বয়ঃসন্ধিকাল

সানজিদা আহমেদ
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২২ | ২১:৫৭
বয়ঃসন্ধিকাল- কৈশোর থেকে যৌবনে যাওয়ার অন্তর্বর্তীকাল। এ সময়ে শরীরে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি মনোজগতেও সরাসরি প্রতিফলন দেখা যায়। মনোদৈহিক পরিবর্তনে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খেতে হয় কিশোর-কিশোরীদের। তাদের দরকার হয় আস্থা ও নির্ভরতার পরশ। লিখেছেন সানজিদা আহমেদ
তা নজিনা নূর (ছদ্মনাম) এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে। ইদানীং তার ভীষণ বিষণ্ণ লাগে। মাঝেমধ্যে মেজাজও খিটখিটে হয়ে যায়। মা-বাবা আগের মতো তাকে সময় দেন না। একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে আয়নায় দেখল। মুখে ব্রণ উঠেছে কয়েকটা। দেখে মন আরও খারাপ হয়ে গেল তার। স্কুলে গিয়ে প্রথম ক্লাস শেষে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখল তার স্কুল ড্রেসে রক্ত। ভয় পেয়ে গেল তানজিনা। দ্রুত স্কুলের বান্ধবী ও শিক্ষিকাকে বিষয়টি জানাল। শিক্ষিকা মাসিকের বিষয়টি তাকে বুঝিয়ে বললেন। বাসায় আসার পর মা বলল, এখন তুমি বড় হয়েছ। আর এত খেলাধুলা করবে না। ছেলেদের সঙ্গে কম মিশবে। এর পরও তানজিনার শঙ্কা কাটল না। সে আগের চেয়ে আরও বেশি মনমরা ও চুপচাপ হয়ে গেছে।
বাবুল (ছদ্মনাম) শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে সবেমাত্র পা দিয়েছে। তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর হঠাৎ কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন সেটিই জানান দেয়। বন্ধুদের সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে কথা বলার পর তারা পর্নোগ্রাফি দেখার পরামর্শ দেয়। বাবুল ধীরে ধীরে নিজেকে অন্য এক জগতে আবিস্কার করে। লেখাপড়ায় তার কোনো মন নেই। ইদানীং মেয়েদের অনেক উত্ত্যক্ত করে সে।
'ছুটি' গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'বিশেষত, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা।'
কবি যথার্থই বলেছেন। মানুষের জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সময় হলো বয়ঃসন্ধিকাল। ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী, যারা এ দেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ বছর এবং ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়কে কৈশোর বলে। এর যে কোনো এক সময়ে বয়ঃসন্ধিকাল আসতে পারে। এটা মূলত কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়।
গাইনোকোলজিস্ট ডা. রাশেদা বেগম বলেন, 'বয়ঃসন্ধিকালে একজন ছেলে বা মেয়ের শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসতে থাকে। এ বয়সে মেয়েদের উচ্চতা বাড়ে। শরীরের বিভিন্ন অংশ স্টম্ফীত হয়। বাহুমূল ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়। মাসিক শুরু হয়। তেমনি ছেলেদের ক্ষেত্রে, এ সময় তাদের দেহের উচ্চতা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে, গলার স্বর ভারী হয়ে আসে, কাঁধ চওড়া হয়, পেশি সুগঠিত হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ ওঠে; সেই সঙ্গে শরীরের নানা জায়গায়, বিশেষ করে বুকে, বাহুমূলে ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়। বয়ঃসন্ধির এই সময়ে ছেলে-মেয়ে উভয়ের প্রজনন ক্ষমতার বিকাশ হতে থাকে বলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ হয়। অনেক সময় ঘুমের মধ্যে ছেলেদের বীর্যস্খলন হয়ে থাকে, যা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটি বয়ঃসন্ধির একটি লক্ষণ।' তিনি আরও বলেন, 'এ সময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েদের মধ্যে ডায়েট করার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়, যা তার পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়।'
বয়ঃসন্ধিকালে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক অবস্থার মধ্যেও তৈরি হয় ব্যাপক পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী ফারজানা ফাতেমা (রুমী) বলেন, 'এ সময় ছেলে-মেয়ে উভয়ের মুড সুইং, ডিপ্রেশন, অতি আধুনিকতার প্রভাব, বাউন্ডুলেপনা, আত্মপ্রত্যয়ের অভাব, নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ, বন্ধুমহলের প্রতি আর্কষণ, অবসাদ বা বিষণ্ণতা থেকে ধূমপান বা মাদক গ্রহণ, শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে উদ্বেগ, বহির্মুখিতা, আবেগকেন্দ্রিক সম্পর্ক তৈরির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন ধরনের অনুভূতির বিপরীতে বেশিরভাগ মা-বাবা কঠোর হয়ে ওঠেন, গায়ে হাত তোলেন। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।'
উন্নয়নকর্মী রায়হান মোস্তাক বহু দিন ধরে উপকূলীয় এলাকার মানুষদের মাঝে কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব অঞ্চলে কিশোরীদের মাসিকের সময়ে সমস্যা বেশি হয়। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের বিষয় নিয়ে এখন সচেতনতা বাড়লেও ছেলেদের বিষয় অনেক কম আলোচনা হয়, যা করা এখন সময়ের দাবি।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোমা দে বলেন, 'বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বয়ঃসন্ধিকালে করোনা-পরবর্তী জটিলতা তৈরি হয়েছে। দেখা গেছে, এ সময় ছেলে-মেয়েরা মানুষের তুলনায় যন্ত্রের সঙ্গে বেশি সংযোগ তৈরি করেছে। স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে পিছিয়ে পড়ছে। ফলে তাদের আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। মেজাজ খিটখিটে, মুড সুইং তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।'
এ প্রসঙ্গে ফারজানা ফাতেমা (রুমী) বলেন, "মা-বাবাকে সন্তানের কাছে থাকার কয়েকটি উপায় হলো- ১. মনোযোগ দিয়ে শোনা। মুখ বন্ধ করে কান খোলা রাখা অর্থাৎ মন্তব্য না করে শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনে যেতে হবে। সন্তান যেন বুঝতে পারে, আপনি তাকে শুনছেন। ২. ফোন সরিয়ে রাখা বা টিভি বন্ধ করার মতো সাধারণ কাজ করতে ভুলে গেলে চলবে না। ৩. সুস্পষ্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা। সন্তানের কথা বিভ্রান্তিকর বা অস্পষ্ট হতে পারে। প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসাবাদে পরিণত করার পরিবর্তে কৌতূহলী হোন। ৪. সব আবেগকে গ্রহণ করা। কথা শোনার আগেই 'শান্ত হও' বা 'কান্না থামাও' বলবেন না। কোমল কণ্ঠে বলুন, 'আমি বুঝতে পারছি, তোমার কষ্ট হচ্ছে।' সন্তানকে কাঁদতে দিন তবে খেয়াল রাখবেন তার আচরণ যেন ভাঙচুর, নিজেকে ক্ষতি করার দিকে না যায়।"
বয়ঃসন্ধিকালের আবেগ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। কারণ ওই ছেলে বা মেয়ে জানে না, তার আচরণ অন্যরা কীভাবে নিচ্ছে। নতুন মনোদৈহিক পরিবর্তনে সবকিছুই তার কাছে নতুন মনে হবে। এ বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাদের পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা দরকার। তাই এ সময়ের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে আগে থেকেই খোলামেলা আলোচনা জরুরি।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
- বিষয় :
- বয়ঃসন্ধিকাল