এলআরবি ও আইয়ুব বাচ্চুর গান-গিটার সংরক্ষণে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে

আয়ুব বাচ্চু। ছবি:সংগৃহীত
রাসেল আজাদ বিদ্যু
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ২০:০০ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ২০:০৪
‘কিংবদন্তি’, ‘রক আইকন’, ‘সংগীত মহীরুহ’, ‘দেশসেরা রকস্টার’– আইয়ুব বাচ্চু নামের পাশে এমন অনেক বিশেষণ চোখে পড়ে; যা থেকে স্পষ্ট দেশীয় সংগীতে তাঁর অবদান কতটা। কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, গিটার শিল্পী– প্রতিটি পরিচয়ে তিনি ছিলেন অনন্য; তাঁর সৃষ্টি চিরকালীন। অনবদ্য সব সৃষ্টি কীভাবে অমর এই শিল্পীকে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছেন।
আজ কী আইয়ুব বাচ্চুর জন্মদিন? না। প্রয়াণ দিবসও নয়, কারণ সেই তারিখটা অনুরাগীদের সবারই জানা। এমনকি তাঁর ব্যান্ড এলআরবি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে দিনক্ষণও ভুলে যাননি অনেকে। তাহলে হঠাৎ আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে বিশেষ এই আয়োজন কেন? এই প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারেন। তবে প্রশ্ন করবেন বলে মনে হয় না। কারণ একটাই, আইয়ুব বাচ্চু সমসময় প্রাসঙ্গিক। ঠিক তাঁর গাওয়া গানের মতো; যেখানে তিনি অকপটে বলে গেছেন একটি সত্য– ‘আমি যাব চলে, দূরে বহুদূরে/ গান শুধু রবে, আমার স্মৃতি নিয়ে...’। তাই আইয়ুব বাচ্চুর অনবদ্য সৃষ্টি অনিন্দ্য গায়কী, শোণিতধারায় ঝড় বইয়ে দেওয়া গিটার বাদন নিয়ে অনুরাগীরা আলোচনায় মুখর হবেন; স্মৃতি রোমন্থনে ডুব দেবেন; মনে করিয়ে দেবেন, কীভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ ব্যান্ড তারকা; কেন তাঁর গানগুলো এখনও শ্রোতা মনে অনুরণন তুলে যাচ্ছে– এটাই স্বাভাবিক।
সমসাময়িক ব্যান্ডশিল্পী, সংগীতায়োজকদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ– তা নিয়ে অনেকে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তবু সিংহ ভাগ অনুরাগী স্বীকার করেন, আইয়ুব বাচ্চুর মতো কণ্ঠ ও গিটার শিল্পীর জন্য শতবর্ষে একবারই হয়; তিনি কিংবদন্তি, তাঁর তুলনা চলে শুধু তাঁর সঙ্গেই।
আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে– এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। তবু অনুযোগ, কেন অমর এই শিল্পীর একটি পূর্ণাঙ্গ প্লে লিস্ট তৈরি হলো না। যদিও অনলাইনে ‘আইয়ুব বাচ্চু: এবি কিচেন’ নামে একটি গানের প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, সেখানে তাঁর একক ও ব্যান্ড এলআরবির অ্যালবামের পাশাপাশি বিভিন্ন মিশ্র ও দ্বৈত অ্যালবামের গানগুলো শোনার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে সেখানেও তাঁর সৃষ্টির শতভাগ তুলে আনা যায়নি। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের উত্তরে আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনা বলেন, ‘এ প্রশ্ন অনেকের, যা থেকে স্পষ্ট আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি তাদের ভালোবাসা কত খানি। তাই চেষ্টা করে যাচ্ছি আইয়ুব বাচ্চুর সমস্ত সৃষ্টি আর্কাইভ করে রাখার। এ বিষয়ে এলআরবির আবদুল্লাহ মাসুদ, গীতিকার নিয়াজ আহমেদ অংশু, শিল্পী জুয়েল মোর্শেদ এবং শুভ সব রকম সহযোগিতার পাশাপাশি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কপিরাইট ইস্যু নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল। ব্যারিস্টার খালিদ হামিদ চৌধুরীর সহযোগিতায় তারও কিছুটা সমাধান হয়েছে। এ ছাড়াও ক্যাসেট, সিডির যুগে যেসব প্রকাশকরা আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবির অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন, তাদের সঙ্গে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ সবকিছুর পর শ্রোতাদের এই আশ্বাস দিতে পারি, আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন, শিগগিরই আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করব আমরা। ‘এবি কিচেন’ ইউটিউব চ্যানেলেই আইয়ুব বাচ্চুর সব অ্যালবাম ও গান শোনার সুযোগ পাবেন।’
শ্রোতাদের জন্য এটা খুশির খবর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও সেই কপিরাইট ইস্যু নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। আইয়ুব বাচ্চুর পরিবার কি আদৌ আইয়ুব বাচ্চুর গানের রয়্যালটি ঠিকভাবে পাবেন? নাকি তা নিয়ে আছে জটিলতা? সে প্রশ্ন ফেরদৌস আক্তার চন্দনা বলেন, রয়্যালটি নিয়ে যেসব জটিলতা ছিল, তা আমরা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। এ দেশের প্রেক্ষাপটে যতটা রয়্যালটি পাওয়া যায়, তা পাচ্ছি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি। রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরীর কথায়, আইয়ুব বাচ্চু নিজের নামে নিবন্ধন গানগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অধিকার কেবল তাঁর আইনগত উত্তরাধিকারীদের। অন্য শিল্পী বা দূরে থাকা এলআরবির অন্য সদস্যরা এ গানগুলো বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশন করতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে অ্যালবাম বা গানের রয়্যালটি কোনো জটিলতা তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই।
শুধু গান নয়, আইয়ুব বাচ্চুর গিটার থেকে শুরু করে নানান স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য গঠন করা হয়েছে ‘এবি ফাউন্ডেশন’। যাদের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের বৃহৎ বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকতা ও অভিনেতা ইরেশ যাকের বলেন, এবি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। যার মাধ্যমে স্মৃতি জাদুঘর থেকে শুরু করে আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে কনসার্ট ও সম্মাননা প্রদান এবং এই রক আইকনের ২০০টি গান প্রকাশের পাশাপাশি আর বেশ কিছু আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এ নিয়ে আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করব। আমাদের চাওয়া একটাই, আইয়ুব বাচ্চু যে ভালোবাসা দিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন, সেই ভালোবাসার দাবি পূরণের মধ্য দিয়ে তাঁকে চিরকাল মাঝে বাঁচিয়ে রাখা।’ ইরেশ যাকেরের মতো একই রকম ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চুর দুই সন্তান ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব ও আহনাফ তাযওয়ার আইয়ুব।
আইয়ুব বাচ্চুর সৃষ্টিকর্ম ও স্মৃতি সংরক্ষণের নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাঁর ব্যান্ড এলআরবি চিরকালের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে কিনা? এ প্রশ্নও বহুবার উঠে এসেছে। আইয়ুব বাচ্চুর প্রয়াণের পর দু’জন শিল্পীকে নিয়ে এলআরবি পারফর্ম করার ঘোষণাও দিয়েছিল; যা নিয়ে পরে আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারের সদস্যরা আপত্তি তুলেছিলেন। দর্শক-শ্রোতা থেকে শুরু গানের ভুবনের বাসিন্দারাও বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাহলে কী এলআরবি নামটা দেশীয় সংগীতের ইতিহাস হয়েই থাকবে? এ প্রশ্নের জবাবে এই ব্যান্ডের সাবেক সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো– আইয়ুব বাচ্চুকে ছাড়া এলআরবি পারফর্ম করে যাবে– এটা অনেকেই কল্পনা করতে চান না।
আইয়ুব বাচ্চু-এলআরবি দুটোই এক সুতোয় গাঁথা; যা কখনও আলাদা করা যাবে না। তবে এলআরবি শ্রোতা মনে ঠিকই বেঁচে থাকবে– এর কালজয়ী গানগুলোর কারণে। যুগ যুগ ধরে তাদের মনে অনুরণন তুলে যাবে ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ [চলো বদলে যাই], ‘রূপালী গিটার’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘মাধবী’, ‘বাংলাদেশ’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘হাসতে দেখ’, ‘নীল বেদনা’, ‘নীরবে’, ‘মন চাইলে মন পাবে’, ‘স্মৃতি নিয়ে’, ‘জন্মহীন নক্ষত্র’ অসংখ্য গান। একই সঙ্গে শ্রোতা হৃদয়ে বেঁচে থাকবে একক, মিশ্র অ্যালবাম ও প্লেব্যাকের জন্য গাওয়া ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘উড়াল দেব আকাশে’, ‘এক আকাশ তারা’, ‘মেয়ে’, ‘একা’, ‘এই জগৎ সংসারে’, ‘বাবা তোমায় মনে পড়ে’, ‘সময়’, ‘একটি সত্য’সহ আরও অসংখ্য কালজয়ী গান– যা তাঁকে অমর করে রেখেছে।
- বিষয় :
- আইয়ুব বাচ্চু