ভাষার মাস
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে সামষ্টিক ব্যর্থতা

আহমদ রফিক
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০
১৯৫২ থেকে ২০২২। সময়ের ব্যবধান অনেক। আজ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন। সময় গড়িয়ে অনেক বড় অধ্যায় পেরিয়ে এলেও ভাষা আন্দোলনের সেই দিনগুলোর স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার নয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথে আন্দোলনের সেই দিনগুলো এবং জীবন উৎসর্গ করা স্মৃতি সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। স্কুলজীবন থেকেই যুক্ত ছিলাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে। তখনকার ছাত্র রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি ছিল না। ছাত্র রাজনীতি মানেই ছিল আদর্শের বড় জায়গা। স্কুল ও কলেজজীবনের ধারাবাহিকতায় মেডিকেল কলেজে এসেও ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হই। উল্লেখ্য, ঢাকা মেডিকেল কলেজ সেই সময়ে ছিল প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির ঘাঁটি। যখন ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হলো তখন সক্রিয়ভাবে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনে যুক্ত করায় আমাকে পালন করতে হয় সংগঠকের দায়িত্ব।
'৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট মুহূর্তে সৃষ্টি হয়নি। এর অনুসন্ধানে আমাদের ফিরে যেতে হবে অনেক পেছনে। যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয় তখন অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের মে মাসে মুসলিম লীগের নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান বললেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তখন কলকাতা ইত্তেহাদ ও আজাদ পত্রিকায় আবদুল হক, জাহেদী প্রমুখ বাংলা ভাষার পক্ষে নিবন্ধ লেখেন। আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গণআজাদী লীগ, যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিশ বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলতে শুরু করে। ওই সময় সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ডাক, রেলসহ বিভিন্ন কাগজপত্রে উর্দু ভাষার ব্যবহার শুরু করে। তখন এর প্রতিবাদ করেছিলেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা। এর পরের ইতিহাস সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের ব্যবহারিক ভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তখন বললেন, এটা মুসলিম দেশ। তাই উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। নাজিম উদ্দিন ও নূরুল আমিন তাকে সমর্থন করলেন। ১৯৪৮ সালের মে মাসে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তমদ্দুন মজলিশ ও সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের একটা বড় অংশ মাঝপথে আন্দোলন স্থগিত করেন। নাজিম উদ্দিনের আট দফা শান্তি চুক্তি প্রস্তাব গ্রহণ করে তারা ওই সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৪৮-১৯৫১ সাল পর্যন্ত সময়টা খুব খারাপ কেটেছে। একদিকে চলছিল ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে চলছিল আন্দোলনের প্রস্তুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। গণপরিষদের সব সদস্যের কাছে পাঠানো হয় স্মারকলিপি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় খাজা নাজিম উদ্দিন বললেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। তার ওই ভাষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ওই সংগঠনের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ওই পরিষদে সরকারবিরোধী সব দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি আমতলার কলাভবনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- ২১ ফেব্রুয়ারি বাজেট অধিবেশন বসবে, সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হবে সভা-সমাবেশ। ২১ ফেব্রুয়ারির সভা-সমাবেশ ঘিরে নেওয়া হয় ব্যাপক প্রস্তুতি। তা পাকিস্তান সরকারকে ভীত করে ফেলে। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সরকারের পক্ষে ঘোষণা করা হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসব্যাপী ঢাকায় জারি থাকবে ১৪৪ ধারা। সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ। ওই ঘোষণা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আরও উত্তেজিত করল। ঘোষণা দেওয়া হলো- ১৪৪ ধারা ভাঙার এবং একুশের সব কর্মসূচি পালন করার। কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সভা করে সিদ্ধান্ত নিল সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া ঠিক হবে না। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আবুল হাশিম। কিন্তু আবদুল মতিন, অলি আহাদ, গোলাম মাওলা প্রমুখ ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, সাধারণ ছাত্ররা তা মানবে না। অতএব ২১ ফেব্রুয়ারির আমতলার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। ২১ তারিখ এই পরিস্থিতিতে আমতলায় সেই সভায় শামসুল হক সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলেন। তখন তার কথা কেউ শুনতে চায়নি। আবদুল মতিন স্পষ্ট ঘোষণা দিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। তখন তাৎক্ষণিকভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে বলা হলো, ১০ জন করে মিছিল করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলও শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে সমাবেশের প্রস্তুতি চলছিল। প্রায় অপরাহেপ্ত ওই সমাবেশে পুলিশ অতর্কিত গুলি চালায়। রফিক, জব্বার, বরকতসহ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। আমার হিসাবে শহীদ হন ছয়জন।
এর পরদিন থেকে নতুন স্লোগান হলো 'শহীদ স্মৃতি অমর হোক'। ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের শহরে। ওই রক্তাক্ত আন্দোলনের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয় শহীদ মিনার নির্মাণের। ২৩ ফেব্রুয়ারি গৃহীত ওই সিদ্ধান্তের পর এক রাতের শ্রমে রাজনীতিমনস্ক মেডিকেল হোস্টেলের ছাত্ররা ১১ ফুট উচ্চতা ও ৬ ফুট চওড়ার শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নামে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে। ওই শহীদ মিনার পাকিস্তান সরকারকে আরও শঙ্কিত করে তোলে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন শহীদ মিনার উদ্বোধন করলেও সেদিন বিকেলেই পুলিশ শহীদ মিনার ঘেরাও করে তা গুঁড়িয়ে দেয়। এর ফলে আন্দোলনকারীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নেমেছিল। রক্তগঙ্গা পেরিয়ে আমাদের ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং একসঙ্গে সেই অধিকার আদায়ের চিন্তাগুলোও যুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে ওই আন্দোলনে আরও দুটি স্লোগান যুক্ত হয়। এগুলো হলো- 'রাজবন্দিদের মুক্তি চাই', 'সর্বস্তরে বাংলা চালু করো'। ওই জাতীয়তাবাদী চেতনার যাত্রাপথ ধরে যে উন্মেষ ঘটে ষাটের দশকে ওই পথ ধরেই ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা এবং ভাসানীর ১৪ দফার মাধ্যমে আমরা একাত্তরের সংগ্রামে পৌঁছে যাই। যদি সামগ্রিকভাবে এর তাত্ত্বিক মর্মকথা বিশ্নেষণ করি তাহলে বলব, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক স্বার্থ রক্ষার উদ্যোগ যেহেতু নেওয়া হয়েছিল সেহেতু শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না '৫২-এর আন্দোলন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এরই ধারাবাহিক অর্জন। জাতির ইতিহাসে এই অর্জন অনন্য অধ্যায় হয়ে আছে। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ইতিহাসে তখনই যুক্ত হয়ে যায় শহীদ দিবস হিসেবে।
২১ ফেব্রুয়ারি স্মরণে আমাদের নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ব্যাপকভাবে যে মেলাটি একুশের বইমেলা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু চলমান করোনা মহামারির কারণে এবারও এই মেলা ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে না। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই মেলা এখন বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক চেতনায় ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতির বাঁক পরিবর্তনের অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল সেই ঘটনার কেন্দ্রে নিহিত গণতান্ত্রিক চেতনায় আজও আমরা রাষ্ট্র ও সমাজে এর যথাযথ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে কেন পারলাম না- এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা যায়নি। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি
দেয় ও ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রে প্রতি বছরে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় এটি একটি বড় ধাপ।
কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে কতটা কী করতে পেরেছি? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বটে, কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই কেন? এই ব্যর্থতার দায় সবার। কথা ছিল শিক্ষাব্যবস্থা হবে একমুখী, কিন্তু তাও হলো না। আমরা রাষ্ট্র বদল করলাম কিন্তু সমাজ বিনির্মাণ করতে পারলাম না। কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে বৈষম্য দূরীকরণে একমুখী শিক্ষাব্যস্থার বিষয়টি নিশ্চিত করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি আবার ফিরে এসেছে শুধু অতীতের স্মৃতি হিসেবে নয়, ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি হিসেবেও। একুশের শিক্ষা হলো সমষ্টির পক্ষে কোনো বিজয়ই অসম্ভব নয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও যূথবদ্ধ আন্দোলনের সুফলের নজির আমাদের সামনে কম নেই। ভাষার মাসে আমরা যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্যেই এই বিষয়গুলো গণ্ডিবদ্ধ না রাখি। একই সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, আমরা যেন বায়ান্ন ও একাত্তরের অঙ্গীকার ভুলে না যাই। আমরা যদি আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে চাই তাহলে ওই অধ্যায়গুলোর চেতনা ধারণ করে এগোতে হবে সামনের দিকে।
আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক