ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ভাষার মাস

মাতৃভাষা সুরক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি

মাতৃভাষা সুরক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি

অজিত কুমার সরকার

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৪:৩১

স্বাধীনতার জন্য বাঙালির ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার জাতীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এমন উদাহরণ বিশ্বে বিরল। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো কর্তৃক 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯১টি দেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন ভাষা আন্দোলনকে বিশ্ব ইতিহাসেরও গৌরবময় অধ্যায়ে পরিণত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৫২ সালেই বাংলাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যান। ওই বছর তিনি চীনের পিকিংয়ে (২-১২ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তৃতা করেন। কেন তিনি চীনের বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ দেন তার উল্লেখ রয়েছে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' (পৃষ্ঠা ২২৮)-তে। তিনি বলেছেন, 'পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে কথা বলতে পারি। তবু মাতৃভাষায় কথা বলা আমার কর্তব্য।' এরপর স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তৃতা করেন।
আসলে বাংলায় বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলা ভাষাকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে পরিচয় করানো নয়, বাঙালির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্মত্যাগের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বার্তাও পৌঁছে দেন। কিন্তু যে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এত আন্দোলন, এত আত্মত্যাগ সেই ভাষা আজ কতটা টেকসই? শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই মাতৃভাষা ভুলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের দেশের শিক্ষিত তরুণদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাকে ইংরেজির চেয়ে কঠিন মনে করে। ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনের কারণে অনেক দেশের ভাষা-ই এখন অস্তিত্ব সংকটে।

বাস্তবতা হচ্ছে যেসব ভাষার লিখিত রূপ নেই, সেই ভাষাগুলোর অধিকাংশই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। লিখিত রূপ ও চর্চার অভাব এবং অন্য ভাষার আগ্রাসনের কারণে পৃথিবী থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় দু-একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের প্রায় সাড়ে সাত হাজার ভাষার অধিকাংশই এক সময় হারিয়ে যাবে। অভিজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান শতাব্দী শেষে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ ভাষার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে। ফরাসি ভাষাবিদ ক্লাউড হেজেজ বলেছেন, 'ইংরেজি ভাষা যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে তাতে আমরা যদি সতর্ক না হই এক সময় তা অধিকাংশ ভাষার মৃত্যু ঘটাবে।' কিন্তু ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় কী? বর্তমান বিশ্বে অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে প্রযুক্তিকে। এ নিবন্ধে তাই গুরুত্ব পেয়েছে মাতৃভাষাকে টেকসই করতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে।

এ নিয়ে আলোচনার আগে বাংলালিপির উদ্ভব ও পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তিতে তা ব্যবহারের দিকে চোখ ফেরানো যাক। কলকাতার দে'জ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে বাংলালিপির উদ্ভব সম্পর্কে সুধীর মণ্ডল লিখেছেন, "ব্রাহ্মীর বিবর্তিত রূপ থেকেই বাংলালিপির উদ্ভব। বাংলালিপিকে বলা যায় 'অক্ষরলিপি', যা নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মীর উন্নত সংস্করণ। বর্ণমালায় অক্ষরের আবিস্কার হয় পাশ্চাত্যের সুমেরীয় অঞ্চলে। প্রায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ বছর আগে লেখাপড়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ওই সময়ে লোকজন কাদার তৈরি ক্লে প্লেটে লিখত এবং পড়ত। তারও আগে এতদাঞ্চলে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সে সময় আর্যরা মাটির পাত্রে লিখত এবং তা পড়ত। ফারাওদের আমলে চামড়ার ওপর লিখে তা পড়ত। পরবর্তীকালে মিসরীয়রা এ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে কাগজে লিখতে শুরু করে। গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের সুবাদে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মানুষ ছাপার অক্ষরে পড়তে শুরু করে।" মুদ্রণ যন্ত্রের সিসারূপ ভাষার সঙ্গে বর্তমানের তথ্যপ্রযুক্তির ভাষারূপের বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, যে ভাষা প্রযুক্তিবান্ধব সেই ভাষাই টিকে থাকবে। আগামীতে বিশ্বে প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ক্ষুদ্র যন্ত্রের সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযোগ থাকবে। নিত্যনতুন প্রযুক্তিতে যারা তাদের নিজস্ব ভাষা যুক্ত করবে, তাদের ভাষাই টিকে থাকবে।


ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষাবিদদের পাশাপাশি রাষ্ট্র এবং প্রযুক্তিবিদদেরও সক্রিয় হতে হয়। মায়ের ভাষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের ইতিবাচক দিক হচ্ছে প্রযুক্তিমনস্ক সরকার ক্ষমতায়। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া ও চর্চা এবং ভাষাকে টেকসই করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা এবং তার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থেকে উৎসারিত সরকারি কিছু উদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করছে। প্রধানমন্ত্রী এক দরজা থেকে সেবা প্রদানের প্ল্যাটফর্মের (জেলা তথ্যবায়ন) নাম বাংলায় রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্ববৃহৎ প্ল্যাটফর্মটিরও নাম রাখা হয় 'জাতীয় তথ্যবাতায়ন'। এতে রয়েছে ৫২ হাজার ওয়েবসাইট, যা বাংলা ও ইংরেজিতে।

২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোবাইল ফোনে বাংলায় খুদেবার্তা (এসএমএস) চালুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সব ব্র্যান্ডের বেসিক মোবাইল হ্যান্ডসেটে পূর্ণাঙ্গ বাংলা কিপ্যাড সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হয়। ডটবিডির পাশাপাশি দ্বিতীয় কান্ট্রি কোডেড টপ লেভেল ডোমেইন হিসেবে 'ডটবাংলা' প্রবর্তন করা হয়। বাংলায় কিপ্যাড নেই এমন মোবাইল ফোনসেট আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সর্বশেষ সরকারি উদ্যোগটিও বেশ চমকপ্রদ। ডিজিটাল জগতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধিতে দেশেই বাংলা কর্পাস, বাংলা ওসিআর (বই বা পত্রিকা স্ক্যান করে তা সরাসরি এমএস ওয়ার্ডে কনভার্ট করার প্রযুক্তি), বাংলা স্পিচ টু টেক্সট, টেক্সট টু স্পিচ, জাতীয় বাংলা কি-বোর্ড, বাংলা স্টাইল গাইড, বাংলা ফন্ট, বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটরের মতো সফটওয়্যার ও টুলস তৈরির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের আওতায় সফটওয়্যার ও টুলসের ব্যবহার শুরু হলে তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলা ভাষাকে বৈশ্বিকরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। ডিজিটাল ডিভাইসে আরও ভালোভাবে এবং সহজে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া ও অনুবাদ সহজ হবে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণের কাজ এবং মৌলিক জ্ঞানসম্পন্ন সার্ভিস তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটির মতো প্রাগ্রসরমান (ফ্রন্টিয়ার) প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। এসবের ওপর দাঁড়িয়েই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। ফলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে রোবট বাংলায় কথা বলছে। দ্বিতীয়ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের ধারণাকে সামনে রেখে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সমাজের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষার জন্য ডিজিটাল রিসোর্স তৈরি করা হচ্ছে। প্রভাবশালী ভাষার দাপটে তাদের ভাষা যাতে হারিয়ে না যায় সে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

অনেকেরই ধারণা, ইংরেজি না জানলে প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় না। এটা ঠিক নয়। মোবাইল এবং ইন্টানেটের মাধ্যমে বাংলায় যোগাযোগে কোনো সমস্যা নেই। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, যেসব দেশ তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগে এগিয়ে আছে, তারা সবাই প্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহার করছে। চীন আমাদের সামনে বড় উদাহরণ। চীনা ভাষার অক্ষরগুলো অত্যন্ত জটিল এবং প্যাঁচালো। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। প্রযুক্তিতে মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ায় বর্তমানে চীনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বহু আগেই ৫০ কোটি ছাড়িয়েছে। তবে আমাদের দেশে প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার চর্চা হলেও এ মুহূর্তে বাংলায় ভালো কনটেন্টের অভাব রয়েছে। তাই দেশের ১৭ কোটির বেশি মোবাইল ফোন, ১৩ কোটিরও বেশি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং ৫ কোটির বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর কথা মাথায় রেখে মাতৃভাষায় ভালো ভালো কনটেন্ট ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি হবে। আর তা করা হলে শুধু অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি, জ্ঞানার্জন এবং তথ্য ও সেবা পাওয়া নিশ্চিত করবে না, মাতৃভাষাকে বাঙালির মাঝে চিরঞ্জীব করতে সহায়তা করবে।

অজিত কুমার সরকার: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×