দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদকরা সংকটে

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২২ | ২৩:৩৯
কৃষি খাতে এক সময় ভারী যন্ত্র বলতে ছিল শুধু ট্রাক্টর। দিনে দিনে চিত্র বদলে গেছে। কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রতিবছর বাড়ছে। আমদানি করা কৃষিযন্ত্রের পাশাপাশি জনপ্রিয় হচ্ছে দেশীয় যন্ত্রও। তবে সম্ভাবনা থাকার পরও দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর যন্ত্র উদ্ভাবনে অগ্রগতি হচ্ছে ধীরগতিতে। ফলে কৃষিযন্ত্রের বাজারের বিশাল অংশ এখনও আমদানিনির্ভর।
কৃষিযন্ত্রের আমদানিকারক ও স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের হিসাবে বর্তমানে এর বাজার ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার। যার মধ্যে স্থানীয় উৎপাদকরা প্রায় পাঁচশ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির জোগান দিচ্ছেন। বাকিটা আমদানিনির্ভর। সরকারি হিসাবে এ বাজার ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
তবে স্থানীয় উৎপাদকরা নানা সংকটে রয়েছেন। তাদের জন্য সরকারি সহায়তা তেমন নেই। তারা কৃষিযন্ত্র তৈরিতে ভর্তুকি চান। সেজন্য একটি নীতিমালা তৈরির দাবিও তাদের। একই সঙ্গে খাতটির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা, প্রচলিত ঋণের সুদহার কমানো ও দেশেই যেসব যন্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব, সেগুলো আমদানি বন্ধ করার দাবিও জানানো হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানসহ এ খাতের বিকাশে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে বলেও মনে করেন একাধিক উদ্যোক্তা। তারা বলেন, তাহলেই সম্ভাবনাময় এ শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন কৃষকরা। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করা সম্ভব।
দেশে জাপানি ও চীনা কৃষিযন্ত্র বাজারজাত করছে চার-পাঁচটি কোম্পানি। পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র তৈরির কারখানা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানিও। এর মধ্যে জাপানের ইয়ানমার ও ভারতের মাহিন্দ্র অ্যান্ড মাহিন্দ্র শিগগির কারখানা নির্মাণ শুরু করবে বলে জানা গেছে।
কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারীদের সংগঠন এগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বেসরকারি পর্যায়ে ছোট-বড় মিলে দেশে প্রায় ৭০ প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরি ও সংযোজনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মাঝারি ও বড় কারখানা ১০ থেকে ১২টি। সংগঠনের সভাপতি আলীমুল এহছান চৌধুরী বলেন, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের জন্যও বর্তমানে মুনাফার ওপর ৩০ শতাংশ কর বিদ্যমান আছে। এ কর কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার দাবি তাদের। এ খাতে সুদমুক্ত দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে হবে। কৃষিভিত্তিক হালকা প্রকৌশল শিল্পে ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদে কম সুদে ঋণ প্রয়োজন। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি তৈরির কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সেজন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে কাঁচামালের বাজার নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। যখন তারা কোনো একটি টেন্ডারে অংশ নেন, তখন যে দাম ধরা হয়, পরে তা বেড়ে যায়। এতে তারা ক্ষতির মুখে পড়েন। তিনি আরও বলেন, কোনো একটি যন্ত্র নষ্ট হলে তার মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত ও দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। সেজন্য কারিগরি সহায়তা খুবই দরকারি। এ ছাড়া যেসব যন্ত্র দেশে তৈরি করা সম্ভব এবং সক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে, সেসব কৃষিযন্ত্র যেন দেশের বাইরে থেকে আমদানি না করা হয়, তার জন্য নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফসল লাগানোর আগে জমি তৈরির ক্ষেত্রে। পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ জমিতে। কারণ এ যন্ত্র দামি ও ভারী। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা-নেওয়া বড় সমস্যা। এ ছাড়া ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা প্রচুর ওয়ার্কশপ না থাকা, দক্ষ চালক না পাওয়া ইত্যাদি এ যন্ত্রের বাজার প্রসারে বড় সমস্যা।
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মাঠ পর্যায়ে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মো. মঞ্জুরুল আলমের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ছোট-বড় প্রায় ৮০০ কারখানা এখন বারি ও ব্রির মডেলে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছে। এ ছাড়া ৭০টি ফাউন্ডারি, প্রায় দেড় হাজার যন্ত্রাংশ তৈরি কারখানা ও প্রায় ২০ হাজার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কারখানা এ কাজে জড়িত।
যশোরের শিল্পী মেটাল ফাউন্ড্রির সামসুল আলম স্বপন বলেন, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য দেশে শিল্প পার্ক নেই। শিল্প পার্ক প্রয়োজন। খাতটির উন্নয়নে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। লোহার সংকটে অনেক ওয়ার্কশপ এখন বন্ধ। এদের বাঁচিয়ে রাখতে সহজশর্তে ঋণ প্রয়োজন।