লাঠিটিলা সাফারি পার্ক এবং কিছু প্রশ্ন

ছবি: সমকাল
দিলারা রহমান, জায়েদা শারমিন ও জহিরুল হক শাকিল
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২২ | ১২:০০
২০২২-২৩ সালের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলায় দেশের তৃতীয় সাফারি পার্ক নির্মাণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। সাফারি পার্ক প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য বা প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্ট বনভূমি মানব নিয়ন্ত্রিত উপায়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এ ধরনের সাফারি পার্কে বনভূমির নিজস্ব উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৃদ্ধি অক্ষুণ্ণ রেখে বন্যপ্রাণীকে এমনভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে এবং এখানে যারা দর্শনার্থী আসেন তারা সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষিত জায়গায় থেকে ওই বন্যপ্রাণীদের জীবনাচার, তাদের অভ্যাস অবলোকন ও উপভোগ করতে পারেন। এসব দিক বিবেচনা করলে সাফারি পার্ক একদিকে যেমন শিক্ষা ও গবেষণায় ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে বন্যপ্রাণীদের প্রতি মমতা তৈরির মাধ্যম হিসেবে কাজ করে; যা পরে বন্যপ্রাণীদের অধিকতর সুরক্ষা প্রদানের জন্য উদ্যোগী হতে মানুষকে সচেতন করে। সুতরাং লাঠিটিলা সাফারি পার্ক প্রকল্পটি আমাদের যে কারও কাছে আনন্দের বিষয় হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এর প্রয়োজনীয়তা।
মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পূর্ব মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত লাঠিটিলা পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টের একটি অংশ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি ট্রান্সবর্ডার রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্ট একটি। এই প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যে বর্তমানে ২০৯ প্রজাতির প্রাণী এবং ৬০৩ ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে জীববৈচিত্র্য বিবেচনায় এই প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যকে সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ক্রান্তীয় চির সবুজ বনের মোট আয়তন ৮০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে শুধু লাঠিটিলার আয়তন ২০ বর্গ কিলোমিটার। গত চার থেকে পাঁচ দশক ধরে সংরক্ষিত এই বনটির প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যেখানে সরকারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বনভূমির আয়তন প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর, যা মোট ভূখণ্ডের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ, সেখানে এই রকম একটি সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যকে মানব নিয়ন্ত্রিত সাফারি পার্ক করার যৌক্তিকতা কতটুকু, তা আলোচনার বিষয়।
পরিবেশবাদী এবং পরিবেশ নিয়ে যারা তাত্ত্বিক আলোচনা করেন তাদের মতে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অত্যন্ত জরুরি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে আমাদের প্রয়োজনীয় বনভূমিই নেই, সেখানে প্রাকৃতিক একটি বনভূমিকে ধ্বংস করে সাফারি পার্ক নির্মাণকে বাতুলতা বলা চলে।
তাত্ত্বিকভাবে টেকসই উন্নয়নের জন্য কোনো বড় প্রকল্প ও স্থাপনা নির্মাণের জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করা হয়। পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে একটি পরিস্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়, ওই প্রকল্পটির মাধ্যমে কী কী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং এই ক্ষতির বর্তমান অর্থমূল্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যবহারে ও সুরক্ষার জন্য পরবর্তী মূল্য কী পরিমাণ হবে? সেই সঙ্গে বিবেচনা করা হয়- নির্মিতব্য প্রকল্পটি থেকে কত লাভ হবে এবং এই লাভ পরিবেশকে সুরক্ষিত করতে কতটুকু সক্ষম হবে। ইকো সিস্টেমের চেইন বা চক্রাকার প্রক্রিয়ায় এটি কোনো আঘাত হানবে কিনা প্রভৃতি। সমীক্ষা অনুযায়ী যদি লাভের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে সেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলে তা বর্জন বা পরিত্যাগ করা হয়; বাণিজ্য বা অর্থমূল্যে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।
লাঠিটিলা সাফারি পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই বড় পরিসরে পরিবেশগত সমীক্ষা জরুরি। লাঠিটিলা সাফারি পার্ক ২৭০ একর জমির ওপর ৮৭০ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য একটি প্রকল্প। পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর মতামত অনুযায়ী, এটি নির্মিত হলে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বনভূমি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সুতরাং সরকারের নিজের স্বার্থেই এই সমীক্ষা পরিচালনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, কত শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে এবং পরিবেশ ও ইকো সিস্টেমের জন্য এটি কী পরিমাণ হুমকির কারণ হবে প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমীক্ষা পরিচালিত হলে মৌলভীবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠী তথা বাংলাদেশের জনগণ বুঝতে সক্ষম হবে, লাঠিটিলা সাফারি পার্ক আমাদের জন্য কেন প্রয়োজনীয় এবং কেন প্রয়োজনীয় নয়।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। লাঠিটিলা অভয়ারণ্যে এমনিতেই হাতি, উল্লুক, মায়াহরিণ, বানরসহ ২০৯ প্রজাতির প্রাণী বসবাস করে। কিন্তু সাফারি পার্কের জন্য এখানে ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে আফ্রিকা থেকে প্রাণী আমদানি করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই আমদানিকৃত প্রাণীরা আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে কতটা খাপ খাওয়াতে সক্ষম হবে এবং লাঠিটিলার নিজস্ব বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে কতটা সহাবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে সেটিও আমাদের ভাবনার বিষয়। গাজীপুরের সাফারি পার্কের কর্মকর্তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রাণী হত্যার বিষয়গুলোও এখানে প্রশ্নের সৃষ্টি করে। তৃতীয় সাফারি পার্ক বাস্তবায়ন কাজ শুরু করার আগে বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই একটি পূর্ণাঙ্গ এবং গ্রহণযোগ্য পরিবেশগত সমীক্ষা করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখকবৃন্দ: সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক
মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পূর্ব মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত লাঠিটিলা পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টের একটি অংশ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি ট্রান্সবর্ডার রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্ট একটি। এই প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যে বর্তমানে ২০৯ প্রজাতির প্রাণী এবং ৬০৩ ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে জীববৈচিত্র্য বিবেচনায় এই প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যকে সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ক্রান্তীয় চির সবুজ বনের মোট আয়তন ৮০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে শুধু লাঠিটিলার আয়তন ২০ বর্গ কিলোমিটার। গত চার থেকে পাঁচ দশক ধরে সংরক্ষিত এই বনটির প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যেখানে সরকারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বনভূমির আয়তন প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর, যা মোট ভূখণ্ডের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ, সেখানে এই রকম একটি সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যকে মানব নিয়ন্ত্রিত সাফারি পার্ক করার যৌক্তিকতা কতটুকু, তা আলোচনার বিষয়।
পরিবেশবাদী এবং পরিবেশ নিয়ে যারা তাত্ত্বিক আলোচনা করেন তাদের মতে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অত্যন্ত জরুরি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে আমাদের প্রয়োজনীয় বনভূমিই নেই, সেখানে প্রাকৃতিক একটি বনভূমিকে ধ্বংস করে সাফারি পার্ক নির্মাণকে বাতুলতা বলা চলে।
তাত্ত্বিকভাবে টেকসই উন্নয়নের জন্য কোনো বড় প্রকল্প ও স্থাপনা নির্মাণের জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করা হয়। পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে একটি পরিস্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়, ওই প্রকল্পটির মাধ্যমে কী কী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং এই ক্ষতির বর্তমান অর্থমূল্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যবহারে ও সুরক্ষার জন্য পরবর্তী মূল্য কী পরিমাণ হবে? সেই সঙ্গে বিবেচনা করা হয়- নির্মিতব্য প্রকল্পটি থেকে কত লাভ হবে এবং এই লাভ পরিবেশকে সুরক্ষিত করতে কতটুকু সক্ষম হবে। ইকো সিস্টেমের চেইন বা চক্রাকার প্রক্রিয়ায় এটি কোনো আঘাত হানবে কিনা প্রভৃতি। সমীক্ষা অনুযায়ী যদি লাভের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে সেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলে তা বর্জন বা পরিত্যাগ করা হয়; বাণিজ্য বা অর্থমূল্যে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।
লাঠিটিলা সাফারি পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই বড় পরিসরে পরিবেশগত সমীক্ষা জরুরি। লাঠিটিলা সাফারি পার্ক ২৭০ একর জমির ওপর ৮৭০ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য একটি প্রকল্প। পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর মতামত অনুযায়ী, এটি নির্মিত হলে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বনভূমি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সুতরাং সরকারের নিজের স্বার্থেই এই সমীক্ষা পরিচালনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, কত শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে এবং পরিবেশ ও ইকো সিস্টেমের জন্য এটি কী পরিমাণ হুমকির কারণ হবে প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমীক্ষা পরিচালিত হলে মৌলভীবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠী তথা বাংলাদেশের জনগণ বুঝতে সক্ষম হবে, লাঠিটিলা সাফারি পার্ক আমাদের জন্য কেন প্রয়োজনীয় এবং কেন প্রয়োজনীয় নয়।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। লাঠিটিলা অভয়ারণ্যে এমনিতেই হাতি, উল্লুক, মায়াহরিণ, বানরসহ ২০৯ প্রজাতির প্রাণী বসবাস করে। কিন্তু সাফারি পার্কের জন্য এখানে ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে আফ্রিকা থেকে প্রাণী আমদানি করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই আমদানিকৃত প্রাণীরা আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে কতটা খাপ খাওয়াতে সক্ষম হবে এবং লাঠিটিলার নিজস্ব বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে কতটা সহাবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে সেটিও আমাদের ভাবনার বিষয়। গাজীপুরের সাফারি পার্কের কর্মকর্তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রাণী হত্যার বিষয়গুলোও এখানে প্রশ্নের সৃষ্টি করে। তৃতীয় সাফারি পার্ক বাস্তবায়ন কাজ শুরু করার আগে বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই একটি পূর্ণাঙ্গ এবং গ্রহণযোগ্য পরিবেশগত সমীক্ষা করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখকবৃন্দ: সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক
- বিষয় :
- সাফারি পার্ক