ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ঈদের সিনেমার ভালোমন্দ

রাজকুমার: যেখানে মাস ও ক্লাস অডিয়েন্সকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে

রাজকুমার: যেখানে মাস ও ক্লাস অডিয়েন্সকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে

ছবি: সংগৃহীত

সঞ্জয় সমদ্দার

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩:১৯ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩:৫৩

সিনেমাবিষয়ক আলোচনায় একটা প্রশ্ন আসে– ‘জীবন কি সিনেমার মতো, নাকি সিনেমা জীবনের মতো।’ নাকি আর্টের এই বড় মাধ্যম হলো কল্পনার ভিজুয়াল আস্ফালন? অ্যারিস্টটলের আর্ট নিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি আছে–‘Art is artificial... ।’ তো সিনেমায় যে জীবনই দেখানো হোক না কেন, তা নির্মাতার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। তাই তো সিনেমার চরিত্ররা কখনও লার্জার দ্যান লাইফ, কখনও জীবনঘনিষ্ঠ। সিনেমা নামে বিশাল শিল্পের নানামাত্রিক উদ্দেশ্য থাকলেও মোটাদাগে প্রধান উদ্দেশ্য দর্শকদের বিনোদন দেওয়া। সেই বিনোদন নানাভাবে হতে পারে। হাসিয়ে, কাঁদিয়ে, উড়িয়ে কিংবা নাড়িয়ে। 

বিনোদন হতে পারে মৌনতায় অথবা হাহাকারে। আমি যখন যে ধরনের সিনেমা দেখি তখন সেই জনরার, মেরিট ধরেই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি।  যেমন আমি তারেক মাসুদ এর মাটির ময়না দেখার সময় কাজী হায়াৎ এর আম্মাজান এর রেফারেন্স মাথায় রাখিনা বা ভাইস ভার্সা । কারণ তাদের ফিল্ম মেকিং এর এ্যাপ্রোচটাই ডিফরেন্ট ।

রাজকুমার একটি বাংলা সিনেমা যেটাতে মাস ও ক্লাস অডিয়েন্স কে একই সাথে খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে । যেটা খুব দরকারও কিন্তু মাস মোমেন্ট তুলনামূলক কম যতটা ক্লাস মোমেন্ট আছে ! পরিচালকের প্রচেষ্টা প্রশংনীয় যে তিনি মাস ও ক্লাস অডিয়েন্সের দূরত্ব কমাতে গেয়েছেন । যেটা এই সময়ে খুবই জরুরি ।

‘রাজকুমার’ সিনেমার ক্যানভাস বেশ বড়। প্রযোজক, পরিচালক সিনেমার ভিজুয়াল ন্যারেশনের স্বার্থে কম্প্রোমাইজ করেননি (বাংলা সিনেমার নিরিখে)। দারুণ সব লোকেশনে শুট করেছেন। ল্যান্ডস্কেপে গ্রামবাংলা দারুণভাবে উঠে এসেছে। সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার। চোখকে আরাম দেয়! স্ক্রিনপ্লে গতিশীল কিন্তু এটা কিছুটা প্রেডিক্টেবল থাকায় দর্শকভেদে রিঅ্যাকশন ভিন্ন হতে পারে। তবে এ সিনেমায় দারুণভাবে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের ছোট কিন্তু ভীষণ ইফেক্টিভ একটি এপিসোড আছে, যা দর্শক হিসেবে আমাকে ছুঁয়ে গেছে।

হিমেল আশরাফ দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। সংলাপ ঠিকঠাক। তবে একটি সংলাপ মনে থেকে গেছে।সংলাপটি কিছুটা এরকম– ‘একজন নির্দোষ মানুষ যখন প্রশ্ন করে যে তার দোষ কী– এর চেয়ে ভারী আর কিছু নেই। আমি ৩০ বছর ধরে সেই ভার বইতেছি।’ টেকনিক্যাল দিক বলতে গেলে আরশ খান, মাহির গেটআপ, মেকআপ আরও ভালো হতে পারত। বিজিএম ঠিকঠাক, তবে কার্পেট মিউজিক থাকায় মাঝে মাঝে দৃশ্যের সঙ্গে একাত্ম হতে ডিট্র্যাক্ট করেছে। কালার কারেকশনসহ বাকি সব ঠিকঠাক। তারিক আনাম খান, দিলারা জামান, মাহিয়া মাহি, ডা. এজাজ, শিবলু সবাই ভালো কাজ করেছেন।

‘রাজকুমার’-কে শাকিব খানের ওয়ানম্যান শো বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশে শাকিব খানের স্টারডম এখন এমন জায়গায় আছে যে, একটি সিনেমার টিজার, ট্রেলার ছাড়াই ১২৫ হলে রিলিজ হয়! যা মোট হলের ৮০শতাংশেরও বেশি! সবচেয়ে বেশি রেন্টালে সিনেমাহল মালিকরা সিনেমা নিয়ে নেয় টিজার, ট্রেলার না দেখেই শুধু শাকিব খান আছেন সেই ভরসায়। এরকম স্টারডম বিরল। 

‘রাজকুমার’ সিনেমায় শাকিব খান দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। তর্কসাপেক্ষে এখন পর্যন্ত তাঁর সেরা অভিনয়। অত্যন্ত মাপা এক্সপ্রেশন! শেষ দৃশ্যে তিনি তো কাব্যিক অভিনয় করেছেন। হাসি ও কান্নার মিশেলে অসাধারণ অভিব্যক্তিতে পর্দায় ম্যাজিক ক্রিয়েট করেছেন তিনি। তাঁর চোখ অভিনয় করে। একটি সিনেমার ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, প্রযোজক হলো বাবা আর পরিচালক মা! ‘রাজকুমার’-এর মতো বড় ক্যানভাসের সিনেমার জন্য একজন সিনেমাপ্রেমী ভিশনারি প্রডিউসার দরকার, যিনি পরিচালকের এরকম একটা বড় ভিশনকে সতত সমর্থন দিয়ে যাবেন। প্রডিউসার আরশাদ আদনান ইন্ডাস্ট্রির জন্য আশীর্বাদ।

পরিচালক হিমেল আশরাফ  ‘প্রিয়তমা’র মতো ইন্ডাস্ট্রি হিট দিয়েছেন । এরপরেই এতোসব লোকেশনে বড় আয়োজনের এই ‘রাজকুমার’ সিনেমা  ।একজন টেকনিশিয়ান হিসেবে বুঝতে পারি এই জার্নি একজন পরিচালক এর জন্য কতোটা চ্যালেন্জের । 

সুপারস্টারদের দিয়ে ফিল্ম বানানো এতো সহজ না । ভক্ত , দর্শক নানারকম চাপ থাকে । সফলভাবে এই  ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাক টু ব্যাক এমন দুটি সিনেমা দেয়ার জন্য হিমেল ভাই কে টুপি খোলা অভিনন্দন । 

‘রাজকুমার’ এ ক্লাইম্যাক্সে কোরান তেলাওয়াত এর অংশটা  দর্শক হিসেবে মন ছুঁয়ে গেছে । পরিচালক বুঝিয়েছেন তাঁর ম্যাচিওরিটি ও পরিমিতিবোধ  । দারুন ম্যাচিওর  ও ব্রিলিয়ান্ট ডিলিং উইদ দ্য ইমোশন। 

রাজকুমার একটি পুরোপুরি বাংলাদেশি  রুটেড সিনেমা । কারণ কোর লাইন অব দ্য ফিল্ম ইজ ভেরি ইনডিভিজুয়াল’স  বিলিফ । পরিচালক একটা  ভীষন আবেগের গল্প বলতে চেয়েছেন এবং তিনি পেরেছেন । একটা সার্বজনীন আবেগের বিষয় তিনি নিয়েছেন তাঁর সিনেমার বিষয়বস্তু হিসেবে । 

জীবন কি সিনেমার মতো নাকি সিনেমা জীবনের মতো এই প্রশ্ন আপনার মনে হবে কখোনো কখোনো কিন্তু সিনেমাটিক রিয়ালিটিকেও অস্বীকার করার উপায় নেই ! রাজকুমার সবার জন্য নির্মিত , পারিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মতো বাংলা সিনেমা ..

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা


 

আরও পড়ুন

×