উদ্ভাবনই এখন কৃষির বড় ভরসা

ফাইল ছবি
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২২ | ২৩:২২
দেশের কৃষি খাতে নিত্যনতুন উদ্ভাবন হচ্ছে। নতুন উদ্ভাবনে বাড়ছে উৎপাদন। সহজ হচ্ছে চাষ পদ্ধতি। সনাতনী পদ্ধতি থেকে সরে এসে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, নানামুখী কৌশলে রোগবালাই দমন, কৃত্রিম উপায়ে শাকসবজি ও মাছ চাষ, ছাদকৃষিসহ নানা উদ্ভাবনে বদলে যাচ্ছে কৃষি খাত।
কৃষিক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে এ দেশের কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনা ও বিস্তর গবেষণা। গবেষকরা বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষুষ্ণ শস্য ও ফলের জাত উদ্ভাবন, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নানামুখী জাত উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে খাদ্য উৎপাদনে অভাবিত সাফল্যের পথে শুধু খাদ্যশস্যই নয়, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছও এসেছে খাবারের প্লেটে। গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষিবিদরা। আনছেন দ্রুত উৎপাদনশীল নানা ফসল ও মাছ। খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় বড় ভরসার জায়গা কৃষিতে নানা উদ্ভাবন।
ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) অগ্রগামী। এ ছাড়া সামগ্রিক কৃষি উদ্ভাবনে কাজ করছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ময়মনসিংহ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়ানো এবং হারিয়ে যাওয়া মাছ ফেরত আনতে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। উদ্ভাবনে পিছিয়ে নেই বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। তবে উদ্ভাবিত জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া জলবায়ুসহিষুষ্ণ জাত উদ্ভাবনে বরাদ্দ বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তারা।
১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশে তখন খাদ্য সংকট ছিল তীব্র। এমন বাস্তবতাকে সামনে রেখে মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ, পরিবেশ উপযোগী আধুনিক এবং লাগসই ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্য নিয়ে ব্রি (বিআরআরআই-বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট) কাজ শুরু করে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ সাফল্যের একটি বড় অবদান রয়েছে ব্রির। ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০৬ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে এ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সাতটি হাইব্রিড ও ৯৯টি ইনব্রিড। ব্রির কার্যালয়গুলোতে ৩০৮ জন বিজ্ঞানী কাজ করছেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত ১৩ বছরে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর প্রতিটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্যম্পন্ন। এর মধ্যে রয়েছে খরা, বন্যা, লবণসহিষুষ্ণ, জিঙ্কসমৃদ্ধ, ডায়াবেটিস রাইসসহ অধিক উচ্চফলনশীল ধান। পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ব্রি এখন পর্যন্ত ১২টি লবণ, তিনটি খরা, তিনটি বন্যা, দুটি জোয়ার ও তিনটি শীতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছে। উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল একটি জাত নিয়ে বর্তমানে গবেষণা হচ্ছে।
১৯৬১ সাল থেকে দক্ষ কৃষিবিদ তৈরি করছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষুষ্ণ শস্য ও ফলের জাত উদ্ভাবন, নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নানামুখী জাত উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের পথচলায় এসেছে বহু সাফল্য। ইলিশ ও সিলভার কার্প মাছের স্যুপ ও নুডলস তৈরির প্রযুক্তি, শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধানচাষের প্রযুক্তি, হিমায়িত ভ্রূণ থেকে ভেড়ার কৃত্রিম প্রজনন, ভাগনা মাছের জাত উন্নয়ন, ডেঙ্গু ভাইরাসের সিরোটাইপ নির্ণয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এ ছাড়া বাউকুল, ধান, সরিষা, সয়াবিন, আলু, মুখীকচুর বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়।
তারাবাইন, গুচিবাইন, বড় বাইন, কুঁচিয়া, গাঙমাগুর, কই ও বাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিও আবিস্কার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ প্রযুক্তি, কচি গমের পাউডার উৎপাদন, বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার আবিস্কৃত হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব সার উৎপাদনের প্রযুক্তি, মাটি পরীক্ষার সরঞ্জাম, মাছের রোগ প্রতিরোধকল্পে ঔষধি গাছের ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। সাড়ে ১১ হাজার ফল ও মসলার প্রজাতি নিয়ে এখনকার জার্মপ্লাজম সেন্টার পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এ সেন্টার থেকে শতাধিক নতুন ফলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৩ সালে সেন্টারটি বঙ্গবন্ধু কৃষিপদক পেয়েছে।
নতুন জাত উদ্ভাবনে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। বিনার গবেষকরা এ পর্যন্ত ১৮টি ফসলের উচ্চফলনশীল ১১৯টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। বেশিরভাগই কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও তিন শতাধিক জাত নিয়ে গবেষণা চলছে। এসব জাত আগামী তিন বছরের মধ্যে জাতীয় বীজ বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া সাপেক্ষে উন্মুক্ত করার পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা বিলুপ্তপ্রায় ৩১ প্রজাতির দেশীয় মাছ চাষযোগ্য করতে পেরেছেন। এর মধ্যে ১৯ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ সারাদেশে চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফসলের ৩০৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ৩৬৩টি। ধান বাদে অন্য সব ধরনের ফসল নিয়ে গবেষণা করা এই সংস্থা বর্তমানে ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা করছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কৃষি গবেষণার ১২টি প্রতিষ্ঠানের কাজ সমন্বয় করে। ১২ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত সাত শতাধিক ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন। কৃষিকাজ সহজ করতে এক হাজার ৩০০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন তারা। এসব কারণে গত বছর স্বাধীনতা পদক পেয়েছে বিএআরসি।
গবেষণায় বরাদ্দ অপ্রতুল :খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের (এফপিএমইউ) 'মনিটরিং রিপোর্ট অব দ্য বাংলাদেশ সেকেন্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান-২০১৯' প্রতিবেদনে কৃষি গবেষণায় অপ্রতুল বরাদ্দের বিষয়টি উঠে এসেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সিস্টেমভুক্ত (নার্স) গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। পরের অর্থবছরে এ বরাদ্দ কমে দাঁড়ায় ৪৭ কোটি টাকা। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ বরাদ্দ কিছুটা বেড়ে হয় ৬৮৮ কোটি টাকা। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এটিকে যথেষ্ট বলে মনে করেন না সংশ্নিষ্টরা। একই সঙ্গে উদ্ভাবনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, সেটিও বিশ্নেষণে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে বিএআরসির সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান কৃষিবিদ ড. ওয়ায়েস কবীর বলেন, কৃষি খাতে গবেষণায় যেমন বরাদ্দ কম, তেমনি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সক্ষমতার অভাব রয়েছে। জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সেগুলোর সম্প্রসারণের পাশাপাশি কৃষিতে আসা নতুন প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা হচ্ছে না। শস্য বহুমুখিতার অভাব, হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, পানি ও জমি সংকট এবং উন্নত উপকরণ বিশেষ করে বীজ ও সারের অভাব রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার মাধ্যমে আগামীতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ সার্বিক কৃষির উন্নয়নে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণায় বরাদ্দ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি গবেষণার অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি গবেষক তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে।
নয়া কৃষি আন্দোলনের সংগঠক ফরিদা আক্তার বলেন, গবেষকদের কৃষকের ভালোমন্দ বুঝতে হবে। কোম্পানির স্বার্থ ও নিজের খ্যাতি দেখলেই হবে না। দেশের আবহাওয়া ও কৃষকের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাত উদ্ভাবনের প্রতি বিজ্ঞানীদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।