ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সমাজ

নিম্নবিত্ত নারীরা যখন দুর্বৃত্তের নিশানায়

নিম্নবিত্ত নারীরা যখন দুর্বৃত্তের নিশানায়

আহমদ রফিক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০

গত ২৯ ডিসেম্বর সমকালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের কদম রসুলপুর গ্রামে মাদ্রাসাছাত্রী কিশোরী মারুফা খাতুনকে ঘুম ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। দরিদ্র মারুফা ও তার ছোট বোন ঘুমিয়েছিল একসঙ্গে। ভোরে বড় বোনকে পাশে দেখতে না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি জানালে খোঁজাখুঁজি করে পাশের জঙ্গলে মারুফার পোড়া লাশের সন্ধান মেলে। ধারণা করা হয়, মারুফাকে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা বর্বরোচিত ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমাদের স্মরণে আছে, ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে তারই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নির্দেশে পরিকল্পিতভাবে গায়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ওই বর্বরোচিত ঘটনার দ্রুত বিচার হলেও দণ্ডিতদের আইনের সব ধাপ শেষ করে আজও দণ্ড কার্যকর করা যায়নি। ওই নৃশংস ঘটনার তিন বছরের মাথায় আবারও পৈশাচিক কায়দায় আরেক নারীকে হত্যা করা হয়! ৪ জানুয়ারি সমকালেই প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে জানা গেল, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে দুই গারো কিশোরী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতেও ঘটেছে একই রকম ঘটনা।
দিনের পর দিন, একের পর এক ধর্ষণ আর হত্যা বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বাংলাদেশে যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও নিরাপদ নয় নারী-কিশোরী, তরুণী, এমনকি শিশুকন্যাও। চলন্ত বাসে ধর্ষণ, নির্জন পথ থেকে তুলে নেওয়া গার্মেন্ট শ্রমিক-তরুণী কিংবা বিশেষ এলাকায় কলেজছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ শেষে হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে আমাদের প্রশ্ন- এ যৌন নৈরাজ্য আর কত দিন ধরে চলবে বাংলাদেশে? এসব নিয়ে প্রতিবাদ, মানববন্ধন, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন তো কম হয়নি। সংবাদপত্রে লেখালেখিও কম হচ্ছে না; তবু ঘটনা ঘটেই চলেছে। সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের পক্ষ থেকে না মিলছে জবাব, না দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর তৎপরতা।
লক্ষ্য করার বিষয়, ঘটনাগুলো ঘটছে মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের তরুণী-কিশোরী ও গৃহবধূর ক্ষেত্রে, যাদের গণপরিবহনে চলাফেরা করতে হয় কিংবা যাদের অবস্থান সমাজে অনেকটা দুর্বল। সমাজ এমনই দূষিত হয়ে পচে-গলে পূতিগন্ধময় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে প্রতিবাদের ভাষা ও শক্তি হারিয়েছে। সামাজিক স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব ভুলে গিয়ে হাত-পা গুটিয়ে স্বার্থের ধান্ধায় সময় কাটাচ্ছে। বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার থেকে শুরু করে বিত্তবান শ্রেণির বখাটে সন্তানরা কিংবা সমাজের নানা শ্রেণির দুর্বৃত্তরা এত শক্তিমান ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, এদের পৃষ্ঠপোষক কিংবা ছায়াদানকারী শক্তি তথাকথিত কতিপয় রাজনীতিক।
সবচেয়ে বিস্ময়কর, কিছুকাল ধরে গণপরিবহনে ধর্ষণ ও হত্যা এমন ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রুপা ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের বর্বরতার বিষয়টি। ধর্ষক বাস ড্রাইভার ও তার সহযোগী হত্যাকাণ্ড শেষে রুপার লাশ ফেলে চলে গিয়েছিল। জানি না, এ হত্যা মামলার অগ্রগতি ও পরিণাম কতদূর। সাংবাদিক বন্ধুদের আমরা এ জাতীয় লেখায় বারবার আহ্বান জানিয়েছি, এসব ঘটনার সর্বশেষ সংবাদটি পরিবেশন করতে। না হলে সব সহ-উদ্যোগ অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব একমাত্র সাংবাদিকরাই পালন করতে পারেন। আমাদের কথা, বর্বরোচিত ঘটনা যেভাবে নিয়মিত ঘটছে, তাতে আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়নে বাংলাদেশের সামাজিক সুস্থতা কোন পর্যায়ে, কোন বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়াবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকের মন্তব্য- বিচারহীনতা এ জাতীয় অপরাধের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। নারী নির্যাতন-নিপীড়ন কিংবা ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলেছে। হত্যার কারণ পাছে দুর্বৃত্তদের অপরাধ ফাঁস হয়ে যায়। ভাওয়ালের জঙ্গলে বাসে রুপা হত্যা তেমনই এক ঘটনা ছিল।


আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারী নির্যাতনসহ সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা। বিগত এক দশকে সমাজে নারীর ব্যাপক উন্নয়ন-অগ্রগতিও দৃশ্যমান সরকারের গৃহীত নীতির কারণেই। কিন্তু এর পরও নারীর নিরাপত্তা এখনও যে নিশ্চিত করা যায়নি- মারুফা, গারো কিশোরী কিংবা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারীর সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এরই সাক্ষ্যবহ। শুধু সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা কিংবা কঠোরতাই এমন অপরাধের রাশ টেনে ধরতে পারে না, যদি প্রশাসনসহ সংশ্নিষ্ট সব মহলের দায়িত্ব পালনে সমনিষ্ঠা না থাকে। এই ঘাটতি দূর করতেই হবে। পালনে দায়িত্বশীল সবার নিষ্ঠ হতে হবে।
ধর্ষক বা ঘাতক অপরাধীর মনে বিন্দুমাত্র ভয় নেই শাস্তির, বিবেক দংশন দূরে থাক। এক-একটি ঘটনার বর্বরতা অন্যটিকে ছাড়িয়ে যায়। সংবাদপত্রে যেসব খবর পড়তে গেলে গা শিউরে ওঠে, এমনই সেসবের চরিত্র। সবকিছুর বিচারে মনে হয় সমাজটা দূষিত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সমাজের এলিট অংশের তাতে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। থাকলেও তা অতি সামান্য এবং দুর্বৃত্ত দমনে কার্যকর নয়।
ভাবতে কষ্ট হয়, একাত্তরের সমাজ ও রাজনীতি কেমন করে এত দুর্বৃত্তের জন্ম দিল! কেমন করে এত প্রতিক্রিয়াহীন অমানবিকতার জন্ম দিল! জননিরাপত্তা রক্ষার দায় যাদের মুখ্য, সেই পুলিশ বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যকেও দেখা গেছে দুর্বৃত্তের ভূমিকায়। একাত্তরের প্রতিবাদী পুলিশের উত্তরসূরির অংশবিশেষ কীভাবে অপরাধের পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ায়- সংবাদপত্রে সেসব খবর পড়ে বড় কষ্ট পাই। তেমনি একই অনুভূতি যখন দেখা যায়, রাজনীতি তার স্বার্থপরতা সম্বল করে জনসেবায় উদাসীন সময় কাটায়। আর এসব নিয়ে সমাজের মননশীল মহল রীতিমতো আত্মমগ্ন হয়ে প্রতিবাদহীন নাগরিকের ভূমিকা পালন করে। সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিকারের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে না। সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী, প্রতিবাদ বা মানববন্ধনে সব শেষ হয়ে যায়। সমাজের এ দূষণের প্রতিকারে মননশীলতা জোরালো প্রতিবাদে কদাচিৎ সোচ্চার।
অথচ একাত্তরের তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের শেষ নেই। কথায়, লেখায় আমরা তা প্রকাশ করি। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না, দূষিত সমাজ তার ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে আমাদের কোন দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে; হোক না তা সমাজের একাংশ। কিন্তু সে অংশ যেমন শক্তিমান, তেমনি প্রতাপশালী। সে যেমন দুর্নীতিপরায়ণ, তেমনি অপরাধপ্রবণ। এই প্রবণতা এক বহুমাত্রিক সংঘবদ্ধ অপশক্তির রূপ ধারণ করেছে। এই সামাজিক অপশক্তি রাফিকে বাঁচতে দেয় না, তরুণীদের শুদ্ধ জীবনযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার দীর্ঘ হাত প্রসারিত সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষার দায়ে নিয়োজিত বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের তৎপরতার
মধ্যেও। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যবিশেষের নেতিবাচক ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বৈরী, যা কোনোভাবেই অভিপ্রেত নয়।
নারীর নিরাপত্তার অভাব যে একটি সুস্থ, আধুনিক সমাজের লক্ষণ নয়, তা বলা বাহুল্য। আর সে কারণেই বাংলাদেশে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি শ্রেণি ও সদস্যের সামাজিক দায়বদ্ধতার ভূমিকা পালন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বিপুল ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে তাই আমাদের প্রশ্ন, দুর্বৃত্তদের নৈরাজ্য আর কত দিন চলবে?
আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক, কবি, রবীন্দ্র-গবেষক

আরও পড়ুন

×