ঈদের সিনেমার ভালোমন্দ
চারশ’ বছর আগের বাংলায় ভ্রমণ

ছবি: সংগৃহীত
সৈকত সালাহউদ্দিন
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ১৮:১২ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ২০:৩৭
‘কাজলরেখা’ দেখে মনে হলো ৪০০ বছর আগের বাংলায় ঘুরে এলাম। কাজলরেখা, সূচকুমার,কঙ্কনদাসী,শুকপাখি, বনবাস,শ্যামদেশের বাণিজ্যবন্দর– সব মিলিয়ে আমাদের রূপকথাকে একালে দেখে ভালো লেগেছে। ‘কাজলরেখা’ নিয়ে লিখতে গেলে সেসময়ের প্রেক্ষাপট জানা জরুরি। চারশ বছর আগে এই বাংলা ছিল মোগল আমলের ঐশ্বর্যেভরা একটি অংশ। ভাটি দেশে ছিলেন অনেক রাজন্য, যারা নানা অঞ্চল শাসন করতেন।
এই গল্পে সূচকুমার তেমনি একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের রাজকুমার, যিনি জন্ম থেকেই ঘুমিয়ে থাকেন। গল্পে আরও রয়েছেন ধনী বণিকের সন্তান ধনেশ্বর, যিনি জুয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। এরপর এক সাধু তাঁকে একটি ধর্মমতি শুকপাখি এবং আংটি দেন। শুকপাখির পরামর্শে তিনি আংটি বেঁচে সব ফিরে পান। কিন্তু এরপর তাঁকে শুকপাখি বলে তার কিশোরী মেয়েকে বনবাসে পাঠাতে, যেখানে মৃত রাজকুমার সূচকুমার আছে; যাঁর সঙ্গে মেয়ে কাজলরেখার বিয়ে নিয়তিতে লেখা রয়েছে। সিনেমার গল্প যারা জানেন, তারা প্রথম থেকেই আটকে যাবেন। যারা জানেন না, একটু সময় নেবেন। বনবাসে সূচকুমারের সন্ধান পেলে এক সাধু জানায়, যদি কাজলরেখা তার পরিচয় জানায়, তাহলে সূচকুমার আর কোনোদিন জাগবে না। সূচ ওঠানোর পর চোখে পাতার রস দিলে জেগে উঠবে কুমার। কিন্তু কাজলরেখা যখন স্নানে, তখন কঙ্কনদাসী চোখে রস দিয়ে কুমারকে জাগিয়ে তোলে। এরপর রাজা সূচকুমারের রানী হলো দাসী আর দাসী হলো রানী। এভাবেই এগিয়ে চলে গল্প।
শুকপাখি কাজলরেখার পরিচয় না দেওয়া পর্যন্ত কাজলরেখার ভাগ্যে নামে একের পর এক বিপর্যয়। দুই কাজলরেখার চরিত্রে সাদিয়া আয়মান আর মন্দিরা চক্রবর্তীর মধ্যে কে সেরা–তা নিয়ে ভাবতে হবে।তবে মন্দিরা চক্রবর্তী আমাদের বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন।তাঁর চোখ আর সৌন্দর্য অনেক জড়তা পুষিয়ে দিয়েছে। রাজকুমার ও পরবর্তী সময়ে রাজার চরিত্রে শরিফুল রাজকে ভালো লেগেছে। তিনি সব পাত্রে মানিয়ে যান। নকল রানী মিথিলা ছিলেন সিনেমার খল,সঙ্গে হিউমার। গ্রে শেডে ভালো করেছেন খায়রুল বাশার। তিনি সূচকুমারের বন্ধু এবং আরেক অঞ্চলের রাজা। নিয়তির নানা চরিত্রে আজাদ আবুল কালাম আর ধনেশ্বর বণিকের চরিত্রে ইরেশ যাকেরও দারুণ মানিয়ে গেছেন। সিনেমার গান আর সিনেমাটোগ্রাফি কানে আর চোখে ভারি আরাম দেয়। ‘কী কাম করিল সাধু’গানে চারশ' বছর আগের বাংলার ঐশ্বর্য একনজরে দেখা যায়। গানটি দারুণ সম্পদ আমাদের জন্য। ‘ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু’সহ অন্তত দুইডজন গানে এ সময়ের অন্যতম সেরা সংগীতশিল্পী ইমন চৌধুরী পর্দা মাতিয়ে রেখেছেন।
সিনেমাটোগ্রাফার কামরুল হাসান খসরু আর শিল্প নির্দেশক স্থপতি সাইফ উল হক বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন। একটি কথা না বললে শেষ হয়না; তা হলো গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সিগনেচার মুভি ‘কাজলরেখা’। তবে কাজলরেখা নিয়ে কিছু আক্ষেপ কাজ করে। যারা গল্প জানেন, পরিচালক তাদের কথাই ভেবেছেন। সূচকুমার কেন এই অবস্থায় পড়েছিল, বনেই বা তার কী হয়েছিল, সিনেমায় সে অংশ আসেনি। গল্পের রোমাঞ্চকর নাটকীয় কিছু মুহূর্ত ছিল, যা ডিটেইলস এবং আরও নাটকীয় করার সুযোগ ছিল। যেমন সূচকুমারের সূচ ওঠানো এবং তার প্রতি কঙ্কনদাসীর লোভ তৈরিতে আরও সময় দেওয়া উচিত ছিল। লোভ ধীরে ধীরে তৈরি হয় আসলে। রূপকথার এই চরিত্রগুলো নিয়ে পাঠক এবং দর্শকের অনেক আগ্রহ থাকে।
চরিত্রগুলো যখন পর্দায় আসে, তখন তাদের উপস্থাপনা আরও আকর্ষণীয় হতে পারতলার্জার দ্যান লাইফের মাধ্যমে। রূপকথার সিনেমাগুলো যখন নানাদেশে পর্দায় আসে, তখন বড়দের সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ও ছোটদের উপযোগী করতে একটি আলাদা লুক এবং ফিল দেওয়া হয়। হতে পারে বাজেট বিবেচনায় আমরা এ বিষয়গুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তবে এ কথা হলফ করে বলা যায়,‘কাজলরেখা’ একদম আমাদের সিনেমা। এজন্য পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম ও তার দলকে টুপিখোলা সালাম।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক
- বিষয় :
- ঈদের সিনেমা
- কাজলরেখা