলো লাশ। লাশের আবার ধর্ম কী? তাই তো লালন বলেন, 'জাত গেলো জাত গেলো বলে/ এ কী আজব কারখানা/ সত্য বলতে কেউ নয় রাজি/ সবই দেখি তা-না-না /তুমি যখন ভবে এলে/ তখন তোমার কী জাত ছিলে/ যাবার বেলায় কী জাত নিলে/ সে কথা আমায় বলো না'
লালন তার শিষ্যদের বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর তার দেহ যেন প্রচলিত কোনো ধর্মীয় রীতিনীতি ছাড়াই কবর দেওয়া হয়। অবশ্য তার শিষ্যরা তাই করেছিলেন। লালন ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (১ কার্তিক) তার আখড়ায় শিষ্যদের নিয়ে সারা রাত গান করতে করতে ভোর রাতে বললেন- 'আমি চললাম'। লালন যেদিন চিরবিদায় নিলেন, সেদিন তার বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর।
ধর্ম নিয়ে অনেক ইতিহাস বয়ে গেছে। ধর্ম মানুষের জীবন ও মনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। পৌত্তলিকতা এক সময় মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারপর এলো একেশ্বরবাদের জয়-জয়কার। এখন সময় এসেছে মানবতাবাদের। মানবতাই মানুষের ধর্ম, অন্য কিছু নয়। মানবতাবাদই পারে মানুষে-মানুষে বিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি, ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর করতে। মানবতাবাদই পারে অন্ধত্ব ঘুচিয়ে মানুষকে আলোকিত করতে, আধুনিক করতে; জীবনকে আনন্দময় করতে; সত্য ও সুন্দরকে বুঝতে। লালন ফকির সাহসিকতা ও যুক্তির মাধ্যমে প্রচলিত ধর্মকে অসার প্রতিপন্ন করে মানবতাবাদ তথা মানব ধর্মের জয়গান গেয়েছেন। এ জন্য লালনকে মানব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা যায়। লালন ছিলেন একজন যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী ও আধুনিক মানুষ। লালনই জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের জয়গান গেয়েছেন; মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন।
সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর
[email protected]
- বিষয় :
- স্মরণ
- মানব ধর্ম
- রেজাউল করিম