ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অগ্নিঝরা মার্চ

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু

ইন্দিরা গান্ধী

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২২ | ১৪:৩২

১৯৪০ সাল ডেকে এনেছিল ১৯৪৭-এর পরিণতি। তাকে ইন্ধন দিয়েছিল ১৯৪৮-এ জিন্নাহর ঘোষণা। এসবকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছতেই হতো ১৯৭১ সালের ঘটনায়। সেদিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশের জন্মকে বলা যায় দেশভাগের আবশ্যিক পরবর্তী ধাপ।

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা আকাশচুম্বী অজ্ঞতা নিয়ে বুঝতে পারেননি কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন- বাংলার মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রোথিত বাঙালিত্ব বহুকালের বাস্তব রূপ। স্পষ্ট ধারাবাহিকতার চিহ্ন ছিল বাংলার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। সেদিন পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সময়েও একে ফজলুল হক আর আবুল হাশিমের কড়া সতর্কবাণী ছিল- 'আমাদের সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়; ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। আসুন, আমরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তা করি।' এতকিছুর পরও অন্ধ হওয়ার ভান করে প্রলয় বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন জিন্নাহ আর তার সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ।

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তার মতে, ইতিহাসের বড় বড় পেশাদার পণ্ডিত নিজেদের কাজটুকু ঠিকভাবে করেন না। তাই তাদের দ্বারা ইতিহাসের মূল্যায়নও হয় না। দু'বছর আগে ভারতের বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিনারের মঞ্চে অমিত শাহের এ অভিমত শোনা গিয়েছিল। উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের এটাই দস্তুর।

এ সময়ে এসব প্রসঙ্গ তোলার কারণ, ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে ভারতের বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক মনোভাব। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ৫০ বছর উপলক্ষে বিজয়োৎসবে তাদের আয়োজনে কোথাও ইন্দিরা গান্ধীর নাম উচ্চারণ করেনি মোদি সরকার। পাকিস্তানকে পরাভূত করার পেছনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব কীভাবে কাজ করেছে; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার নেপথ্যে তার ভূমিকা কী ছিল; সে কথা গোটা বিশ্ব জানে। সত্যিকারের ইতিহাসের পাতা থেকে কেউ চাইলেও তা মুছে দিতে পারবে না। ঠিক তিন বছর আগে কলকাতায় ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল। ইতিহাস কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধান কেএম শ্রীমালি বলেছিলেন, 'দেশে যুক্তিতর্কের পরিসর বড়ই কমে যাচ্ছে। ইতিহাস সম্পর্কে যাদের জ্ঞানগম্যি নেই, তারা তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে নিজেদের মতো করে সব চাপিয়ে দেয়।'

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক-বেসামরিক সব রকম সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। কলকাতা থেকেই সম্প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্দিরা-মুজিব একসঙ্গে সমাবেশ করেছিলেন ব্রিগেডে। বলা হয়ে থাকে, ওই সভায় জনসমাগম এখনও অনতিক্রম্য রেকর্ড হয়ে আছে। সেই ইন্দিরাকে উহ্য রেখে ভারতের ১৯৭১ সালের যুদ্ধজয়ের বয়ান ইতিহাসকেই অগ্রাহ্য করার শামিল।

২০০৭-০৮ সালের কথা। খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদ ফুরোনোর পর বাংলাদেশে তখন জরুরি অবস্থা। কেয়ারটেকার সরকারের শাসন চলছে। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা- দু'জনেই বন্দি। ভারত তখন বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দূতিয়ালি করছে। খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সঙ্গে কথা বলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। প্রণব তার স্মৃতিকথা বইয়ে লেখেন- 'যখন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা জেলে থাকার সময় হাসিনাকে ছেড়ে চলে যান, আমি তাদের এই অবস্থানের জন্য বকুনি দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কারও দুঃসময়ে তাকে ছেড়ে যাওয়াটা অনৈতিক।'

২০০৮ সালে তদানীন্তন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে গেলে প্রণব মুখার্জি তাকে বুঝিয়েছিলেন, হাসিনা হোন বা খালেদা হোন, সব রাজনৈতিক বন্দিকেই মুক্তি দিতে হবে। মইন আহমেদের আশঙ্কা ছিল, শেখ হাসিনা এলে তার ওপর কোপ পড়বে। প্রণব আশ্বাস দিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও যাতে মইন বিপদে না পড়েন, সে দায়িত্ব তার।

উপমহাদেশে বাংলাদেশ এবং ভারত বোধ হয় একমাত্র প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্র, যেখানে চীন তার ছড়ি ঘোরাতে পারে না। ভারতের সঙ্গে আছে বাংলাদেশের জন্মের সম্পর্ক, নাড়ির সম্পর্ক। এই সম্পর্ক অধিতকর পুষ্ট করেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। ইতিহাসের বড় অধ্যায়জুড়ে তার অবস্থান।

সুধীর সাহা: কলাম লেখক
[email protected]

আরও পড়ুন

×