ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

লালনের গান আমার আত্মার খোরাক: ফরিদা পারভীন

লালনের গান আমার আত্মার খোরাক: ফরিদা পারভীন

কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন

এমদাদুল হক মিলটন

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২০ | ০১:৪১

নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। লালন সাঁইয়ের গান তিনি পৌঁছে দেন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। সেই সুবাদে পেয়েছেন অগণিত সংগীতপ্রেমীর ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে পুঁজি করে গানে গানে তিনি পেরিয়েছেন পাঁচ দশকের পথ। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও শিল্পীজীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে-

শিল্পীজীবনের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। কেমন ছিল পাঁচ দশকের এই দীর্ঘ পথচলা?

কতশত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এই দীর্ঘ সময় কেটেছে, তা এক কথায় বলে বোঝানো যাবে না! ১৯৬৮ সালে সংগীত ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল। এরপর পেরুতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। পারিবারিক সূত্রেই গানের ভুবনে আসা। গানের প্রতি বাবার ভক্তি ছিল প্রগাঢ়। দাদিও গান করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে আমাকে। শৈশবে যখন মাগুরায় ছিলাম, তখন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয়। এরপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তালিম থেকে দূরে থাকিনি। নানা ধরনের গান করলেও শিল্পীজীবনে পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, অগণিত মানুষের ভালোবাসা মূলত লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। যখন থেকে লালনের গান গাওয়া শুরু হয়েছিল, তারপর আর তা থেমে থাকেনি। আজ গাইছি এবং লালনের গান আমার আত্মার খোরাক হয়ে উঠেছে। তার গান গাইতে গাইতে কখন যে সংগীতে ৫০ বছরের দীর্ঘপথ পেরিয়ে এসেছি, বুঝতেই পাইনি। এ জন্য সবসময় ফকির লালন সাঁইকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এবং প্রতিনিয়ত তার গানের চর্চা ধরে রাখার চেষ্টা করি। এ জন্য ৫০ বছর পরেও সংগীত ভুবনে পথচলার সময়টা মনে হয় পাঁচ বছরের। তাই এখনও শিখছি।

৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি আয়োজনও ছিল-

হ্যাঁ, ১৯৬৮ সালে আমার যাত্রা শুরু। সেই হিসাবে ৫১ বছর হয়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মঞ্চে আমার সংগীতে ৫০ বছর পূর্তি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করেছে লালন রিসার্চ অ্যান্ড কালচারাল ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা স্মারক দেওয়া হয়েছে আমাকে। সংগীতজীবন নিয়ে আলোচনা, একক সংগীতানুষ্ঠানও হয়েছে। আমাকে নিয়ে এর আগে কেউ এমন উদ্যোগ নেয়নি। এটি আমার জন্য একটি বড় পাওয়া। এ আয়োজনের জন্য সংগঠনটির নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ৩১ ডিসেম্বর আমার ৬৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। তার আগের দিন আমার সংগীতে ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ভালোই লেগেছে।

শুরুতে নজরুলসংগীত, পরে আধুনিক গান দিয়ে আপনার যাত্রা শুরু। কিন্তু ক্যারিয়ারের ৯০ শতাংশ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

এটা হয়েছে নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে। কুষ্টিয়ায় স্থানীয় এক হোমিও ডাক্তার আমার গানের বেশ মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। কিন্তু কেন জানি, তিনি আমার কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে চাইতেন। তার মনে হতো, লালনের গান আমার কণ্ঠে বেশি ভালো লাগবে। তাই হঠাৎ করেই আমাকে একদিন লালন ফকিরের গান শেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু শুরুতে লালনের গান গাইতে চাইনি। আমার এই অনীহা দেখে বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে গান শেখার জন্য রাজি করান। বলেন, ভালো না লাগলে গাইবি না। এই শর্তে রাজি হই এবং লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করি। 'সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন'- লালনের ওই বিখ্যাত গানটি শিখি। একই বছর দোলপূর্ণিমা উৎসবে এ গানটি গাইলে শ্রোতারা আমাকে লালনের আরও একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন। তখন আমি গান গাইতে অসম্মতি জানাই। শ্রোতাদের বলি, আমি একটি গান গাইতে শিখেছি। এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই। এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তার গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এ পর্যায়ে অনুভব করি, লালন তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।

সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক স্মরণীয় স্মৃতি আছে। বিশেষ কোনো ঘটনার কথা বলবেন?

১৯৭৩ সাল। বিভিন্ন আখড়া থেকে বাউল শিল্পীদের ঢাকায় এনে লালনের গান রেকর্ডের পরিকল্পনা করেন ওস্তাদ মকছেদ আলী সাঁই। তিনি তৎকালীন রেডিওর ট্রান্সক্রিপশনে কর্মরত ছিলেন। তার আমন্ত্রণে ঢাকায় রেডিওতে আসি। এ সময় স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন আবদুল হামিদ চৌধুরী, কমল দাশগুপ্ত, সমর দাস, কাদের জমিলির মতো বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞরা। খুব ভয় হয়েছিল। তাদের সামনে আমাকে গাইতে হলো। ১৫ মিনিটের একক সংগীতানুষ্ঠান করে তাদের প্রশংসা পেয়েছিলাম। এটিই আমার অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি।

লালনের কোন দিকটি আপনি বেশি ধারণ করেন?

লালন দর্শনের মূল কথা- মানুষকে মানুষ হয়ে চলার দর্শন। মানুষকে মানুষ হয়ে চলার অর্থ মনুষ্যত্বগুণে গুণী হওয়া। এ জন্য তিনি সর্বদা সত্য বলা এবং সুপথে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। এটাই আমি মনেপ্রাণে ধারণ করি।

ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশনের কাজ কেমন চলছে?

বাঙালি সংস্কৃতির মানবিকতাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটাতে ফাউন্ডেশনটি তৈরি করেছি। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নানামুখী কর্মকাণ্ড ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে লালন সাঁইয়ের গানের শুদ্ধ উচ্চারণ ও স্বরলিপি তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ২৫টি লালনগীতির স্বরলিপি বই আকারে প্রকাশ করেছি। কিছুদিনের মধ্যে আরও ২৫টি গানের স্বরলিপি বই আকারে প্রকাশ করব। এর নাম দিয়েছি 'অচিন পাখি দ্বিতীয় খণ্ড'। এ ছাড়া আমার কাছে লালন শাহের অসংখ্য প্রকাশিত গান ও সিডি রয়েছে। এগুলো নিয়ে লালন সংগ্রহশালা তৈরি করেছি, যা রক্ষণাবেক্ষণ করছে ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনটি শুধু লালনের গান সংরক্ষণ কিংবা প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রাচীন লোকজ গান সংরক্ষণ, শিক্ষা ও উন্নয়নমুখী নানা কাজে ফাউন্ডেশনের সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে গরিব বাউলদের পাশে থাকবে সংগঠনটি।

লালনের গান নিয়ে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা ফিউশন করছেন। এ ধরনের গানের কি শুদ্ধতা থাকছে?

অনেকে এখন না বুঝেই লালনের গান করছে। এতে ফিউশনের নামে তারা কনফিউশন করছে। টিভি চ্যানেলগুলো তাদের গান হরহামেশাই প্রচার করছে। এ বিষয়ে চ্যালেনওয়ালাদের আরও যত্নবান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের উদ্দেশে কী বলবেন?

সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। লালনের বাণী হলো, মূলত লালনের কালাম। লালনের আখড়ার ভাবশিষ্যরা অন্তত তাই ভেবে থাকেন। লালনের গানে রয়েছে আধ্যাত্মিকতা। লালনসংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। লালনসংগীতের বাণী মাহাত্ম্য লোকসুর তথা বাউল সুরের ঐন্দ্রজালিক আবেগ সুমধুর কণ্ঠের আবেগময় পরিবেশনার মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। লোকসংগীতর মৌল ধর্ম হচ্ছে আঞ্চলিক পরিভাষা। লালনের সব সৃষ্টির মধ্যেই কুষ্টিয়া জেলার আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই যিনি লালনসংগীত পরিবেশন করবেন তাকে উচ্চারণের বিষয়ে জোর দিতে হবে। লালনসংগীত বাউল শ্রেণির লোকসংগীত। কাজেই লোকগীতির আঞ্চলিক ধর্ম সম্পর্কে সজাগ থেকেই লালনসংগীত পরিবেশন করতে হবে। লালনগীতি গাইতে হলে আত্মনিবেদন করতে হয়।

সংগীতজীবনের সেরা অজর্ন কী?

কাজের জন্য জীবনে 'একুশে পদক', জাপানে 'ফুকওয়াকা' পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছি। এর চেয়ে বড় অর্জন হলো মানুষের ভালোবাসা। মানুষের ভালোবাসার ডানায় ভর করে আমি আজীবন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি।

আরও পড়ুন

×