কর্মজীবী নারী
আর্থিক সিদ্ধান্ত কি নিতে পারেন?

বাসন্তি সাহা
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২২ | ০২:৩০
অদ্ভুত এক আঁধারে যখন ঢেকে যাচ্ছে দেশ, তখন যশোরের শেখহাটির মেয়েরা যেন একদল জোনাকি। গ্রামে গ্রামে আলো ফেরি করে বেড়াচ্ছে। নববর্ষ আয়োজন নিয়ে যখন অনেক বিভ্রান্তি তখন মেয়েরা দেখিয়ে দিল উদযাপন কী করে এত সুন্দর আর আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় হয়।
এখানে আগুন জ্বালিয়ে শুনতে হয় জীবনের গল্প। ঢাকা শহরে যে মোমেনা, শারমীন, আলপনারা [ছদ্মনাম] বাসাবাড়িতে বা পোশাক কারখানায় কাজ করতে আসে, তাদের কথা বলছিলাম। ওদের গল্পগুলো আমি প্রথম দিকে শুনতাম। কারও বিয়ে হয়েছে বারো বছরে। তারপর তিনটি সন্তান নিয়ে ঢাকায় কাজ করতে এসেছে। ছোট মেয়েটাকে গ্যারেজে বা বাথরুমের সামনে বসিয়ে রেখে কাজ করেছে। ভাতটুকু বাচ্চাদের দিয়ে ভাতের মাড় খেয়ে কেটেছে দিনের পর দিন। কারও স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে, আবার কেউ স্বামীর সঙ্গেই থাকে ঢাকার একটি বস্তিতে। বাচ্চা দুটোকে রেখে এসেছে মায়ের কাছে। দিনের বেলা বাচ্চাদের কথাগুলো ফোনে রেকর্ড করে রাখে। রাতের বেলা সেই কথা শুনতে শুনতে ঘুমায়।
জীবনের পরতে পরতে বঞ্চনা। জীবন, মানুষ এই দেশ কোনো ভালো কিছু কখনও দেয়নি ওদের। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে যে মা হাত পাতে তার দিকে তাকাতে সাহস করি না, দূর থেকে কয়েকটা টাকা বাড়িয়ে দিই কখনও। নিজের বাচ্চার জন্য ব্যাগভর্তি খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরি। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ হয়েছে চার দশকের বেশি সময় ধরে। নারীরা এখন অনেক বেশি স্বাধীন।
নিজেরা রোজগার করেন। সব খাতেই নারী তার সক্ষমতা দেখাচ্ছেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে, গণিতে, চিকিৎসায়, প্রশাসনে, দেশ রক্ষায় কোথায় নেই নারী। সংসারেরও পুরো দায়িত্ব নেন কেউ কেউ। নারীর জীবনজুড়ে আছে এমন সাফেল্যের কাহিনি। তবে? শুধুই কি আলো? অন্ধকার কি নেই কোথাও? আছে। আছে পিতৃতন্ত্রের আগ্রাসী অন্ধকার। যে ব্যবস্থায় নারী সক্রিয় নয়, তাকে পুরুষের বিধিবিধানই মেনে চলতে হবে। পিতৃতন্ত্রের অধীনে নারীর পায়ে যে সহস্র বছরের বেড়ি তা থেকে নারীরা আজও মুক্ত নন।
বাইরের জগতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে। মাঝে মাঝেই আশাপূর্ণা দেবীর 'প্রথম প্রতিশ্রুতি'র সত্যবতীকে চুপ করে চিলেকোঠার কোণায় বসে থাকতে দেখি। সুবর্ণলতাকে দেখি দিন রাতের সব কাজের শেষ করে কুপিবাতি জ্বালিয়ে পত্রিকা পড়তে আর বকুলকে দেখি দুই বেণি দুলিয়ে কলেজে যেতে। বাল্যবিয়ে থেকে কলেজে যেতে তিনটি প্রজন্ম লেগেছিল। কিন্তু সত্যবতী, সুবর্ণলতা, বকুলরা আজও হারিয়ে যাননি। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ওরা বারবার ঘুরেফিরে আসে।
ঘরের ভেতর পর্দার আড়ালে নারী আসতে পেরেছেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায়? তার নিজের অর্থ নিজের মতো করে ব্যবহার করার জায়গায়? এখানে সব চুপ। এখানে কোনো কথা চলে না। যারা আধুনিক নারী সুবেশী, হোয়াইট কলার জব করেন, তারা একদম মুখ খুলবেন না এ বিষয়ে। কিন্তু মোমেনারা অকপট। 'বলেন টাকা যা পাই সবটা জানাই না। জানালে সবই তুলে দিতে হবে তার হাতে। তাই বলি দুই বাসায় কাজ করি। আর একটা বাসার কথা তারে বলি নাই।'
কিন্তু নাফিসা হক বা তাপসী রায়ের [ছদ্মনাম] সে সুযোগ নেই। স্বামীর পদবি গ্রহণ করেছেন। জব করছেন। ব্যাংকের স্টেটমেন্ট স্বামীকে দিতে হয় প্রতি মাসে। এক বাড়ির কাজ গোপন রাখার কোনো সুযোগ নেই। বলছি না সবাই এমন। কিন্তু এখানে সব চুপ। ফেসবুকে হাসিমুখের ছবি দিয়ে সাজানো জীবন। সেখানে জীবন কখনও দিগন্তজোড়া বিস্তৃত সবুজ হাতছানি, আবার কখনও দূরের আকাশের উদ্দাম মেঘ। সেখানে নিজের এই অসম্মান নিয়ে একদম কথা বলা চলে না। নারীর এই জায়গার যুদ্ধটা সামষ্টিক হয়ে
উঠতে পারে না কখনও। এই যুদ্ধটা নারীর নিজের একার লড়াই। দু-একজন বলেছেন, প্রতিদিনের চিৎকার অশান্তির চেয়ে টাকাটা তার হাতে তুলে দেওয়াই ভালো। তবে যখন রিকশা ভাড়াটা, নিজের ওষুধ কেনার টাকাটা চেয়ে নিতে হয় বা ব্যাংকের স্টেটমেন্ট দেখে বলে এত টাকা কোথায় গেল? তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। তখন একদিকে পড়ে থাকে ঘন নীল মেঘে ঢাকা আকাশের হাতছানি, আরেকদিকে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। মানিয়ে নিতে হয়।
আপাত চকচকে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প অনেক বেশি উঠে আসছে। নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো নারী অ্যাকটিভিস্ট কি কমে আসছে? নাকি ভালো অবস্থানে কাজ করা মেয়েরা দিনের শেষে পার্টিতে কেমন সাজ হবে, সেটা নিয়ে বেশি ভাবছেন? জানি না। নিজেদের অধিকার আদায়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীর মিছিল ছোট হয়ে আসছে না? তেভাগা আন্দোলনের ইলা মিত্র বা টংক আন্দোলনের কুমুদিনী হাজংয়ের নাম কেউ জানে? অরুন্ধতী রায় বা সুলতানা কামালের মতো মানুষ কি তৈরি হচ্ছে নতুন করে? নাকি দেখতে পাচ্ছি না। কোথাও হয়তো জ্বলে ওঠার জন্য সলতে পাকানো হচ্ছে, জ্বলে উঠবে একদিন আগ্নেয়গিরির মতো।
সময় পাল্টেছে পৃথিবীজুড়ে। পুরো পৃথিবীটাই এখন বাজার আর মানুষ হচ্ছেন কেবল ক্রেতা। পুরোই সিস্টেমটাই বাণিজ্য। সেখানে নারীর অধিকার আদায়ের সামষ্টিক আন্দোলনগুলোকে করপোরেট মোড়কে রূপ দেওয়া হয়। নারী দিবসে পার্লারে ছাড় দেওয়া হয়। আয়োজন করা হয় মিস ভর্তা প্রতিযোগিতার। অথচ যে নারীরা নারীর শ্রমঘণ্টা আট ঘণ্টা করা, মজুরি বৈষম্য কমানোর দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে এসেছিল ৮ মার্চ। তারা হারিয়ে গেছেন বেগুনি শাড়ি আর কেক কাটার উৎসবে।
প্রশ্নও আসছে নারীর জন্য আলাদা দিবস কেন দরকার?
নারী নিজের অর্জিত আয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা নারীর প্রতি জেন্ডারবেজড ভায়োলেন্স কি কমেছে, না বেড়েছে? কেবল নারী বা মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করার কারণে কন্যা ভ্রূণ হত্যা থেকে শুরু করে ধর্ষণ, এমনকি নারী শরীরের পণ্যায়ন কি কমেছে? নারীর নিরাপত্তাহীনতাও তো বেড়েছে। বাল্যবিয়ে কমেনি। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কি সবটাই ইতিবাচক? নাকি নতুন করে নারীর ওপর সুন্দর হয়ে ওঠার এক 'ভয়ংকর শোষণ' তৈরি হয়েছে? নারী নিজেও কি এই সামাজিক ক্ষত নিরাময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে? যাবতীয় মেকআপের পণ্য আর মোটা না হওয়ার জন্য কথা বলছে? তা তো নয়। নিম্নবর্গের নারীর এখনও সেই একই দাবি ন্যায্য মজুরি, আট ঘণ্টার শ্রম আর নিজের অর্জিত আয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তাহলে নারীর আন্দোলনের জায়গা কমেনি বরং বেড়েছে।
নারীর অধিকার আদায়ে যে নারীই বারবার একাই যুদ্ধ করেছে, তা কিন্তু নয়। বহু পুরুষের সহমর্মিতার হাত ছিল, আছে সেখানে তবু নারীর সংবিধানে প্রাপ্ত অধিকার অর্জিত হয়নি। নারী কেবল অর্ধেকটুকু অর্জন করছে। এগিয়ে যাচ্ছে সংবিধানের দেওয়া নারী-পুরুষের সাম্যের ভাবনাকে মাটিতে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। নারী কাজে অংশগ্রহণ, নিজের ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অর্ধেক নয় পুরোর লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, দর্পণ, ঢাকা
- বিষয় :
- কর্মজীবী নারী
- আর্থিক সিদ্ধান্ত
- নারী অধিকার