প্রচ্ছদ
ক্যামেরার কবি জেমস

জেমসের ক্যামেরায় [বাঁ থেকে] মডেল শিফা, জয়নব আলম জুঁই ও আফিয়া তাবাসসুম
রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০২১ | ০৫:২২
কম কথা বলা স্বভাব যার, তাকে হঠাৎ নানা বিষয়ের গল্পে মেতে উঠতে দেখলে অবাক হতেই হয়। জেমসের বেলায় আজকাল সেটাই দেখা যায়। তবে গিটার নয়, হাতে যখন ক্যামেরা থাকে ঠিক তখন। তার ছবির মডেলদের সঙ্গে এমনভাবে কথা শুরু করেন, যেন কত দিনের চেনা। তাই তো আমন্ত্রিত তারকাদের সঙ্গে মুহূর্তেই সম্পর্ক সহজ হয়ে যায়। মারিয়া নূরের কথা থেকে এই সত্যিটা নতুন করে জানা হলো। একই সঙ্গে তার কাছে জানা হলো জেমসের ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা। বললেন, 'জেমস ভাইকে আমি রাশভারি মানুষ হিসেবেই জানতাম। অন্তত ছবি তোলার আগ পর্যন্ত তার সম্পর্কে এটাই ছিল আমার ধারণা। কিন্তু এই ধারণা যে মিথ্যা- তা প্রমাণ হয়েছে যেদিন আমি তার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হই। তার স্টুডিওতে কেন আমার আগমন- সেটা যেন তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। শুরু হয়েছিল রাজ্যের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা। কথায় কথায় যে সম্পর্কটা কখন সহজ হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি। তাই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অনায়াসেই ছবির পোজ দিয়ে গেছি। এরপর যখন তার তোলা ছবিগুলো দেখেছি, তখন বিস্ময় আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই কোনোরকম রাখঢাক না রেখে জেমস ভাইকে বলেছি, আপনার ছবির প্রদর্শনী করা উচিত। যাতে সবাই জানে, আপনি শুধু বড় মাপের কণ্ঠশিল্পী নন, ফটোগ্রাফারদেরও একজন।' মারিয়া নূর জেমসের অনেক কনসার্ট আর লাইভ অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেছেন। সে সুবাদে কণ্ঠশিল্পী জেমসের পরিচয় পেয়েছেন। কিন্তু ছবি তুলতে গিয়ে যে আরেক জেমসের পরিচয় পাবেন- তা ধারণাও ছিল না। শুধু মারিয়া নূর নন, অভিনেত্রী ও মডেল জয়া আহসান, মিথিলা, সোহানা সাবা থেকে শুরু করে তরুণ মডেল জুঁই, আফিয়া, শিফাসহ জেমসের ছবির প্রত্যেক মডেলের মুখের শোনা গেছে মুগ্ধতার কথা। এখন তাই রকস্টারের পর জেমসকে ক্যামেরার কবি বলছেন অনেকে। নন্দিত অভিনেত্রী জয়া আহসানও 'ক্যামেরার কবি' হিসেবে জেমসের উপাধি যথার্থই বলে মনে করেন। কেননা অন্য সবার মতো জয়া নিজেও জেমসের ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত অনুমান করতে পারেননি, কেমন হবে তার ছবি। সেই ছবি প্রকাশের পর কেমন সাড়া পড়ে যাবে- সেটাও তার ধারণায় ছিল না। পরিচয়-বন্ধুত্ব ভালো লাগা প্রকাশে যে তিনরঙা গোলাপ দেওয়া হয়, সেটাই হয়ে উঠেছিল জেমসের ছবির উপকরণ। জয়ার হাতে ধরা তিনটি তিনরঙা গোলাপ, মায়াবী চাহনি যে ফ্রেমে জেমসে বন্দি করেছেন, তা মুগ্ধ করেছে অগণিত অনুরাগীকে। তাই তো জয়া আহসান নির্দি্বধায় স্বীকার করেছেন, 'সবাই যা দেখে না, জেমস ভাই তা দেখতে পান; যখন তার হতে থাকে ক্যামেরা।'

ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস নামের মানুষটিকে কয়েক দশক ধরে গানের টানে দেশ-বিদেশের মঞ্চে ছুটে যেতে দেখেছি আমরা। কিন্তু তার পরিবেশনার সঙ্গে শ্রোতার উন্মাতাল উচ্ছ্বাস, আনন্দ, চিৎকার, বারবার গান শোনার আহ্বান- এ দৃশ্যগুলোই প্রধান হয়ে উঠেছে, এটা ভাবলে ভুল হবে। কারণ, মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর জেমসের চোখে ধরা দিয়েছে বিশ্বের তাবৎ বিষয়। যেগুলো তিনি ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন তার ক্যামেরায়। তাই তো জেমসের ছবির তোলার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে মডেল, নাগরিক জীবন আর প্রকৃতি। কিন্তু তার ক্যামেরার চোখে এই বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে, নানা অবয়বে। যে জন্য তার ছবি নিয়ে আজকাল এতো আলোচনা আর প্রশংসাধ্বনি শুনতে পাই আমরা। অথচ কয়েক বছর আগেও আমরা তার এই সুপ্ত প্রতিভা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারিনি। নন্দিত সুরকার প্রিন্স তার একটি অ্যালবামের প্রচ্ছদে রেখেছিলেন কালো পোশাক পরা এবং দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে রাখা একটি ছবি। যার ফটোক্রেডিটে নাম ছিল জেমসের। তখনই মূলত জেমসের ছবির তোলার বিষয়টি নজরে আসে সবার। কিন্তু এরপর অনেক দিন তার তোলা ছবি চোখে পড়েনি। তাই আড়ালেই পড়ে থেকে গিয়েছিল নগর বাউলের ছবি তোলার শখের বিষয়টি। এও জানা হয়নি, কবে থেকে ছবি তোলার নেশা পেয়ে বসেছে জেমসকে। গানের ভুবনের কিছু মানুষ শুধু এটুকুই জানতেন, যারা শখের বশে ছবি তোলেন, জেমস তাদেরই একজন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সবার এ ধারণা বদলে যেতে শুরু করেছে। ছবিতে নিজস্বয়তার ছাপ। জেমস এমনভাবে রেখেছেন, যা তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সে কারণেই এখন অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা তার ক্যামেরার সামনে নিজেকে মেলে ধরার। অবাক করার বিষয় হলো, যার ছবি নিয়ে এখন এত আলোচনা, সেই জেমসও ছবি তোলার বিষয়টি শখের বিষয় হিসেবেই দেখেন। তাই তো প্রদর্শনীর বিষয়টি মাথায় আনেননি। হোক শখ, তারপরও কাজটা এখন ধারাবাহিকভাবেই করে যাচ্ছেন জেমস। সে হিসেবে ছবি তোলা যে তার নেশায় পরিণত হয়েছে- এটা ধরে নেওয়াই যায়। বিষয়টা সত্যি কিনা জানতে চাইলে জেমস নিজেও স্বীকার করেন, 'হ্যাঁ, ছবি তোলা এখন আমার নেশা বলা যায়।' ঠিক কবে থেকে এই নেশা আপনাকে পেয়ে বসল? এর উত্তরে, 'এটা তো আমি নিজেও জানি না। মনের মধ্যে অনেক ইচ্ছা লুকানো থাকে। সময় বুঝে তা জেগে ওঠে। ফটোগ্রাফির ইচ্ছাও হয়তো আগে থেকেই মনে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। নইলে এ কাজের প্রতি এত আকর্ষণ তৈরি হবে কেন? আর এখন তো যখনই সময় পাই ছবি তুলি।' জেমসের এই কথায় বোঝা যায়, আগে থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি দুর্বলতা ছিল। কিন্তু এই বাসনা কত দিনের, তা নিজেও জানেন না। তাই যখনই মনে হয়েছে, মনের লুকানো ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব, তখনই হাতে তুলে নিয়েছে ক্যামেরা।

জেমসের ক্যামেরার মানুষ আর প্রকৃতিকে আমরা নতুনভাবে দেখতে পাচ্ছি। গানেও যা ছিল সব সময়। ফটোশিল্পী জেমসের ব্যস্ততা বেড়ে গেলে গানে তার প্রভাব পড়বে কিনা? সে প্রশ্ন করতেই জেমস বলেন, 'গান বাদ দিলে তো আমার আমিকে খুঁজে পাব না। দীর্ঘ পথের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছি সুরের টানে। তাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমার এই কণ্ঠশিল্পী পরিচয়।' তার মুখে এ কথা শুনে ভক্তরা যে খুশি হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক দিন যে তার নতুন গান প্রকাশ পায়নি, নতুন গানের সেই খড়া কবে কাটবে? এ উত্তরে জেমস বলেন, 'যত শিগগির সম্ভব নতুন গান অবশ্যই প্রকাশ করব। কিন্তু কবে, তার দিন-তারিখ এখনই বলতে পারছি না।' গান প্রকাশ নয়, করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আবার তাকে কনসার্টে দেখা যাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে টানা এক বছর কোনো শোতে অংশ নেননি। বিরতি ভেঙে আবার যখন কনসার্টে ফিরছিলেন, তখনই আবার হানা দিয়েছে করোনা। তাই দর্শক-শ্রোতার স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবেই আবার বিরতি নিয়েছেন। তিনি বলেন, 'জীবনের জন্য গান, তাই জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে আনন্দে মেতে ওঠা যায় না। কনসার্টে বিরতি নেওয়ার আগে সবাইকে এটাই বলেছি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক থাকুন, দেখা অবশ্যই হবে, শুধু দুঃসময় কেটে যাওয়ার অপেক্ষা।' তার এ কথায় একজন শিল্পীর পাশাপাশি মানবিক জেমসের পরিচয় উঠে আসে। জীবনের বাহির আর গহিনকে যিনি গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন নানা সময়, তার মুখে এমন কথা প্রত্যাশিত ছিল অনেকের। জেমসের বিশ্বাস, সমগ্র বিশ্ব আর জীবনকে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা বারবারই উঠে এসেছে ক্যামেরা আর গিটারে। হয়তো সে কারণেই তার ক্যামেরার চোখ আর সাত সুরের বাঁধা গানগুলো জীবনের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে নানা সময়। এখন তাই আরও কিছু সময়ের অপেক্ষা, যখন ফ্রেমে ফ্রেমে বাঁধা তার ছবিগুলোর পাশাপাশি পাওয়া যাবে সাত সুরের নতুন আয়োজন।