প্রচ্ছদ
হয়তো এক নিমগ্ন আনুভূমিক অন্তরঙ্গতার বাসনা

মানস চৌধুরী
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২২ | ১২:০০
আপনারা বিশ্বাস করুন যে এটা নিছকই কাকতাল। আমার গত কয়েকটা রচনাতে রবীন্দ্রনাথ এসে উপস্থিত হওয়া একেবারেই কাকতাল; এটা আমার রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার কোনো ইচ্ছা থেকে ঘটেনি। আমি এটাও ভাবার চেষ্টা করেছি যে, বার্ধক্যকালে যেসব ভক্তিরস অধিক হারে মাথায় জড়ো হতে থাকতে পারে বলে লোকে আশঙ্কা করেন, সেসব রসের মধ্যে অপেক্ষাকৃত 'সেক্যুলারমর্মি' হিসেবে রবীন্দ্রনাথ গেড়ে বসবার চেষ্টা করে থাকতে পারেন কিনা। পাছে আপনারা নিন্দা করেন, তাই তার আগে আমি নিজেই আমার এহেন আচরণের একটা চুলচেরা বিশ্নেষণ করে নিয়েছি। আসলে এ রকম বার্ধক্যপীড়িত কোনো ভক্তিভাবেও এই সংযোগ দেখা সম্ভব নয়। বরং, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মশগুল ছিলাম আমি কৈশোরকালে। রীতিমতো মশগুল। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাঁর সম্পর্কে ক্রিয়েটিভ-কালচারাল যুবক-যুবতীদের দু'চারটা বেহুদা প্রপাগান্ডা না শুনতাম তাহলে হয়তো, বলা যায় না, আমৃত্যুই ওই মশগুলদশাই আমার কপালে লেখা ছিল। সেসব তরুণ-তরুণী দাবি করতেন যে, রবীন্দ্রনাথ না এলে এই মুল্লুকে নাকি 'প্রেমের অভিব্যক্তি' করাই দুরূহ, এমনকি অসম্ভব, হয়ে যেত। পরে দেখলাম এসব পাতলা প্রচারধর্মী ভক্তিমূলক কথাবার্তা জাতীয় পর্যায়ের বড় বড় মানুষও আকছার বলে থাকেন। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার সম্পর্ককে আরো পদ্ধতিগত বানানোর সুযোগ পাই এসব সস্তা নিরর্থক কথাবার্তা থেকেই। তারপরও আজ 'অপেক্ষা'-সংক্রান্ত একখানা রচনা লিখতে বসে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে না-ভেবে পারিনি। তিনি হয়তো তুল্যবিচারে অধিক পছন্দ করতেন 'প্রতীক্ষা'। তবে বেকেটের নাটকটি অনুবাদ করতে গিয়ে কবীর চৌধুরীও 'গডোর প্রতীক্ষায়' লিখেছেন। আমি ভেবে দেখেছি 'গডোর অপেক্ষায়' বললেও খুব গুরুতর মনোভাব বদল আমার হতো না।
এ কথা বললে সাহিত্যবোদ্ধারা আমাকে মারতে আসতে না চাইতে পারেন, তবে সাহিত্যরাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে পারেন যে, স্যামুয়েল বেকেটের গডোর প্রতীক্ষায় আর রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুভূতির অভিন্ন জমি পাই। সোজা ভাষায় বললে, মিল পাই। সাহিত্যবোদ্ধারা সাথে সাথে সম্ভবত এই দুইয়ের পটভূমির ভিন্নতা তো বলবেনই, সাথে আরো বোঝানোর চেষ্টা করতে পারেন যে রূপকধর্মী নাটকের সাথে বাস্তবতাবাদ-বিরুদ্ধ উদ্ভটতা/অযৌক্তিকতার দর্শনের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতেও সচেষ্ট হবেন। তবে অতটা কষ্ট কেউ না করলেও এই দুই নাটকের পটভূমি খোদ যথেষ্ট এগুলোকে আলাদা রাখার জন্য। এই দুই নাটকের অন্বেষণের পাটাতন হচ্ছে যথাক্রমে নগর-শিল্পায়নজাত বিযুক্তিবোধ ও নিরর্থকতার বোধ এবং সমাজ বা কৌমনির্ভর সংশ্নেষ ও আত্মাবিস্কারের তাগিদ। তারপরও গডো এবং রাজার জন্য অপেক্ষা করতে থাকার মধ্যে একটা গুণগত মিল আমি পাই। এই আকাঙ্ক্ষার ব্যাকরণ, অভীপ্সা, ক্ষরণ, বাসনা, পরিশ্রান্তি, অবসাদ, উন্মুখতা, উন্মূলতার অনেকগুলো সমরূপতা আছে বলে আমি অনুভব করি। তবে বেকেট আর রবীন্দ্রনাথকে মেলাতে বসাও আজকের মুখ্য প্রতিপাদ্য নয় আমার। এটাও একটা আলাপ প্রাসঙ্গিক সম্প্রসারণ মাত্র। অপেক্ষার প্রসঙ্গে বেকেটের মাস্টারপিসটা মনে পড়া অপ্রাসঙ্গিক নয়, সেই অর্থেই এটা নিয়ে কথা বলা মাত্র। বরং, আজকে আলাপে রবীন্দ্রনাথের নাটকে মনোনিবেশটা আমার তরফে ইচ্ছাকৃত। কখনো আরাম করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আস্ত একটা অভিসন্দর্ভ লিখে ফেলব সেই অপেক্ষায় না থেকে বরং আজকের অপেক্ষা-বিষয়ক আলাপে রবীন্দ্রনাথকে টেনে এনে তাঁর নাটক নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের ভাবাভাবিকে একটা মৃদু আনুষ্ঠানিক অভিব্যক্তি দেবার সুযোগ নিচ্ছি।
আমি কমবেশি কয়েকটা জায়গাতেই উল্লেখ করেছি যে নাটক-রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলাপ-সালাপ যাই হয়ে থাকুক, সেসবের যতটাই আমার চোখে পড়ুক না কেন, তাঁর নাটক-বিষয়ক আলাপ-আলোচনা বিচার-বিশ্নেষণে আমার মনে বিশেষ রেখাপাত করতে পারেনি। আরো অশান্তি হয়েছে এই যে, যা ও যতটা আমার অলস-পাঠক জীবনেও চোখে পড়েছে, তাতে রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি-দর্শন আলোচিত হয়েছে মুখ্যত তাঁর প্রবন্ধকে ঘিরে আর তাঁর নাটক আলোচিত হয়েছে আরেকটা জমিনে, বা চূড়ান্ত বিচারে ঘেরাটোপে। বিদ্যাজগৎ এই অর্থে খুবই অদ্ভুত ধরনের। এখানে সিরিয়াস-ভাবগম্ভীর আলাপ করার জন্য যদি কোনো রচয়িতার প্রবন্ধ ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দেয়া হয় তাহলে কোনো দোষ ধরার সুযোগ কম। কিন্তু আমার বেশ একদর্শী মনে হয়। আমি খুব স্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনীতি ও জনপ্রশাসন দর্শনকে বুঝবার জন্য তাঁর নাটকগুলোর দিকে গভীর মনোযোগ দেয়া দরকার। তাতে তাঁর রাজ(নীতি)ভাবনার আমি গুণগ্রাহী, নাকি শর্তসাপেক্ষে সীমিত পরিসরে রসগ্রাহী, নাকি নিছকই জিজ্ঞাসু বিশ্নেষক তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ। আমি তাঁর নাটকগুলোর বিষয়ে অতিশয় আগ্রহী। এখানে গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য আর খালি-নাট্য সব একত্রেই বললাম। সেখানকার জনপদ, মনুষ্যসম্পর্ক, প্রশাসন যন্ত্রের সাথে জনপদের মানুষের টানাপড়েন আর সম্মিলন, শাস্তিপ্রবণ ঐশী কাঠামো, আবার তার বিপরীতে ধর্মের মনুষ্যলগ্ন বিস্তার, রাজ-অবয়বের প্রতিরুদ্ধ সব চিত্রপ্রণালি, জন-কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্বকারী লৌকিক সম্মিলনমুখী আত্মদর্শনধারী এক নেতা (প্রায়শই দাদাঠাকুর বা ঠাকুরদা হিসেবে)- সব মিলে রবীন্দ্রনাথ নানাবিধ ভাবনা-অনুষঙ্গ বিস্তার করে থাকেন তাঁর নাট্যসৃষ্টিতে। কিছু প্রায় পৌরাণিক দূরত্বময় রূপক, কিংবা কল্প-ইতিহাসের পটভূমিকে পাঠক হিসেবে মানিয়ে নিতে পারলে এগুলোকে নানান চিন্তাসূত্রের ডিব্বা হিসেবে আমি দেখতে পাই।
কিছু নাটক অবশ্যই আমার অন্যগুলোর থেকে অধিক প্রিয়, নানান কারণে- বিসর্জন, রাজা, মায়ার খেলা, তাসের দেশ এবং ভেবে বললে আরো কয়েকটা। এর মধ্যে মায়ার খেলা-কে মনোযৌনজ উপলব্ধির কারণে এবং বাকি তিনটাকে রাজনীতি-জনপ্রশাসন বিষয়ে উপলব্ধির কারণে আমি অতিশয় গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ফলে বিস্ময়ের না যে, বহুদিন পর যখন ঢাকার মঞ্চে রাজা পুনর্ব্যাখ্যাসমেত হাজির করার ঘোষণা নিয়ে একটা থিয়েটার দল প্রযোজনা করে, সম্ভবত ২০০৮ সালে, আমি খুবই আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গেছিলাম। সেই আশায় গুড়ে-বালি হয়েছিল অবশ্য। নির্মাতাগণ বৈশ্বিক রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণে তালগোল পাকানো এক খিচুড়ি উপহার দিয়েছিলেন। সম্ভবত, এই দুর্ঘট ঘটেছিল দুইটা স্পষ্ট কারণে প্রথমত, সেক্যুলারবাদের আত্ম-অবয়বের কাছে প্রশ্নাতীত আত্মসমর্পণের কারণে, দ্বিতীয়ত বিশ্ব-মোড়লদের শাসনপ্রণালি বিষয়ে নিমরাজি ধরনের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে। নাটকটি কিছু সমালোচিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং ভ্রান্ত, কারণে বলে আমি মনে করি। রক্ষণশীল বয়স্ক থিয়েটারকর্মীরা এর প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে গাঁইগুঁই করেছিলেন। বস্তুত, সেগুলো আমার কোনো আপত্তির জায়গাই ছিল না। আমার ছিল রাজাকে বুঝতে পারার সমস্যা নিয়ে; রাজাকে সমকালীন রাজনীতিতে পক্ষ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্মাতাপক্ষে ভুল-পথে পরিচালন বিষয়ে। এই উদাহরণটা আচমকা আনিনি। অপেক্ষার কালে নিবাস করতে-করতে আমরা কী দেখব বলে যাই, কী শুনব বলে যাই; কিংবা আমরা কোন সম্মিলনবাণী শোনাতে চেয়ে সমবেত হই এসবের মীমাংসা করার জন্য এই কাজটাও একটা দারুণ উদাহরণ। এখানে রবীন্দ্রনাথ জড়িত, তাঁর রাজ্যদর্শন জড়িত, মহানগরের সেক্যুলার-পীড়িত সাংস্কৃতিক কর্মীরা জড়িত, একটা সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা জড়িত, বিশ্ব-মোড়লের কর্তৃত্বাবসানের অপেক্ষা জড়িত। আমার জন্য আরো এক মাত্রা বিশেষ ছিল এই কারণে যে, নাটকটি আমার রবীন্দ্র-রাজনীতি দর্শনের সবচেয়ে প্রগাঢ় কাজগুলোর একটি বলে মনে হয়। তবে এই সুযোগে বরং এর বছর কুড়ি আগের এক ঘটনা উল্লেখ করি। ঘটনাটি ঢাকার বিস্মৃতিপরায়ণ মধ্যবিত্ত পাঠকের জন্য আরেকটা মজাদার, অথচ অ-নথিভুক্ত, উদাহরণ হবে।
তখনো এরশাদ কাল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক জমিনের জন্য এক মহাকালই প্রায়। যদ্দুর মনে পড়ে, সেটা রাষ্ট্রধর্ম বিল প্রকাশের পরের সময় কিংবা কাছাকাছি সময়। তার মানে 'নাগরিক সংহতি' নামে বহুপক্ষীয় ও বহু-সংগঠনীয় একটা মোর্চাও তাহলে গঠিত হয়ে গেছে। কিংবা, এতদিন পরে আর মনে নেই, গঠিত হবো-হবো করছে। অনেকেরই মনে থাকবে (আশা করি), এই 'নাগরিক সংহতি' নতুন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের রূপরেখা বানানোর কাজ শুরু করেছিল। বস্তুত, পরের এরশাদবিরোধী নাগরিক স্রোতের বড় কারিগর হিসেবে একে দেখাই ঠিক হবে। এরকম একটা প্রেক্ষাপটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় পর্বের নিম্ন স্নাতক শিক্ষার্থী হিসেবে কান কথায় জানতে পারি যে, ঢাকাতে 'রবীন্দ্ররাজ্য' বলে কিছু একটা গঠিত হচ্ছে, বা হতে চলেছে, বা হয়ে পড়েছে। সামান্য যা পত্রপত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল আমার তাতে কিছুতেই এটাকে জন-ঘটনা হিসেবে দেখা গেল না। তার মানে, যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তাহলে এটা যথাসম্ভব গুপ্ত একটা তৎপরতাই ছিল। এখন সমস্যা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে এ রকম একটা আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন নিয়ে উত্তেজিত হতেন কিনা আমার পক্ষে বলা কঠিন। কিন্তু ওই বয়সের রবীন্দ্রপ্রেমে আমি উত্তেজিত কম হয়েছিলাম, কৌতূহলী বেশি হয়েছিলাম। এই 'রাজ্যের' সংগঠক থাকার গুরুতর দাবিদার বলে মনে করতাম এমন একজন ক্যাম্পাসীয় বয়োজ্যেষ্ঠকে ভালো মতো পাকড়াও করে জানতে চাইলাম। তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা বড় সামাজিক সুবিধা ছিল এই যে, কোনো কিছু আড়ালে রাখার জন্য যতটা কঠোর হতে হয়, ততটা তিনি কোনো দিনই ছিলেন না। অন্তত আমি মনে করতাম না। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর অসংযত দু-চারটা বাক্য থেকেই আমি প্রথম আন্দাজ করতে পারি এই ঘটনা সম্বন্ধে। তাঁকে ভালেমতো ধরবার পরে, আমি গোপন রাখব এই শর্তে, তিনি জানালেন ঢাকার কিছু রবীন্দ্রভক্ত (বটেই!) মানুষজন ও সংগঠন একটা রবীন্দ্ররাজ্যের রূপরেখা বানিয়েছেন। এমনকি তাঁরা একটা সংবিধান প্রণয়নের প্রাথমিক কাজবাজও করে ফেলেছেন। বলাই বাহুল্য, এটাকে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক গঠনের প্রতি কোনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখার কোনোই কারণ নাই। বরং, এটা ছিল 'সু' আর 'মঙ্গল'-সংক্রান্ত এই লোকগুলোর দুঃশাসনের মধ্যে থাকার বাস্তবতায় একটা জানালার মতো 'সাংস্কৃতিক' কর্মকাণ্ড। রবীন্দ্রভক্ত সংগঠনসমূহ আন্দাজ করতেও আমার অনেক কষ্ট করতে হয়নি। বয়োজ্যেষ্ঠ সেই সংগঠকের মুখে 'গোপন' এই তৎপরতা জানার পর আমি জিজ্ঞাসা না-করে পারিনি : 'কিন্তু এ রকম হাসিহীন লোকদের সাথে রবীন্দ্রনাথ নিজে কি থাকতে চাইতেন?' বা কাছাকাছি কিছু। আমার ভক্তির অভাবে এতক্ষণ ধরে তাঁদের তৎপরতা বিশদ করার কারণে তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন বিলক্ষণ। সম্ভবত সংগঠনটির কোনো কাণ্ড বা জ্ঞান জনসমাজে আর বিকশিত হয়নি। অন্তত আমি কোনো লক্ষণ পাইনি। এটা হয়তো বিরল সেসব সংগঠন, যা দুই তিন সভার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে থাকে।
এই এত বছর বাদে, আপাত তুচ্ছ এই ঘটনাটাও আমি স্মরণ করি কিছু জিজ্ঞাসাকে বিস্তার ঘটাতে গিয়ে। কেন একজন রবীন্দ্রনাথ বিশালাকায় আইকন হবার পরও খণ্ডীকৃতভাবে সেবনকৃত হয়ে থাকেন? কেন জাতীয়তাবাদের ক্রিটিক রবীন্দ্রনাথ ভাষা-জাতীয়তাবাদের আইকন হিসেবে পর্যবসিত হন? কেন তাঁর লোকসমাজ-জনসমাজের উপলব্ধিকে পাশ কাটিয়ে আধ্যাত্ম আর নন্দনের বেখাপ্পা জিনিসগুলোকে নগর-সেবকেরা গ্রহণ করে থাকেন? কেন রবীন্দ্রনাথ কনজ্যুমড হন তাঁর লাস্য ও রঙ্গময়তাকে সম্পূর্ণ বিবর্জিত অবস্থায়? কোন মনজিলের জন্য এসব ভদ্রাত্মা অপেক্ষা করে থাকেন যেখানে রবীন্দ্রনাথকে কাস্টমাইজ করে নিজেদের মতো করে বানিয়ে নেন তাঁরা? এভাবে বানিয়ে নিতে হয় তাঁদের ঠিক কোন ধরনের শাসনপ্রণালির প্রতি বশ্যতার কারণে?
রাজা নাটকে সাধারণ বশ্যতাকামী জনগণ অপেক্ষা করে থাকেন উৎসবে কখন রাজা আসবেন। বসন্ত উৎসব! বসন্ত নামে সম্পূর্ণ আরেকটা গীতিনাট্য রবীন্দ্রনাথের। মাপে অনেকটা ছোট এবং বছর ১০-১২ পরে রচনা করা। কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গীকৃত এই কাজটা তাঁঁর খুবই ভিন্ন। সেখানেও নানাবিধ সম্মিলনী আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু রাজকার্যবিষয়ক মীমাংসার দিক থেকে সেটা ঠিক তুলনীয় জায়গায় আমি রাখব না। তো, রাজা নাটকে সেসব বশ্যতাকামী জনগণ রাজাকে জন-পরিসরে না দেখার অস্বস্তি আর অস্থিরতা প্রকাশ করতে থাকেন। নাগরিক দলের ভাষ্য হচ্ছে- 'সকল দেশেই রাজাকে দেখে দেশসুদ্ধ লোকের আত্মাপুরুষ বাঁশপাতার মতো হি হি করে কাঁপতে থাকে, আর আমাদেরই রাজাকে দেখা যায় না কেন। কিছু না হোক, একবার যদি চোখ পাকিয়ে বলে 'বেটার শির লেও' তা হলেও যে বুঝি রাজা বলে একটা-কিছু আছে।' এই ভীতিপ্রদ 'রাজা'র অপেক্ষা করতে থাকা সাধারণ জনারণ্যে কোনো ঐচ্ছিক দশা নয়; আধুনিক রাষ্ট্রের বনিয়াদ ভাবলে, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ভাবলে, এটা বরং এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা, হকিকত আমাদের। ভীতিপ্রদ রাজত্বের অপেক্ষা করতে থাকি আমরা। কিন্তু ঠাকুরদা কী বলেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, ঠাকুরদাই সেই লৌকিক কণ্ঠস্বর যিনি রাজপ্রণালির ব্যাকরণ সম্যক বোঝেনই না কেবল, বরং তিনি অনায়াসে সেই ব্যাকরণের মধ্যে কারকের জায়গায় 'নাগরিক'কে স্থাপন করতে পারেন। তিনি, তাঁর সমরূপ প্রতিনিধি, রবীন্দ্রনাথে একদম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন একটার পর একটা নাটকে। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, 'আমাদের দেশে রাজা এক জায়গায় দেখা দেয় না বলেই তো সমস্ত রাজ্যটা একেবারে রাজায় ঠাসা হয়ে রয়েছে- তাকে বল ফাঁকা! সে যে আমাদের সবাইকেই রাজা করে দিয়েছে! এই-যে অন্য রাজাগুলো, তারা তো উৎসবটাকে দ'লে ম'লে ছারখার করে দিলে- তাদের হাতি-ঘোড়া লোক-লশকরের তাড়ায় দক্ষিণ-হাওয়ার দাক্ষিণ্য আর রইল না, বসন্তর যেন দম আটকাবার জো হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজা নিজে জায়গা জোড়ে না, সবাইকে জায়গা ছেড়ে দেয় ...।'
কিন্তু মেলা ভেজাল! ঠাকুরদা যতই সর্বভূতে বিরাজিত মমতাময় এক ঈশ্বরের অনুরূপ করে রাজাকে অনুভব করতে পারুন না কেন, আমাদের কপালে চারদিকে ঠাসা হলো ব্যুরোক্রেটিক নামকরণের রাজা। ফলে আমাদের পক্ষে কিছুতেই ঠাকুরদার দেখানো পথে অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। 'বেটার শির লেও' আমাদের নিত্যদিনের হুকুমবাণী। আমরা চারপাশের সকল স্থাপনাতে রাজমূর্তির উৎকট চিত্র প্রদর্শন দেখতে থাকি। আমাদের নশ্বর চক্ষুতে একটা মাত্র রূপের আরাধনা করার সামান্য অবকাশটুকুও জোটে না। রাশি রাশি রাজন্যবর্গের অগণিত রূপের অজস্র চিত্ররূপ দেয়ালে দেয়ালে চিত্রিত হতে থাকে। ভক্তির ডালা সাজিয়ে পাড়াতুতো রাজাদের অপেক্ষা করতে হয় আমাদের, তারপর পরগনাতুতো, তারপর সিভিলতুতোদের; তারও পরে থাকে মুখ্য রাজা এবং অবশ্যই কোতোয়ালের রূপ আরাধনা। আমাদের পরিচিত অপেক্ষা কেবল কত বিশাল ভক্তিরসের মটকা সাজিয়েছি তার প্রদর্শনের তাগিদেই। সম্ভবত এই পরিস্থিতিতে থাকলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিরল বিরস বদনে গাইতেন :
'আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি
কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি-
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!' (গীতবিতান, স্বদেশ, ২২)
এ কথা বললে সাহিত্যবোদ্ধারা আমাকে মারতে আসতে না চাইতে পারেন, তবে সাহিত্যরাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে পারেন যে, স্যামুয়েল বেকেটের গডোর প্রতীক্ষায় আর রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুভূতির অভিন্ন জমি পাই। সোজা ভাষায় বললে, মিল পাই। সাহিত্যবোদ্ধারা সাথে সাথে সম্ভবত এই দুইয়ের পটভূমির ভিন্নতা তো বলবেনই, সাথে আরো বোঝানোর চেষ্টা করতে পারেন যে রূপকধর্মী নাটকের সাথে বাস্তবতাবাদ-বিরুদ্ধ উদ্ভটতা/অযৌক্তিকতার দর্শনের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতেও সচেষ্ট হবেন। তবে অতটা কষ্ট কেউ না করলেও এই দুই নাটকের পটভূমি খোদ যথেষ্ট এগুলোকে আলাদা রাখার জন্য। এই দুই নাটকের অন্বেষণের পাটাতন হচ্ছে যথাক্রমে নগর-শিল্পায়নজাত বিযুক্তিবোধ ও নিরর্থকতার বোধ এবং সমাজ বা কৌমনির্ভর সংশ্নেষ ও আত্মাবিস্কারের তাগিদ। তারপরও গডো এবং রাজার জন্য অপেক্ষা করতে থাকার মধ্যে একটা গুণগত মিল আমি পাই। এই আকাঙ্ক্ষার ব্যাকরণ, অভীপ্সা, ক্ষরণ, বাসনা, পরিশ্রান্তি, অবসাদ, উন্মুখতা, উন্মূলতার অনেকগুলো সমরূপতা আছে বলে আমি অনুভব করি। তবে বেকেট আর রবীন্দ্রনাথকে মেলাতে বসাও আজকের মুখ্য প্রতিপাদ্য নয় আমার। এটাও একটা আলাপ প্রাসঙ্গিক সম্প্রসারণ মাত্র। অপেক্ষার প্রসঙ্গে বেকেটের মাস্টারপিসটা মনে পড়া অপ্রাসঙ্গিক নয়, সেই অর্থেই এটা নিয়ে কথা বলা মাত্র। বরং, আজকে আলাপে রবীন্দ্রনাথের নাটকে মনোনিবেশটা আমার তরফে ইচ্ছাকৃত। কখনো আরাম করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আস্ত একটা অভিসন্দর্ভ লিখে ফেলব সেই অপেক্ষায় না থেকে বরং আজকের অপেক্ষা-বিষয়ক আলাপে রবীন্দ্রনাথকে টেনে এনে তাঁর নাটক নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের ভাবাভাবিকে একটা মৃদু আনুষ্ঠানিক অভিব্যক্তি দেবার সুযোগ নিচ্ছি।
আমি কমবেশি কয়েকটা জায়গাতেই উল্লেখ করেছি যে নাটক-রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলাপ-সালাপ যাই হয়ে থাকুক, সেসবের যতটাই আমার চোখে পড়ুক না কেন, তাঁর নাটক-বিষয়ক আলাপ-আলোচনা বিচার-বিশ্নেষণে আমার মনে বিশেষ রেখাপাত করতে পারেনি। আরো অশান্তি হয়েছে এই যে, যা ও যতটা আমার অলস-পাঠক জীবনেও চোখে পড়েছে, তাতে রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি-দর্শন আলোচিত হয়েছে মুখ্যত তাঁর প্রবন্ধকে ঘিরে আর তাঁর নাটক আলোচিত হয়েছে আরেকটা জমিনে, বা চূড়ান্ত বিচারে ঘেরাটোপে। বিদ্যাজগৎ এই অর্থে খুবই অদ্ভুত ধরনের। এখানে সিরিয়াস-ভাবগম্ভীর আলাপ করার জন্য যদি কোনো রচয়িতার প্রবন্ধ ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দেয়া হয় তাহলে কোনো দোষ ধরার সুযোগ কম। কিন্তু আমার বেশ একদর্শী মনে হয়। আমি খুব স্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনীতি ও জনপ্রশাসন দর্শনকে বুঝবার জন্য তাঁর নাটকগুলোর দিকে গভীর মনোযোগ দেয়া দরকার। তাতে তাঁর রাজ(নীতি)ভাবনার আমি গুণগ্রাহী, নাকি শর্তসাপেক্ষে সীমিত পরিসরে রসগ্রাহী, নাকি নিছকই জিজ্ঞাসু বিশ্নেষক তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ। আমি তাঁর নাটকগুলোর বিষয়ে অতিশয় আগ্রহী। এখানে গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য আর খালি-নাট্য সব একত্রেই বললাম। সেখানকার জনপদ, মনুষ্যসম্পর্ক, প্রশাসন যন্ত্রের সাথে জনপদের মানুষের টানাপড়েন আর সম্মিলন, শাস্তিপ্রবণ ঐশী কাঠামো, আবার তার বিপরীতে ধর্মের মনুষ্যলগ্ন বিস্তার, রাজ-অবয়বের প্রতিরুদ্ধ সব চিত্রপ্রণালি, জন-কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্বকারী লৌকিক সম্মিলনমুখী আত্মদর্শনধারী এক নেতা (প্রায়শই দাদাঠাকুর বা ঠাকুরদা হিসেবে)- সব মিলে রবীন্দ্রনাথ নানাবিধ ভাবনা-অনুষঙ্গ বিস্তার করে থাকেন তাঁর নাট্যসৃষ্টিতে। কিছু প্রায় পৌরাণিক দূরত্বময় রূপক, কিংবা কল্প-ইতিহাসের পটভূমিকে পাঠক হিসেবে মানিয়ে নিতে পারলে এগুলোকে নানান চিন্তাসূত্রের ডিব্বা হিসেবে আমি দেখতে পাই।
কিছু নাটক অবশ্যই আমার অন্যগুলোর থেকে অধিক প্রিয়, নানান কারণে- বিসর্জন, রাজা, মায়ার খেলা, তাসের দেশ এবং ভেবে বললে আরো কয়েকটা। এর মধ্যে মায়ার খেলা-কে মনোযৌনজ উপলব্ধির কারণে এবং বাকি তিনটাকে রাজনীতি-জনপ্রশাসন বিষয়ে উপলব্ধির কারণে আমি অতিশয় গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ফলে বিস্ময়ের না যে, বহুদিন পর যখন ঢাকার মঞ্চে রাজা পুনর্ব্যাখ্যাসমেত হাজির করার ঘোষণা নিয়ে একটা থিয়েটার দল প্রযোজনা করে, সম্ভবত ২০০৮ সালে, আমি খুবই আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গেছিলাম। সেই আশায় গুড়ে-বালি হয়েছিল অবশ্য। নির্মাতাগণ বৈশ্বিক রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণে তালগোল পাকানো এক খিচুড়ি উপহার দিয়েছিলেন। সম্ভবত, এই দুর্ঘট ঘটেছিল দুইটা স্পষ্ট কারণে প্রথমত, সেক্যুলারবাদের আত্ম-অবয়বের কাছে প্রশ্নাতীত আত্মসমর্পণের কারণে, দ্বিতীয়ত বিশ্ব-মোড়লদের শাসনপ্রণালি বিষয়ে নিমরাজি ধরনের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে। নাটকটি কিছু সমালোচিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং ভ্রান্ত, কারণে বলে আমি মনে করি। রক্ষণশীল বয়স্ক থিয়েটারকর্মীরা এর প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে গাঁইগুঁই করেছিলেন। বস্তুত, সেগুলো আমার কোনো আপত্তির জায়গাই ছিল না। আমার ছিল রাজাকে বুঝতে পারার সমস্যা নিয়ে; রাজাকে সমকালীন রাজনীতিতে পক্ষ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্মাতাপক্ষে ভুল-পথে পরিচালন বিষয়ে। এই উদাহরণটা আচমকা আনিনি। অপেক্ষার কালে নিবাস করতে-করতে আমরা কী দেখব বলে যাই, কী শুনব বলে যাই; কিংবা আমরা কোন সম্মিলনবাণী শোনাতে চেয়ে সমবেত হই এসবের মীমাংসা করার জন্য এই কাজটাও একটা দারুণ উদাহরণ। এখানে রবীন্দ্রনাথ জড়িত, তাঁর রাজ্যদর্শন জড়িত, মহানগরের সেক্যুলার-পীড়িত সাংস্কৃতিক কর্মীরা জড়িত, একটা সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা জড়িত, বিশ্ব-মোড়লের কর্তৃত্বাবসানের অপেক্ষা জড়িত। আমার জন্য আরো এক মাত্রা বিশেষ ছিল এই কারণে যে, নাটকটি আমার রবীন্দ্র-রাজনীতি দর্শনের সবচেয়ে প্রগাঢ় কাজগুলোর একটি বলে মনে হয়। তবে এই সুযোগে বরং এর বছর কুড়ি আগের এক ঘটনা উল্লেখ করি। ঘটনাটি ঢাকার বিস্মৃতিপরায়ণ মধ্যবিত্ত পাঠকের জন্য আরেকটা মজাদার, অথচ অ-নথিভুক্ত, উদাহরণ হবে।
তখনো এরশাদ কাল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক জমিনের জন্য এক মহাকালই প্রায়। যদ্দুর মনে পড়ে, সেটা রাষ্ট্রধর্ম বিল প্রকাশের পরের সময় কিংবা কাছাকাছি সময়। তার মানে 'নাগরিক সংহতি' নামে বহুপক্ষীয় ও বহু-সংগঠনীয় একটা মোর্চাও তাহলে গঠিত হয়ে গেছে। কিংবা, এতদিন পরে আর মনে নেই, গঠিত হবো-হবো করছে। অনেকেরই মনে থাকবে (আশা করি), এই 'নাগরিক সংহতি' নতুন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের রূপরেখা বানানোর কাজ শুরু করেছিল। বস্তুত, পরের এরশাদবিরোধী নাগরিক স্রোতের বড় কারিগর হিসেবে একে দেখাই ঠিক হবে। এরকম একটা প্রেক্ষাপটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় পর্বের নিম্ন স্নাতক শিক্ষার্থী হিসেবে কান কথায় জানতে পারি যে, ঢাকাতে 'রবীন্দ্ররাজ্য' বলে কিছু একটা গঠিত হচ্ছে, বা হতে চলেছে, বা হয়ে পড়েছে। সামান্য যা পত্রপত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল আমার তাতে কিছুতেই এটাকে জন-ঘটনা হিসেবে দেখা গেল না। তার মানে, যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তাহলে এটা যথাসম্ভব গুপ্ত একটা তৎপরতাই ছিল। এখন সমস্যা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে এ রকম একটা আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন নিয়ে উত্তেজিত হতেন কিনা আমার পক্ষে বলা কঠিন। কিন্তু ওই বয়সের রবীন্দ্রপ্রেমে আমি উত্তেজিত কম হয়েছিলাম, কৌতূহলী বেশি হয়েছিলাম। এই 'রাজ্যের' সংগঠক থাকার গুরুতর দাবিদার বলে মনে করতাম এমন একজন ক্যাম্পাসীয় বয়োজ্যেষ্ঠকে ভালো মতো পাকড়াও করে জানতে চাইলাম। তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা বড় সামাজিক সুবিধা ছিল এই যে, কোনো কিছু আড়ালে রাখার জন্য যতটা কঠোর হতে হয়, ততটা তিনি কোনো দিনই ছিলেন না। অন্তত আমি মনে করতাম না। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর অসংযত দু-চারটা বাক্য থেকেই আমি প্রথম আন্দাজ করতে পারি এই ঘটনা সম্বন্ধে। তাঁকে ভালেমতো ধরবার পরে, আমি গোপন রাখব এই শর্তে, তিনি জানালেন ঢাকার কিছু রবীন্দ্রভক্ত (বটেই!) মানুষজন ও সংগঠন একটা রবীন্দ্ররাজ্যের রূপরেখা বানিয়েছেন। এমনকি তাঁরা একটা সংবিধান প্রণয়নের প্রাথমিক কাজবাজও করে ফেলেছেন। বলাই বাহুল্য, এটাকে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক গঠনের প্রতি কোনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখার কোনোই কারণ নাই। বরং, এটা ছিল 'সু' আর 'মঙ্গল'-সংক্রান্ত এই লোকগুলোর দুঃশাসনের মধ্যে থাকার বাস্তবতায় একটা জানালার মতো 'সাংস্কৃতিক' কর্মকাণ্ড। রবীন্দ্রভক্ত সংগঠনসমূহ আন্দাজ করতেও আমার অনেক কষ্ট করতে হয়নি। বয়োজ্যেষ্ঠ সেই সংগঠকের মুখে 'গোপন' এই তৎপরতা জানার পর আমি জিজ্ঞাসা না-করে পারিনি : 'কিন্তু এ রকম হাসিহীন লোকদের সাথে রবীন্দ্রনাথ নিজে কি থাকতে চাইতেন?' বা কাছাকাছি কিছু। আমার ভক্তির অভাবে এতক্ষণ ধরে তাঁদের তৎপরতা বিশদ করার কারণে তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন বিলক্ষণ। সম্ভবত সংগঠনটির কোনো কাণ্ড বা জ্ঞান জনসমাজে আর বিকশিত হয়নি। অন্তত আমি কোনো লক্ষণ পাইনি। এটা হয়তো বিরল সেসব সংগঠন, যা দুই তিন সভার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে থাকে।
এই এত বছর বাদে, আপাত তুচ্ছ এই ঘটনাটাও আমি স্মরণ করি কিছু জিজ্ঞাসাকে বিস্তার ঘটাতে গিয়ে। কেন একজন রবীন্দ্রনাথ বিশালাকায় আইকন হবার পরও খণ্ডীকৃতভাবে সেবনকৃত হয়ে থাকেন? কেন জাতীয়তাবাদের ক্রিটিক রবীন্দ্রনাথ ভাষা-জাতীয়তাবাদের আইকন হিসেবে পর্যবসিত হন? কেন তাঁর লোকসমাজ-জনসমাজের উপলব্ধিকে পাশ কাটিয়ে আধ্যাত্ম আর নন্দনের বেখাপ্পা জিনিসগুলোকে নগর-সেবকেরা গ্রহণ করে থাকেন? কেন রবীন্দ্রনাথ কনজ্যুমড হন তাঁর লাস্য ও রঙ্গময়তাকে সম্পূর্ণ বিবর্জিত অবস্থায়? কোন মনজিলের জন্য এসব ভদ্রাত্মা অপেক্ষা করে থাকেন যেখানে রবীন্দ্রনাথকে কাস্টমাইজ করে নিজেদের মতো করে বানিয়ে নেন তাঁরা? এভাবে বানিয়ে নিতে হয় তাঁদের ঠিক কোন ধরনের শাসনপ্রণালির প্রতি বশ্যতার কারণে?
রাজা নাটকে সাধারণ বশ্যতাকামী জনগণ অপেক্ষা করে থাকেন উৎসবে কখন রাজা আসবেন। বসন্ত উৎসব! বসন্ত নামে সম্পূর্ণ আরেকটা গীতিনাট্য রবীন্দ্রনাথের। মাপে অনেকটা ছোট এবং বছর ১০-১২ পরে রচনা করা। কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গীকৃত এই কাজটা তাঁঁর খুবই ভিন্ন। সেখানেও নানাবিধ সম্মিলনী আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু রাজকার্যবিষয়ক মীমাংসার দিক থেকে সেটা ঠিক তুলনীয় জায়গায় আমি রাখব না। তো, রাজা নাটকে সেসব বশ্যতাকামী জনগণ রাজাকে জন-পরিসরে না দেখার অস্বস্তি আর অস্থিরতা প্রকাশ করতে থাকেন। নাগরিক দলের ভাষ্য হচ্ছে- 'সকল দেশেই রাজাকে দেখে দেশসুদ্ধ লোকের আত্মাপুরুষ বাঁশপাতার মতো হি হি করে কাঁপতে থাকে, আর আমাদেরই রাজাকে দেখা যায় না কেন। কিছু না হোক, একবার যদি চোখ পাকিয়ে বলে 'বেটার শির লেও' তা হলেও যে বুঝি রাজা বলে একটা-কিছু আছে।' এই ভীতিপ্রদ 'রাজা'র অপেক্ষা করতে থাকা সাধারণ জনারণ্যে কোনো ঐচ্ছিক দশা নয়; আধুনিক রাষ্ট্রের বনিয়াদ ভাবলে, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ভাবলে, এটা বরং এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা, হকিকত আমাদের। ভীতিপ্রদ রাজত্বের অপেক্ষা করতে থাকি আমরা। কিন্তু ঠাকুরদা কী বলেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, ঠাকুরদাই সেই লৌকিক কণ্ঠস্বর যিনি রাজপ্রণালির ব্যাকরণ সম্যক বোঝেনই না কেবল, বরং তিনি অনায়াসে সেই ব্যাকরণের মধ্যে কারকের জায়গায় 'নাগরিক'কে স্থাপন করতে পারেন। তিনি, তাঁর সমরূপ প্রতিনিধি, রবীন্দ্রনাথে একদম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন একটার পর একটা নাটকে। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, 'আমাদের দেশে রাজা এক জায়গায় দেখা দেয় না বলেই তো সমস্ত রাজ্যটা একেবারে রাজায় ঠাসা হয়ে রয়েছে- তাকে বল ফাঁকা! সে যে আমাদের সবাইকেই রাজা করে দিয়েছে! এই-যে অন্য রাজাগুলো, তারা তো উৎসবটাকে দ'লে ম'লে ছারখার করে দিলে- তাদের হাতি-ঘোড়া লোক-লশকরের তাড়ায় দক্ষিণ-হাওয়ার দাক্ষিণ্য আর রইল না, বসন্তর যেন দম আটকাবার জো হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজা নিজে জায়গা জোড়ে না, সবাইকে জায়গা ছেড়ে দেয় ...।'
কিন্তু মেলা ভেজাল! ঠাকুরদা যতই সর্বভূতে বিরাজিত মমতাময় এক ঈশ্বরের অনুরূপ করে রাজাকে অনুভব করতে পারুন না কেন, আমাদের কপালে চারদিকে ঠাসা হলো ব্যুরোক্রেটিক নামকরণের রাজা। ফলে আমাদের পক্ষে কিছুতেই ঠাকুরদার দেখানো পথে অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। 'বেটার শির লেও' আমাদের নিত্যদিনের হুকুমবাণী। আমরা চারপাশের সকল স্থাপনাতে রাজমূর্তির উৎকট চিত্র প্রদর্শন দেখতে থাকি। আমাদের নশ্বর চক্ষুতে একটা মাত্র রূপের আরাধনা করার সামান্য অবকাশটুকুও জোটে না। রাশি রাশি রাজন্যবর্গের অগণিত রূপের অজস্র চিত্ররূপ দেয়ালে দেয়ালে চিত্রিত হতে থাকে। ভক্তির ডালা সাজিয়ে পাড়াতুতো রাজাদের অপেক্ষা করতে হয় আমাদের, তারপর পরগনাতুতো, তারপর সিভিলতুতোদের; তারও পরে থাকে মুখ্য রাজা এবং অবশ্যই কোতোয়ালের রূপ আরাধনা। আমাদের পরিচিত অপেক্ষা কেবল কত বিশাল ভক্তিরসের মটকা সাজিয়েছি তার প্রদর্শনের তাগিদেই। সম্ভবত এই পরিস্থিতিতে থাকলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিরল বিরস বদনে গাইতেন :
'আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি
কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি-
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!' (গীতবিতান, স্বদেশ, ২২)
- বিষয় :
- প্রচ্ছদ
- মানস চৌধুরী