ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ক্ষুধার্ত মুখে হাসি ফোটায় ‘মেহমানখানা’

ক্ষুধার্ত মুখে হাসি ফোটায় ‘মেহমানখানা’

--

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০

রোজ হাজারো নিরন্ন ও অসহায় মানুষের ক্ষুধার্ত মুখে হাসির ঠিকানা রাজধানী লালমাটিয়ার ডি-ব্লক। লিজা ও তাঁর বন্ধুদের মানবিক উদ্যোগটির নাম 'মেহমানখানা'। করোনা, ইফতার, ঈদ বা অন্য যে কোনো সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই তাঁদের মূল লক্ষ্য। মেহমানখানার কথা লিখেছেন লাবণী মণ্ডল

থিয়েটারকর্মী আসমা আক্তার লিজা। তাঁর নাটকের দল 'নাট্যনন্দন' মঞ্চে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। লিজা নানা সামাজিক কাজের সঙ্গেও যুক্ত। বেড়ে উঠেছেন কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানায়। গ্রামের পুকুরে হাঁসের দলের সঙ্গে সাঁতার কাটতে কাটতে বড় হওয়া। ঝড়ের দিনে আম না কুড়িয়ে তিনি পাখির বাসা কুড়াতেন। পাখির ছানাকে তুলে দিতেন গাছের ডালে! শৈশবের প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি প্রেমই তাঁকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই লিজা ও তাঁর বন্ধুদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে মেহমানখানা। তবে উদ্যোক্তাদের মধ্যে এ নিয়ে নেই কোনো বাড়তি প্রচারের চিন্তা। নিভৃতে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য।

লিজা জানান, মেহমানখানা গড়ে তোলা নিয়ে আগে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। করোনা মহামারিতে যখন শ্রমজীবী মানুষ অসহায়, তখন থেকে অন্নহীন অসহায় মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল রাজধানীর লালমাটিয়ায় ডি-ব্লক এলাকা। এখানেই রাস্তার পাশে ফুটপাতে চালু হয় মেহমানখানা। পথশিশুসহ বহু মানুষ খাবারের সন্ধানে এসে এখানকার অতিথি হয়েছেন। তবে নতুন খবর হলো, সেই পথশিশুরা এখন পড়তেও আসে এখানে।

শ্রেণি, পেশা কিংবা বিত্তের বিচার নয়; যাঁদের পদচারণা পড়বে, তাঁরাই মেহমানের মর্যাদা পাবেন। মেহমানখানা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে, করোনার প্রথম সাধারণ ছুটির সময়ে। পুরো বিশ্বের চিত্র ছিল দুর্বিষহ। রাজধানী ঢাকার চিরচেনা চিত্র পাল্টে যায়। ঢাকা শহর স্তব্ধ। নির্বাক। সবাই ভাবছে, মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে; কীভাবে কাটবে পরবর্তী দিনগুলো। ব্যাংক-ব্যালান্স শেষ হবে, মানুষ চাকরিহারা হবেন। ক্ষুদ্র চাকরিজীবীরা হারাবেন ছোট্ট চাকরিটি। মানুষ খাবার না পেলে প্রাণীরা কী খাবে? এসব চিন্তা লিজাকে কুরে কুরে খায়। এ সময় তিনি কাক, কুকুর ও অন্য প্রাণীদের জন্য খাবার নিয়ে ঘুরতেন রাজধানীর আনাচে-কানাচে। কী দুর্বিষহ দিন! পথশিশুরা নিরন্ন, খাবার খুঁজছে। অথচ মানুষকে ঘরে থাকার কথা বলা হয়েছে। মানুষ খাবার পেলে অন্য প্রাণীও বাঁচবে- এ চিন্তারই ফসল মেহমানখানা।

লিজা বলেন, 'আমার মাথায় একটাই চিন্তা ছিল- শিশুদের কীভাবে রক্ষা করব। একটা সময় মনে হলো, করোনা থেকে মুক্ত করা অনেক বড় ব্যাপার। ভ্যাকসিন, ওষুধ, প্রতিরোধ- এসব নিয়ে তো আমার তেমন কিছু করার নেই। যারা কর্মহীন, বিপন্ন, পথে থাকে- তারা যেন খাবারের অভাবে না মরে। অন্যান্য দেশে মহামারিতে মানুষ মরছে, আমার দেশেও মরল- এই কষ্ট নেওয়া যাবে; কিন্তু না খেয়ে মানুষ মরে গেছে- এ কষ্ট নেওয়ার মতো নয়।'

এভাবেই যাত্রা শুরু। বাসা থেকে ৫০ থেকে ১০০ জন মানুষের রান্না করে আশপাশের লোকজনকে দিতেন। পথশিশুরা এসে খেত। তাদের মুখে হাসি। কখনও রিকশা নিয়ে বের হতেন। কিন্তু ৫০ থেকে ১০০ জন যখন হাজার হাজার মানুষ হয়ে গেল, তখন তাদের চিন্তা পরিবর্তন হলো। মানুষ জেনে গেল, লালমাটিয়ার ডি-ব্লকে মেহমানখানায় গেলেই খাবার মিলবে।

লিজা জানান, মেহমানখানার মেহমান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে স্বেচ্ছাসেবক। এই দুই প্রাপ্তির আনন্দ অপার! স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকে শিক্ষার্থী, অনেকে চাকরিজীবী। তাঁরা খুব যে সচ্ছল, তা নয়। অসংখ্য মানুষ দায়িত্ব নিয়েছেন দুস্থ মানুষের। তাই মেহমানখানা চলছে। তাঁরাই মূল চালিকাশক্তি। এমন অনেক স্বেচ্ছাসেবক আছেন, যাঁরা হয়তো বাড়িতে নিজের প্লেটটা ধুয়েও ভাত খেতেন না; অথচ তাঁরা শত শত প্লেট ধুয়েছেন মেহমানখানায়।'

করোনাকালে বিপন্ন মানুষের জন্য এই মেহমানখানায় রান্না হতো চাল-ডাল-সবজি-মাংস দিয়ে খিচুড়ি! রোজার সময় ছিল ইফতারের ব্যবস্থা। ইফতারে ছোলা, মুড়ি, খেজুর, চিড়া, জিলাপির সঙ্গে থাকত শরবত। শুক্রবারের আয়োজন থাকত বিশেষ খিচুড়ি। কেউ আগে থেকে জেনেই আসতেন, আবার কেউ বা শরিক হয়ে যেতেন চলতি পথে।

শুক্রবার থেকে বুধবার যে কেউ এখানে খেতে পারেন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত। টাকা-পয়সা লাগে না। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় এ কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো বিলাসবহুল বাড়ি কিংবা বহুতল ভবন নয়; রাস্তার পাশে ফুটপাতে এই আয়োজন হয়। লিজা বলেন, 'এখানে যাঁরাই খেতে আসেন, তাঁরা সবাই আমাদের সম্মানিত মেহমান। খুব বিপদে না পড়লে কেউ কারও দুয়ারে হাত পাতেন না। আমি প্রতিদিনই চাই, এই মেহমানখানা বন্ধ হয়ে যাক। একটা ক্ষুধার্ত মুখও যেন না থাকে এই দেশে, এই শহরে! কিন্তু প্রতিদিন শত শত ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় জমে এই মেহমানখানা সড়কে। তাদের মুখের দিকে তাকালে আর নিজের গলা দিয়ে ভাত নামতে চায় না! মনে হয়, ওরা ক্ষুধা নিয়ে ফিরে গেল, নিজে কী করে পেটপুরে খাই! তাই আবারও জ্বালাতে হয় মেহমানখানার চুলা।'

শুধু ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ অনেক অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। মেহমানখানা এসব মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে। মেহমানখানার রয়েছে একটি শক্তিশালী, নিষ্ঠাবান কর্মী বাহিনী, যার প্রত্যেক সদস্য মানুষের ক্ষুধা নিবারণে লেগে আছেন।

লিজা বলেন, 'এ উদ্যোগে কখনও ভয় হয়নি। শুধু চাল-ডাল জোগাড় করতে না পারলে মাঝেমধ্যে কান্না পায়। পরক্ষণেই ভাবি, বাংলাদেশের মানুষ এখনও অনেক মানবিক। এই মেহমানখানায় খাবারের অভাব কোনো দিনই হবে না। অতীতের মতো কেউ না কেউ পাশে দাঁড়াবেই!' তিনি স্বপ্ন দেখেন, সমাজে বাস করা মানুষ একদিন ভাববে- এটি তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবিক কর্তব্য। স্বপ্নই মানুষকে জাগ্রত রাখে। ফুটপাত যেন কোনো শিশুর ঠিকানা না হয়- এটিও তাঁর স্বপ্ন। তাঁরা এখন শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবছেন। মানবিক পাঠশালা গড়তে চান।

এ প্রসঙ্গে লিজা বলেন, "আমাদের স্কুলের কার্যক্রম মোটামুটি শুরু করেছি। স্কুলের নাম 'অন্যরকম পাঠশালা'। এর মাধ্যমে যেন তারা অন্তত নিজেকে একজন ভালো মানুষ বলে দাবি করতে পারে। সেটা আমরা শেখাতে চাই। বিশেষ করে মানবিক জায়গাগুলো- তারা যেন মানুষকে ভালোবাসতে শেখে।"

আরও পড়ুন

×