ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

কোটা সংস্কার আন্দোলন

ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলা

তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত, হাসপাতালেও ধাওয়া

ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলা

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীর ওপর এভাবেই হামলা চালানো হয়। সোমবার বিকেলে ঢাবি ক্যাম্পাসে- মামুনুর রশিদ

 সমকাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪ | ০১:৫০ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৪ | ১৩:২৮

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেক ছাত্রী রয়েছেন। গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে প্রথমে দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে দফায় দফায় ক্যাম্পাসজুড়ে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী একজোট হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠিসোটা হাতে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দখলে চলে যায় ক্যাম্পাস। সংঘর্ষের সময় কয়েক যুবককে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গেছে। সন্ধ্যায় বহিরাগতদের ক্যাম্পাস থেকে বের করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানে পুলিশ প্রবেশ করে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর মধ্যরাতে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে পুলিশ।    

এদিকে গত রাতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা জানায়, আজ সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ পালন করা হবে। পাল্টা কর্মসূচিতে আজ দুপুর দেড়টায় ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম পান্থ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। 

রাত সাড়ে ১২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অনেক সাধারণ ছাত্রকে হল ছাড়তে দেখা যায়।  মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয়। যুবলীগ ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়। এ ছাড়া কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ্ হল ও অমর একুশে হলের গেটে অবস্থান নিয়েছেন। রাত ১১টার দিকে কবি জসীম উদ্‌দীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হেদায়াতুল ইসলামকে বেদম মারধর করেছেন অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীরা। হামলকারীরা এ সময় স্লোগান দেন–‘ছাত্রলীগ পাইছি, ছাত্রলীগ পাইছি’। এ ছাড়া  শহীদুল্লাহ্ হলের সামনে গতকাল রাতে নিউমার্কেট থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল হাসান ফাহাদ গুলিবিদ্ধ হন। 

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে রোববার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের দেওয়া স্লোগান ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ নিয়ে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। নানা মহল এটাকে ‘ন্যক্কারজনক’ বলে আখ্যা দেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘রাজাকার’ বলায় তারা এমন স্লোগান দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রশ্নে কোটাবিরোধীরা রাজু ভাস্কর্যে গতকাল দুপুর ১২টায় কর্মসূচির ডাক দেন। অন্যদিকে একই স্থানে বিকেল ৩টায় ছাত্রলীগ প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। 

এদিকে রোববার রাতেই জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের খবর আসে। এ সময় সিলেটসহ কয়েকটি স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর পাওয়া যায়। গতকাল দুপুর থেকে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিভিন্ন ক্যাম্পাস। সন্ধ্যায় জাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। চট্টগ্রামে ৭ এবং সিলেট ও কুড়িগ্রামে ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।    

বিকেল ৩টার দিকে ঢাবির ভিসি চত্বরে ছাত্রীরা বাসে আশ্রয় নিলে সেখান থেকে তাদের নামিয়ে হামলা করতে দেখা যায় মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে। হামলার পর ছত্রভঙ্গ হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এর পর দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলেছে এ তাণ্ডব।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘ছাত্রলীগ আমাদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। ছাত্রীদেরও তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। এ হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।’
এর আগে দুপুর ১২টা থেকে কোটা সংস্কারের এক দফা এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ ও সমাবেশে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইডেন কলেজ, নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। 

অন্যদিকে বিকেল ৩টার দিকে পূর্বঘোষিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমানের প্রতিবাদ’ কর্মসূচি পালন করতে দুপুর ১২টা থেকেই মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। সেখানে বহিরাগত এবং ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের কর্মীদের উপস্থিতি দেখা যায়। এর আগে কয়েকটি বাসে করে বহিরাগত ও মহানগর ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাসে ঢোকেন। ফলে সকাল থেকেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ছিল ক্যাম্পাসজুড়ে। 

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে 
ঘটনার সূত্রপাত হয় দুপুরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ঢাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেকে। এক পর্যায়ে ঢাবি ছাত্রলীগ এবং সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের বহিরাগত নেতাকর্মী সংগঠিত হয়ে দফায় দফায় হামলা চালায় আন্দোলনরতদের ওপর।    

দুপুর আড়াইটার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর একটি দল মিছিল নিয়ে প্রতিদিনের মতো ঢাবির হলগুলোতে যায়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে, বিজয় একাত্তর হলে শিক্ষার্থীর ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। খবর পেয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে বিজয় একাত্তর হলের দিকে যান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে ছাত্রীরাও ছিলেন। হলের কাছাকাছি পৌঁছালে আগে থেকেই হেলমেট, লাঠিসোটা, হকিস্টিক নিয়ে হলগেটে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হলগেটে ভাঙচুর চালান। 
এক পর্যায়ে কবি জসীম উদ্‌দীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। তাদের সঙ্গে বের হন বিজয় একাত্তর হলের নেতাকর্মীও। সবার হাতে ছিল লাঠিসোটা, স্টাম্প, স্টিলের পাইপ, রড। অনেকে হেলমেট পরিহিত ছিলেন। চারদিক থেকে একসঙ্গে হামলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পিছু হটতে থাকেন। এ সময় তিন শিক্ষার্থীকে মাটিতে ফেলে মারতে থাকেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। দু’পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে কিছুক্ষণ। এর পরই ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ছাত্রলীগের হাতে। 

এ হামলায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি রবিউল হাসান রানা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু ইউনুস, সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন রশীদ ও বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান শান্তকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। পরে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এসে সবাইকে নিয়ে মলচত্বরের দিকে যান। হামলার সময় কয়েকজনকে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতেও দেখা যায়। 

মলচত্বরে বহিরাগত-মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের হামলা
হল এলাকায় পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মূল মিছিলটি মলচত্বরের দিকে চলে আসে। আগে থেকেই মধুর ক্যান্টিনে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দক্ষিণ মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পির নেতৃত্বে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বহিরাগতরা। তারা প্রায় সবাই হেলমেট পরিহিত ছিলেন। শিক্ষার্থীরা মলচত্বরে গেলে তাদের ওপর একযোগে হামলা চালানো হয়। এ ছাড়াও সূর্য সেন হল, প্রশাসনিক ভবন, ভিসি চত্বর থেকে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়লে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু হয়। এ সময় ভিসি চত্বর হয়ে ফুলার রোডে পালাতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। ওই সময় দৌড়ে হকিস্টিক-লাঠি দিয়ে ছাত্রীদের পেটাতে থাকেন ছাত্রলীগ ও বহিরাগতরা।

ছাত্রীদের বাস থেকে নামিয়ে মারধর
মলচত্বর থেকে দৌড়ে শিক্ষার্থীরা ভিসি চত্বরের দিকে যান। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিআরটিসির একটি দোতলা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। সে বাসে আত্মরক্ষার্থে উঠে পড়েন ৫০-৬০ ছাত্রী। তাদের বাস থেকে নামিয়ে এনে পেটাতে থাকেন তারা। এ সময় অনেক ছাত্রী জুতা, ব্যাগ, ছাতা ফেলে পালাতে থাকেন। কেউ ফুলার রোড হয়ে শহীদ মিনারের দিকে, কেউ পলাশীর দিকে, কেউ নীলক্ষেতের দিকে চলে যান। এ সময় চার ছাত্রী ও দুই ছাত্রের মাথা ফেটে যায়। আরও অনেকে গুরুতর জখম হন। এ ছাড়া কয়েকজন সংবাদকর্মী আহত হয়েছেন।  

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৬ ব্যাচের ছাত্রী তানজিলা তাসনীম বলেন, ‘ভিসি চত্বরে মৈত্রী হলের এক ছাত্রীর হাতে ইট লাগার কারণে নড়তে পারছিলেন না। ফলে আমি ওকে ছেড়ে আসতে পারিনি। এ সময় হেলমেট পরা কয়েকজন এসে আমাদের সরে যেতে বলে। আমি বুঝতে পারছিলাম না– কী করব। আমি বলেছিলাম, আমি জাস্ট যৌক্তিক আন্দোলনে ছিলাম। তার পর সে আমার ডান হাত মুচড়ে দিয়েছে।’  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার বলেন, ‘আমরা কখনও ভাবিনি, ছাত্রলীগ এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করবে। ছাত্রলীগের কর্মীরা হেলমেট পরে আমাদের বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে।’

ছাত্রলীগের প্রকাশ্যে মহড়া 
শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ও রাজিবুল ইসলাম বাপ্পির নেতৃত্বে দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আর বহিরাগতদের নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে মহড়া দিতে দেখা যায়। অন্যদিকে সৈকতও দলবল নিয়ে মহড়া দেন। এর পর তারা বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করছিলেন। এদিকে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ক্যাম্পাসের এক শিক্ষার্থীকে পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে পেয়ে পিটুনি দেন মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

ঢামেকের জরুরি বিভাগেও ধাওয়া
আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হলে সেখানেও ধাওয়া করা হয়েছে। রাত ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে জসীম উদ্‌দীন হলের সৈকতের অনুসারী রাশেদুজ্জামান রনির নেতৃত্বে ৭০-৮০ জন জরুরি বিভাগে ঢুকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এ সময় সাংবাদিকদেরও মারধর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় অ্যাম্বুলেন্সও। সব মিলিয়ে চার দফায় ঢামেকের জরুরি বিভাগে হামলা ও পাল্টা হামলা হয়। 

এর আগে মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও তাদের সঙ্গে থাকা বহিরাগতরা জরুরি বিভাগের সামনে আহত যাকেই পেয়েছেন, তাঁকে মারধর করেছেন।
ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখা যায়, কারও মাথা ফেটে গেছে, কারও কান থেকে রক্ত পড়ছে। কারও চোখে গুরুতর জখম হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই ছাত্রী। এ ছাড়া হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে অন্তত ছয়জনকে আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় সূর্য সেন হল ও মহানগর ছাত্রলীগ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ সেখানে জড়ো হলে তারা আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালের তৃতীয় তলার গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কার্জন হল এলাকা উত্তপ্ত
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে খবর আসে শহীদুল্লাহ্‌ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। পরে কার্জন হল এলাকায় চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।
ওই সময় রাজু ভাস্কর্য থেকে কার্জন হল-সংলগ্ন দোয়েল চত্বরে যাওয়ার জন্য ঘোষণা দেওয়া হয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। জানা যায়, বিজ্ঞান বিভাগের হলগুলোর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই কোটা সংস্কারের পক্ষে। অমর একুশে হল, ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা শহীদুল্লাহ্ হলে আশ্রয় নেন। তিন হলের শিক্ষার্থীরা একত্র হয়ে প্রতিরোধ করেন। শিক্ষার্থীরা হল থেকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে পুলিশ কার্জন হল এলাকায় আসে। তবে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মী লাঠিসোটা, স্টাম্প, রড নিয়ে হামলা করতে থাকেন শিক্ষার্থীদের ওপর।

সংঘর্ষ চলাকালে ঢাবি ক্যাম্পাসে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবক

আগ্নেয়াস্ত্র ও ককটেল বিস্ফোরণ
শহীদুল্লাহ্ হলের সামনের সড়কে ১৫-২০টি বিকট শব্দ পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সড়কে কয়েকজনের হাতে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র দেখেছেন। কেউ কেউ আন্দোলনকারীর দিকে সেই অস্ত্র তাক করেছিলেন। গুলি ছোড়া হয় ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দোয়েল চত্বর থেকে শহীদুল্লাহ্ হলের সামনের সড়ক ও হলের পাশের মোড়ে উভয় পক্ষের ছোড়া ইটের টুকরা ছেয়ে যায়। একে অপরকে হুমকি দিতে শোনা যায়। তবে ওই সড়কে যখন রিকশা কিংবা অ্যাম্বুলেন্স রোগী বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, তখন রাস্তা থেকে ছাত্রলীগ হাত উঁচিয়ে ভবনের ছাদে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীদের ইট ছুড়তে নিষেধ করে বলছিলেন– ইট ছুড়িস না, রোগী আসছে। সে সময় আন্দোলনকারীদের ইট ছোড়া থেকে বিরত থাকতে দেখা যায়। চানখাঁরপুল মোড়ে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান দেখা গেলেও তারা নীরব ছিলেন। ৭টার দিকে দোয়েল চত্বরে পুলিশ যাওয়ার পর ছাত্রলীগ সেখান থেকে চলে যায়। এর পর আন্দোলনকারীরা শহীদুল্লাহ্ হলের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করছিলেন।

শেকৃবিতে বিক্ষোভ
শেকৃবি প্রতিনিধি জানান, ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে লুৎফর রহমান হলের সামনে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে ফার্স্ট গেট হয়ে কলেজ গেট এবং গণভবনের সংযুক্ত সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় গণভবনের সংযুক্ত সড়কে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়।

ছাত্রলীগ যা বলছে
সংঘর্ষের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীকে তারা উস্কে দিয়েছে। আমরা দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছি। আমরা তাদের পাঁচ মিনিটে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছি।’
শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা সাধারণ শিক্ষার্থী নন। তারা বিএনপি নেতা ইশরাকের কর্মী। এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী ১০ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ  শিবির-ছাত্রদলের কর্মী। জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলকে আমরা যুগে যুগে পরাজিত করেছি। তারা কোনো কিছুই করতে পারেনি। এবারও কিছু করতে পারবে না।’ এ সময় তিনি জানান, সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।

প্রভোস্ট কমিটির জরুরি বৈঠকে ৫ সিদ্ধান্ত 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল বিকেল ৫টায় প্রভোস্ট কমিটির এক জরুরি সভা উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয়– শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হলে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবে। প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানে সার্বক্ষণিক হলে অবস্থান করবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। হলগুলোয় বহিরাগত কেউ অবস্থান করতে পারবে না। যে কোনো ধরনের গুজব ও অপপ্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। নাশকতামূলক কাজ থেকে বিরত থাকতেও বলা হয়েছে। কেউ নাশকতামূলক কাজে জড়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×