ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সিনেমা হল মালিকদের ঋণে ­অনীহা

কাজে এলো না হাজার কোটি টাকার তহবিল

কাজে এলো না হাজার কোটি টাকার তহবিল

ছবি: সংগৃহীত

অনিন্দ্য মামুন

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৪:৫৩ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৫:১১

কমতে শুরু করেছে সিনেমা হলের সংখ্যা। সিনেমা হল ভেঙে সেখানে নির্মিত হচ্ছে বহুতল কমপ্লেক্স। ফলে এক যুগ আগে সিনেমা হলের সংখ্যা প্রায় ৪০০ থাকলেও কভিডের পর তা নেমে এসেছে ৭০-৮০টিতে। এ অবস্থায় দেশীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি চাঙ্গা করার লক্ষ্যে আরও সিনেমা হল নির্মাণে উদ্যোগ নেয় বিগত সরকার। হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা চালু করে। এই তহবিল থেকে সিনেমা হল সংস্কার, আধুনিকায়ন ও নতুন হল নির্মাণে ঋণ নেওয়ার সুযোগ ছিল। তহবিলের আওতায় নতুন সিনেমা হল স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তাদের ১০ কোটি টাকা আর বিদ্যমান মালিকদের হল সংস্কারের জন্য পাঁচ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের সুযোগ ছিল। 

শপিংমলের মালিকরাও সিনেমা হল নির্মাণের জন্য এ ঋণ নিতে পারবেন বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছিল। ঋণের সুবিধাভোগীদের এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ আট বছরে ঋণ পরিশোধ করার কথা বলা হয়। এই ঋণের সুদের হার মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫ শতাংশ এবং তার বাইরে সাড়ে ৪ শতাংশ। কিন্তু এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ঋণ নিতে আগ্রহ দেখা যায়নি হল মালিকদের মধ্যে। ফলে ঋণ সুবিধার প্রায় চার বছর পর্যন্ত তহবিলের হাজার কোটি টাকা অলসভাবেই পড়ে ছিল। তবে ব্যাংক এর আগে জানায়, এই তহবিল থেকে শুধু ১৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। হল মালিকদের ঋণ নিতে সাড়া না পেয়ে ২০২২ সাল থেকে দুই দফা ঋণ নেওয়ার সময়সীমা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ ঋণের জন্য আবেদনের সময়সীমা ছিল গত ৩১ ডিসেম্বর। এ সময় পর্যন্ত মেলেনি তেমন সাড়া। পরে আর ঋণের নতুন করে কোনো সময়সীমা বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন আসেনি। এদিকে গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পর ঋণ তহবিলের জন্য যারা ঋণ আবেদন করেছিলেন, তারাও ঋণ পাবেন কিনা এবং এই হাজার কোটি টাকার তহবিল নিয়ে বর্তমান সরকার কী ভাবছে, সে বিষয়ে অন্ধকারে আছেন বলে জানিয়েছেন হল মালিক সমিতির নেতারা। তবে নতুন সরকারের সঙ্গে বসার চেষ্টা করছেন। চেষ্টা সফল হলেই ঋণের বিষয়ে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত জানতে পারবেন তারা। 

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে, হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল থেকে মাত্র তিনজন হল মালিক ১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। গণমাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা শিখা।

১৮ কোটি ঋণ পেয়েছেন যারা, সেখানেও ছিল ভোগান্তি

অনীহা থাকা সত্ত্বেও ইতোমধ্যে ১৮ কোটি টাকা ঋণ যে তিনজন পেয়েছেন, তারা হচ্ছেন রাজশাহীর গ্র্যান্ড রিভারভিউ সিনেপ্লেক্সের মালিক ইসফা খায়রুল হক। তিনি তিন কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। তা দিয়ে যন্ত্র কিনে সিনেপ্লেক্সে দুটি হলের মধ্যে একটি চালু করেছেন। বাকি একটি চালুর অপেক্ষায়। এই ঋণ সুবিধা নিতে বেশ ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের দুয়ারে ঘুরতে হয়েছে। অগ্রণী, পূবালীসহ অনেক ব্যাংকে ঘুরেছি; পাইনি। এক বছরের মতো ঘুরে মাত্র তিন কোটি টাকা ওয়ান ব্যাংক থেকে পেয়েছি। তিনি দুই হলের জন্য ১০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছিলেন। শো-মোশন লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ১৮ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। সেগুলো হলো ঢাকার সীমান্ত সম্ভার এবং চট্টগ্রাম ও বগুড়ার সিনেপ্লেক্স। এর মধ্যে  দুটি চালু করেছে, একটি নির্মাণাধীন। শিগগিরই চালু হবে বলেও জানিয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। 

ঋণ গ্রহণে যে কারণে অনীহা 

সহজ শর্ত, তুলনামূলক কম সুদ ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার পরও কেন ঋণে অনীহা ছিল সিনেমা হল মালিকদের? সমকাল হল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে সেই অনীহার কথা জানতে চেষ্টা করেছে। এ বিষয়ে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী হল ‘মধুমিতা’র কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বিস্তারিত বলেছেন। জানিয়েছেন, যেসব হল রয়েছে, সেগুলোরই তো যায় যায় অবস্থা। নতুন করে হল বানিয়ে সেখানে চালাবে কী? যে দেশে দুই ঈদ ছাড়া ভালো ছবি নির্মিত হয় না, ঈদ ছাড়া হলে দর্শক সিনেমা দেখতে আসেন না, সেখানে ঋণ করে সিনেমা হল বানালে আম-ছালা দুটোই যাবে। সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে, পাশাপাশি নির্দিষ্ট টাইমও দিয়েছে। এর মধ্যে টাকা শোধ করতে হবে। কিন্তু সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে না চললে এই টাকা ফেরত দেবে কীভাবে? টাকা পরিশোধ করতে না পারলে সিনেমা হলই তো সরকার নিয়ে যাবে। তখন আম-ছালা দুটোই যাবে। সে কারণে ঋণ নিচ্ছে না অনেকে। আর স্টার সিনেপ্লেক্স তো যে ঋণ নিয়ে হল বাড়িয়েছে, তারা তো হলিউডের সিনেমা চালায়। সেসব ছবি চালিয়ে তারা টাকা তুলতে পারে। আমাদের এসব হল তো কেবল বাংলা ছবিই চালায়। মাঝে হিন্দি ছবি আসত। সেগুলোও এখন বন্ধ। তাই ঋণ নিয়ে হল বানিয়ে মালিকরা কেবল পথে বসতেন। এসব কারণেই ঋণ নিতে তেমন সাড়া পড়েনি। 
ভিন্ন কথা বললেন হল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল। তাঁর ভাষ্যমতে, ঋণ নিতে যে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তা বেশ জটিল। এই জটিলতার কারণে অনেকের ঋণ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা পূরণ হচ্ছে না। তিনি বলেন, আসলে ঋণ নিতে চাচ্ছে অনেকে। কিন্তু কিছু নিয়মকানুনের জন্য পাচ্ছে না। আমার জানামতে, ঋণের জন্য অর্ধশত আবেদন জমা পড়েছে। তারা ঋণ পেলেও তো কত হল বাড়ত? আমি মনে করি, নিয়মকানুন একটু শিথিল করা হলে ঋণ অনেকে নেবে। হল মালিকদের সুবিধার্থে নিয়মকানুন একটু শিথিল করার অনুরোধ করছি। যেমন ধরুন, একজনের বাবার পাঁচ সন্তান থাকলে এখানে হল নির্মাণ করবেন একজন। কিন্তু পাঁচ ভাইয়েরই দলিল দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া আগে যার কাছ থেকে জমি কিনেছেন, তারও কাগজ জমা দিতে হচ্ছে। এসব কারণে অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং অনেকের কাগজ জমা পড়ে আছে।

 নতুন অনিশ্চয়তা
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিগত সরকারের পতনে হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। বর্তমান সরকার এই তহবিল রাখবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান হল মালিক সমিতি। ঋণ আবেদনের মেয়াদ শেষ হলেও তা আবার বাড়াবে কিনা, সে বিষয়ে কিছুই কেউ জানছেন না। যারা আবেদন করেছেন, তারা ঋণ পাবেন কিনা, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের সাথী সিনেমা হলের কর্ণধার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সহসভাপতি মিঞা মো. আলাউদ্দিন বলেন, আমার জানামতে, সিনেপ্লেক্স ছাড়া কোনো হল মালিক এখনও কোনো ঋণের সুবিধা পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে যে ঋণ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে অনেক শর্ত জুড়ে দেওয়া ছিল। 
সেসব শর্ত মেনে ঋণ নেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। যারা সেসব শর্ত মেনে ঋণের জন্য আবেদন করেছেন, তারাও সন্তোষজনক ফল পাননি। তাই সে অবস্থাতেই পড়ে ছিল টাকাগুলো। এখন তো মেয়াদ শেষ। এখন নতুন সরকার আবার মেয়াদ বাড়াবে কিনা; তার কি দৃষ্টিভঙ্গি, সেটি আমরা জানি না। সরকারের সঙ্গে আমাদের আলাপও হয়নি। তবে আমরা বসার চেষ্টা করছি। বসতে পারলে জানতে পারব।

বাংলাদেশ প্রদর্শক সমিতির প্রতিনিধিরা বলছেন, এ পর্যন্ত ৫২ জন হল মালিক ঋণের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন করেছেন। তারা ঋণ পাবেন কিনা, তার কিছুই জানেন না। তাই সবাই ঋণ পাওয়ার আশা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা। 

আরও পড়ুন

×