ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি

লোকায়ত সংস্কৃতির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি

লোকায়ত সংস্কৃতির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে জসীম উদ্‌দীন

মোহীত উল আলম

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২২ | ০৫:০৬

কবি জসীম উদ্‌দীন পল্লিকবি হিসেবে পরিচিত হলেও তার সাহিত্যকর্ম ব্যাপক ও বিস্তৃত। তিনি তার কবিতার মধ্য দিয়ে গ্রামবাংলা ও গ্রামীণ জনজীবনের রূপ তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে আমরা ছোঁয়া পাই আধুনিকতার। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশব কাটে পাশের গ্রাম গোবিন্দপুরে পৈতৃক বাড়িতে। তার বাবা আনসার উদ্দিন ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা রাঙ্গা ছোটু ছিলেন একজন গৃহবধূ। জসীম উদ্‌দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরে ফরিদপুর জিলা স্কুলে লেখাপড়া করেন। সেখান থেকেই উত্তীর্ণ হন প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সালে। তার উচ্চশিক্ষা শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বিএ ও এমএ পাস করেন ১৯২৯ ও ১৯৩১ সালে। বহুমাত্রিক এই লেখক সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনবদ্য অনেক রচনা। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তার প্রয়াণ ঘটে। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের ছিলেন নিমগ্ন সাধক। শুধু তা-ই নয়; তিনি ছিলেন শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত। বঙ্গীয় প্রাদেশিক, পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

তার গদ্যশৈলী আমি মনে করি, আমাদের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য। তার মতো এত সাবলীল গদ্য রচনা খুব কম পাই। আমি আমার বিভিন্ন বই ও গবেষণায় এসব বিষয় তুলে ধরে তাকে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি। তার কর্মজীবনের সূচনা পর্বেই তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত হন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলা লোকসাহিত্যের বিশদ ব্যাখ্যা ও দর্শন খণ্ড খণ্ড আকারেও লিখে গেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। এর পর চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দেন প্রভাষক হিসেবে। ১৯৪৪ সালে তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে চাকরিজীবন থেকে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত কর্মে-সৃজনে ছিলেন নিরলস। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি লোকসাহিত্যে একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করেন, যার সাক্ষ্য মেলে তার কবিতা, উপন্যাস, গান, নাটকসহ সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে। আমি এও মনে করি, তিনি লোক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত পূর্ণাঙ্গ একজন প্রথম আধুনিক কবি।

তার অর্জনের ঝুলিও ভরপুর পুরস্কার আর সম্মাননায়। একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত হলেও তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। তার কবিত্বের প্রকাশ ঘটে ছাত্রজীবনেই। পল্লির মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব শুধু তার কবিতাতেই একাকার নয়; তার ব্যাপ্তি অন্যান্য ক্ষেত্রেও। তবে কবিতায় তা বিশেষভাবে রূপ পায়। ছাত্রাবস্থায় রচিত কবিতা 'কবর' তাকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দেয়। এ কবিতাটি যখন প্রবেশিকা বাংলা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখনও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেননি। কবি হিসেবে সাফল্যের সিঁড়িতে তখনই তিনি পা রাখেন। পল্লিসাহিত্য-সংস্কৃতির আখ্যান প্রবণতা তার কবিতায় এতটা প্রাধান্য পাওয়ার কারণেই তাকে পল্লীকবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় কিনা- সাহিত্যপ্রেমী অনেকের এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। আমরা কি সেভাবে মনে রেখেছি কিংবা সাহিত্যচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ধারণ করেছি তার আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনি, উপন্যাস, গল্প কিংবা নাটকের অনুপম শিল্পের বৈশিষ্ট্যকে?

তার নক্সী-কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, এক পয়সার বাঁশি, সখিনা, পদ্মা নদীর দেশে, দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি কাব্যগ্রন্থ একের পর এক সংস্করণের মধ্য দিয়ে এও প্রমাণিত- তার কাব্যিক নির্মাণশৈলী নিশ্চয় এমন কিছু ধারণ করে আছে, যা সমকালীন বাঙালি জীবনের সমকালীনতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। স্মরণ করি তার সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যটি। তিনি বলেছেন, 'জসীম উদ্‌দীনের কবিতার ভাব-ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নূতন ধরনের প্রকৃতিময় হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।' একই সঙ্গে বলতে হয়, তার সমৃদ্ধ রচনাভান্ডার কর্ষণ করে আমরা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা আরও বেশি আকর্ষণ করতে পারতাম। প্রশ্ন উঠতেই পারে, জসীম উদ্‌দীনকে সেই স্তরে আসীন করে আমাদের করণীয় অনেক দিকেই যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে কেন। আমি মনে করি, সময় এসেছে জসীম উদ্‌দীনকে নিয়ে চর্চা-গবেষণা আমাদের স্বার্থেই ব্যাপক করা জরুরি। এদিকে, সংশ্নিষ্টদের মনোযোগ বাড়ানো সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। তার রচিত ঐতিহ্যবাহী ভাটিয়ালি, জারি এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রচিত তার দেশাত্মবোধক গানগুলো বিমোহিত করে।

তার রচিত নাটক- পদ্মাপাড়, বেদের মেয়ে, মধুমালা, পল্লীবধূ, গ্রামের মেয়ে, ওগো পুষ্পধন, আসমান সিংহ যেন সময়ের কথা বলে। আত্মকথা- যাদের দেখেছি, ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায়, স্মরণের সরণী বাহিতেও পরিচয় মেলে এক শক্তিধর গদ্যশিল্পীর। ভ্রমণকাহিনি- চলে মুসাফির, হলদে পরীর দেশে, যে দেশে মানুষ বড়, জার্মানীর শহরে বন্দরে ইত্যাদি এর ব্যতিক্রম নয়। তার 'নক্সী-কাঁথার মাঠ' কাব্যগ্রন্থটি 'দ্য ফিল্ড এমব্রয়ডার্ড' এবং 'বাঙ্গালীর হাসির গল্প' গ্রন্থটি 'ফোক টেলস অব ইস্ট পাকিস্তান' নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। ১৯৬৯ সালে 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' ইউনেস্কোর অনুবাদ প্রকল্পে অনূদিত হয়। এই অসামান্য রূপকারকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্নেষণ করলে দেখা যায় তার চিত্রকল্প, উপমা, শব্দের গাঁথুনি, শৈল্পিক গভীরতা ইত্যাদি তার প্রতিটি রচনা অধিকতর সমৃদ্ধ করে তোলে।

তার সব রচনাই ইংরেজিতে অনূদিত হলে বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীদের নিশ্চয় অন্য রকম দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে এবং তাতে কল্যাণ বয়ে আনবে আমাদের বাংলা সাহিত্যের। জসীম উদ্‌দীনের আবেগ-অনুভূতি আমাদের জন্য যে সম্পদভান্ডার গড়ে দিয়েছে, তার আবেদন ফুরানোর নয়। আমরা অনেকেই জানি, কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যজগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। জসীম উদ্‌দীনকে নিঃসন্দেহে বলা যায় আধুনিক মনমানসিকতার পরিপূর্ণ একজন কবি তো বটেই; সাহিত্যিকও। তবে জাতীয়ভাবে তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি, যা আমাদের দৈন্যের প্রকাশ বলে মনে করি। জসীম উদ্‌দীনের স্বপ্নের সেই পল্লি গড়ে তোলার বিষয়টি কোনো সরকারই গুরুত্ব দেয়নি। কুমার নদ ঘিরে কবির যে আবেগ-অনুভূতি ছিল, সেই নদ এখন বিপদাপন্ন। পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীনের স্মৃতি রক্ষার্থে যা কিছু করণীয়, এ নিয়ে যেন আর সময়ক্ষেপণ না করা হয়। তার পরিচয় গণ্ডিবদ্ধ না করে বরং আমাদের জাতিসত্তার একজন সত্যিকার মহৎ ও বড় কবি-সাহিত্যিক হিসেবে তাকে সেই উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। বিশ্বাস করি, আমাদের আবহমান বাংলা চিরকাল টিকে থাকবে তার অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। তিনি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা প্রত্যাখ্যান করে সহজ-সরল পল্লিজীবনকে তুলে ধরেছেন তার কবিতাসহ সাহিত্যের নানা পর্বে।

জসীম উদ্‌দীনের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি লোকায়ত সংস্কৃতির নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। তিনি এ জন্যই আধুনিক কবি। তিনি তার কবিতায় যে উপমা ব্যবহার করেছেন, এর উৎস গ্রাম হলেও চেতনা প্রধানত নাগরিক। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং একটি বিশেষ অধ্যায়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রজন। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার যখন রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের উদ্যোগ নেয়, তখন প্রতিবাদ আন্দোলনের তিনিও ছিলেন অন্যতম অংশীজন। তাকে পল্লিকবি হিসেবে বলা হলেও সমগ্র নাগরিক সমাজের পাঠকের কাছেই তিনি ব্যাপক সমাদৃত। তিনি এই ভূখণ্ডের হৃদয়ের ভেতর থেকে জেগে ওঠা একজন সৃজনশীল বড়মাপের মানুষ- এর সাক্ষ্য তো বহন করছে তার রচনাবলি। নিজ সমাজের জাগরণ চেতনারও স্পষ্ট সাক্ষ্য রয়েছে তার রচিত বিপুল ভান্ডারে।

ড. মোহীত উল আলম: শিক্ষাবিদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন

×