ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বইয়ের ভুবন

ইতিহাসের পথ ধরে নতুনের সন্ধানে

ইতিহাসের পথ ধরে নতুনের সন্ধানে

সভ্যতার উষাকাল গিলগামেশের মহাকাব্য, লেখক-রইসউদ্দিন আরিফ, প্রকাশক-পাঠক সমাবেশ, প্রচ্ছদ-আনিসুজ্জামান সোহেল, মূল্য-৪৯৫ টাকা

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২ | ১২:০০

রইসউদ্দিন আরিফ একজন চিন্তাশীল গবেষক। তিনি লিখেন বাস্তব অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞানের আলোকে। তার চিন্তার সঙ্গে একমত হতেই হবে, এমন নয়। তবে তার বই মানেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সম্মুখীন হওয়া। 'সভ্যতার উষাকাল : গিলগামেশের মহাকাব্য' বইটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বইটি প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ।
আলোচ্য বইটি প্রবন্ধের সংকলন; কিন্তু গতানুগতিক কোনো প্রবন্ধ এখানে স্থান পায়নি। প্রতিটি প্রবন্ধের আলাদা ধারাবাহিকতা রয়েছে। মানুষের চিন্তা ও ভালোবাসা থেকে উৎসারিত চেতনা, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, সমাজচিন্তা ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে প্রবন্ধগুলো লেখা। একটি যুগের সভ্যতার মূল্যায়ন করা হয়েছে প্রবন্ধগুলোতে। যা একজন চিন্তাশীল পাঠককে আরও সমৃদ্ধ করতে সক্ষম।
প্রায় ছয় হাজার বছর আগের সুমের ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতাকে মূলত সভ্যতার উষাকাল বলা হয়ে থাকে। সভ্যতার সেই উষাকাল থেকে আজকের আধুনিক সভ্যতা পর্যন্ত বিভিন্ন কালের সভ্যতার একটি ধারাবাহিক চিত্রায়ণ করা হয়েছে বইটিতে।
আটটি প্রবন্ধ নিয়ে বইটির সূচিক্রম সাজানো হয়েছে। প্রবন্ধগুলো যথাক্রমে- 'সভ্যতার উষাকালের বিস্ময় : গিলগামেশের মহাকাব্য', 'বিজ্ঞানী ও মানুষ আইনস্টাইন কেমন ছিলেন', 'প্রাচীন সেমিটিক ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত', 'মৌলবাদ : এক বিকল্প প্রস্তাব', 'সাম্প্র্রদায়িকতা নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ', 'এনলাইটেনমেন্ট যুগে যুগে', 'সমাজতন্ত্র : ইতিহাসের আদি বাস্তবতা' এবং 'বাংলাদেশে ডারউইন চর্চায় বাধা'।
গিলগামেশের মহাকাব্য বহু সাহিত্য, শিল্প এবং সংগীত সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই গিলগামেশের মহাকাব্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটি বিভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে।
'পৃথিবীকে আমি গিলগামেশের কথা শোনাব। যিনি সব জানতেন, চিনতেন পৃথিবীর সব রাজ্য। জ্ঞানী ছিলেন তিনি। মুখোমুখি হয়েছিলেন রহস্যের, জানতেন অনেক গোপন কথা। মহাপ্লাবনের পূর্বের দিনগুলোর কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন। দীর্ঘ এক যাত্রায় বেরোন তিনি। পরিশ্রান্ত, অবসন্ন দেহে ফেরার পর বিশ্রাম করেন। তারপর পুরো গল্পটি লিখে রাখেন পাথরখণ্ডে।' -দ্য এপিক অব গিলগামেশ, ইংরেজি অনুবাদ : এন. কে. স্যান্ডার্স (পেঙ্গুইন বুকস, ১৯৭২); পৃ. ৬১
বইটির নাম থেকেই আঁচ করা যায় এর বিস্তৃতি। মহাকাব্যের অর্থই একটি সভ্যতা। যে সভ্যতায় থাকবে সমাজের জীবনদর্শন, মানবিকতা, রাষ্ট্রীয় বা কাঠামোগত বাস্তবতা। মানুষ মূলত প্রতিনিয়ত সভ্যতার দ্বারস্থ হয়, সভ্যতাই মানুষকে শেখায়। যে কারণে এই মূল্যবান বইটি মানব-ইতিহাসের জন্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বহন করছে।
'সভ্যতার উষাকালের বিস্ময় : গিলগামেশের মহাকাব্য' প্রবন্ধে গিলগামেশের জীবনের দর্শন ও আকাঙ্ক্ষা, দুর্নিবার অতৃপ্ত বাসনার চিত্র উপলব্ধি করা যায়। খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় এই দর্শন, অতৃপ্ত বাসনা এবং যন্ত্রণাই তাকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
একই সঙ্গে প্রবন্ধটি পড়ে গিলগামেশের উদ্দামতা, উন্মত্ততা ও ঔদ্ধত্যের চিত্রও বোঝা যায়; যা পাঠককে ভাবিত এবং চিন্তিত করে তুলবে। তিনি একদিকে স্নেহধন্য পিতৃহীন সন্তানকে প্রভূত পরিমাণ প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছেন, অন্যদিকে আবার পুত্রকে নিয়ে পোষণ করেছেন এক প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা- তাবৎ প্রাণী, অপদেবতা, দানব, ভূত, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ সবই তার বশ্যতায় নতজানু হবে- এমন প্রত্যাশাও করেছেন। এ রকম দ্বিচারিক চরিত্রকে পাঠক কীভাবে নেবেন, সে সিদ্ধান্ত পাঠকের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হলো।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ 'সাম্প্র্রদায়িকতা নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ'। প্রবন্ধটি পড়লে সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ, নিপীড়ন এবং দ্বন্দ্ব-কলহ বা সংঘাতের বিষয়টি অনেকটা পরিস্কারভাবে বোঝা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সাম্প্র্রদায়িকতার বিষবাষ্প বলতে শুধু যে ধর্মীয় সাম্প্র্রদায়িকতা বোঝানো হয়, তা নয়- লেখক সেটি পরিস্কার করেছেন। জাতিগত, ভাষাগত, নৃতত্ত্বগত এবং গোষ্ঠীগত সাম্প্র্রদায়িকতাও যে একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে, সেটিই লেখক প্রবন্ধটিতে তুলে ধরেছেন।
একজন ইতিহাসপ্রেমিক পাঠকের জন্য প্রবন্ধটি নিশ্চিতভাবেই চিন্তার খোরাক জোগাবে। ভাবিত করে তুলতে পারে ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের দায়হীনতা এবং রাজনৈতিক নোংরামির ইতিহাস।
'সমাজতন্ত্র :মানবসমাজের আদি বাস্তবতা' অধ্যায়টিতে লেখক মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির আদলে নিজের চিন্তা তুলে ধরেছেন। তবে সে দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট। এ অধ্যায়ে 'সমাজতন্ত্রের পুনঃপাঠ' অংশে লেখক যে কথাগুলো বলেছেন, তা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং ইতিহাসসমৃদ্ধ। আবার তিনি যেভাবে সমাজতন্ত্র ও মার্ক্সবাদের প্রতি মানুষের অনাগ্রহের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটি নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা সমাজ বিকাশের ইতিহাস থেকেই উপলব্ধি করা যায়- কোনো সমাজে গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হয়ে সমাজতন্ত্র গড়ে ওঠে, আবার অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় সেই সমাজ সমাজতন্ত্র থেকে পিছিয়েও আসতে পারে। তার মানে কোনো সমাজ সমাজতন্ত্র থেকে সরে এলেই 'সমাজতন্ত্রের পতন হয়ে গেছে', এমনটি বলা যায় না। মার্ক্সবাদের দুই নির্মাতা কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেদরিখ এঙ্গেলস তাদের মতবাদিক অবস্থানে সে কথাই বলে গেছেন। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট নয় বলেই মনে হয়েছে।
এ রকম একটি জমজমাট রাজনৈতিক বই পাঠ করে তার সম্পর্কে সীমিত পরিসরে লেখা সত্যিই দুঃসাধ্য কাজ। তবে একজন পাঠক হিসেবে এমন বইয়ের মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। যা নতুনের সন্ধান করার তাগিদ দেয়। পরিশেষে বলা যায়, জ্ঞানই সেই শক্তি, যা দিয়ে মানুষ শত শৃঙ্খলেও মুক্ত থাকতে পারে। যা দিয়ে মানুষের একতা, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও শান্তির সমাজ নির্মাণ সম্ভব।

আরও পড়ুন

×