বইয়ের ভুবন
কিশোর মনে বাবা অথবা মুক্তিযুদ্ধ

আব্বুকে মনে পড়ে, লেখক-হুমায়ুন আজাদ, প্রকাশক-আগামী প্রকাশনী, প্রচ্ছদ-সব্যসাচী মিস্ত্রী, মূল্য-৩৫০ টাকা
লাবণী মণ্ডল
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০
হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন অজস্র মননশীল পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই। যে বইগুলো সমাজের ভেতর মানুষের মননজগৎ তৈরিতে প্রভাব রেখেছে। শিশু-কিশোরদের জন্যও রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। 'আব্বুকে মনে পড়ে' বইটি তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে কিশোরদের উপযোগী সাহিত্য খুব বেশি দেখা যায় না। আলোচ্য বইটি এ বাস্তবতারই বিপরীত। 'আব্বুকে মনে পড়ে' কিশোরদের জন্য স্মৃতিভারাতুর। একজন কিশোরের নিজের ভাষ্যে লেখা বই, যেখানে রয়েছে একজন বটবৃক্ষের কথা, বাবার কথা। বাবা হারানোর বেদনাতুর গল্প নিয়ে বইটি কখনও স্মৃতিকাতর করে তুলবে, কখনওবা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের যে একাত্মতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে।
'আব্বুকে মনে পড়ে' উপন্যাসিকাটি (ছোটো উপন্যাস) ১৯৮৯ সালের জুনে (আষাঢ় ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ) আগামী প্রকাশনী থেকে এটি প্রকাশিত হয়। প্রথম সচিত্র সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে। বইটির মূল উপজীব্য- ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাবা হারানোর গল্প। ২০০৩ সালে কিকুকো সুজুকি উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন।
এক বিষণ্ণ সুন্দর কিশোর। সে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করে যাচ্ছে; আদতে সে সবচেয়ে মধুর সবচেয়ে মহান স্মৃতির মধ্যে হাতরে ফিরে। আব্বুকে তার মনে পড়ে এবং মনে পড়ে না। মনে পড়ে না বলেই আব্বুকে তার বেশি মনে পড়ে। আবার যাকে ভোলা যায় না, তাকে কী করে মনে পড়বে! এক মহাযুদ্ধ এসেছিল তার জীবনে। সবার জীবনে। ওই মহাযুদ্ধের নাম মুক্তিযুদ্ধ। তার সুন্দর মধুর কবিতায় ভরা আব্বু গিয়েছিল সেই মহাযুদ্ধে, আর ফেরেনি। তারপর সবার জীবন ভরে উঠেছে স্বাধীনতায়; কিন্তু তার জীবন ভরেনি আব্বু ফেরেনি বলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ছিল শিশু, এই উপন্যাসে সে বলেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা। তার হারানোর কথা। সুখের কথা। স্বপ্নের কথা। আনন্দের কথা। বুকের ভেতরে জমে থাকা জলের কথা। হুমায়ুন আজাদ কবিতার মতো করে শিশুকিশোরদের বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের এমন গল্প, যা বুকে জাগিয়ে দেয় হাহাকার।
একজন শিশু, যার মনে পড়ে না তার আব্বুর মুখাবয়ব, কেমন ছিলেন আব্বু? কিন্তু মনে পড়ে আব্বুকে। স্বপ্ন বাঁধে। আশাভঙ্গ হয়। নিরাশা ভর করে; কিন্তু আব্বুকে মনে পড়ে! আব্বু কেমন করে চুল আঁচড়াত, কেমন করে কলিংবেল বাজাত, কেমন ছিল সে আওয়াজ; এসব তাকে কুরে কুরে খায়। কিচ্ছু জানে না। বুঝতে চায় না। তার আব্বু কি মোটা ছিল, না হালকা? নাহ্! কোনো কিছুই জানে না। মানবিক, করুণ বর্ণনা দিয়ে বইটি শেষ করেছেন লেখক।
স্মৃতিচারণ থেকে-
"দরোজায় দাঁড়িয়েই আব্বু বলতো, 'কোথায়?'
আমি চিৎকার করে বলতাম, 'এ-ই-যে।'
আব্বু আবার বলতো, 'কো-থা-য়?'
আমি বলতাম, 'কে খায়?'
তখন তার হাতে উঁচু ক'রে ধরা থাকত চকোলেট।
আমি খুশিতে আব্বুকে জড়িয়ে ধ'রে নাচতে নাচতে বলতে থাকতাম, 'আমি খাই। আমি খাই। আমি খাই।'"
শিশুদের মনস্তত্ত্ব কতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করলে, এভাবে উপস্থাপন করা যায়! এখানেই হুমায়ুন আজাদের পারদর্শিতা।
ছেলেটি যখন জন্মেছিল, চারদিক তখন উন্মাতাল। 'সবাই কি ওর বিরুদ্ধে? ও আসবে বলে ক্ষেপে উঠেছে মানুষেরা?' লিখেছিলেন ছেলেটির বাবা, তাঁর দিনপঞ্জিতে।
বাবার সঙ্গে খেলে, হামাগুড়ি দিয়ে, বিড়াল পুষে, পরীদের কথা শুনে বেড়ে উঠতে থাকে ছেলেটি। ছেলেটি যখন পা দিয়েছিল চার-এ, সেটি ছিল তখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। বাবা পরিবারসহ চলে আসেন গ্রামের বাসায়। হানাদাররা হানা দেয় সেখানেও। আবার তাদের ফিরতে হয় তাদের শহর-ঢাকাতে। বাবা যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। এভাবেই গল্পের শুরু। বাবার মুক্তিবাহিনীতে চলে যাওয়ার খবর চিঠিতে লিখে জানান।
দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে স্বাধীনতার গান। সবুজের বুকে এক টুকরো লাল সূর্য। কী অপূর্ব দৃশ্য! যে দৃশ্যে মন কাড়ছে বাংলার মানুষের। কিন্তু বাবা আর ফিরে না! কলিংবেল বাজে না। ঘুমের তালে দরজার আওয়াজ পায়, দৌড়ে যায়। কিন্তু না, কেউ নেই! ছেলেটি মনে মনে আব্বুকে খোঁজে, 'আব্বু তুমি কোথায়' বলে ডাকে? তুমি কি জাগ্রত আব্বু, তুমি কেন শোনো না বলে আকুতি জানায়!
স্মৃতিচারণ থেকে- ''আব্বু, তুমি কোথায় আছো? আব্বু, আমার আব্বু? এখনি চ'লে এসো, আব্বু। এখনি চ'লে এসো। আমার ঘুম আসে না, আম্মুর ঘুম আসে না।
আমার খেতে ইচ্ছে করে না, আম্মুর খেতে ইচ্ছে করে না। আমি চুপ ক'রে ব'সে থাকি। আম্মু চুপ ক'রে ব'সে থাকে।...''
এমন হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়ে বইটি সাজানো, যা বাবাহারা পুত্রের আকুতিকে উপলব্ধি করতে সহযোগিতা করে। 'তোমার জন্য আমাদের কারো ঘুম হয় না, আব্বু।' জীবনের এ ডায়ালগটি যাঁরা পিতৃহারা হয়েছেন, তাঁরা অনুভব করতে পারবেন। যাঁরা বাবাকে হারিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে কিংবা কোনো হঠাৎ ঝড়ে!
এভাবেই বইয়ের পরিধি বেড়েছে। আকুলতা বেড়েছে। বাবাকে হারানোর বেদনার প্রকাশ ঘটেছে। যে ঘটনাকে কখনও নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার ইচ্ছা জাগে। কখনওবা অজান্তেই আপ্লুত হয়ে যেতে চাই। আব্বুকে ফিরে পেতে চায়, আব্বু ফিরে আস, গান গাইব; পরীদের সঙ্গে গল্প করব! কিন্তু আব্বু যে দেশের জন্য জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন, দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করেছেন। এ বোধ তো ছোট্ট কিশোরের মনকে শান্ত করতে পারে না।
যে কোনো সাহিত্যেই শিক্ষণীয় বিষয় থাকলে, সেটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
'আব্বুকে মনে পড়ে' উপন্যাসিকাটি (ছোটো উপন্যাস) ১৯৮৯ সালের জুনে (আষাঢ় ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ) আগামী প্রকাশনী থেকে এটি প্রকাশিত হয়। প্রথম সচিত্র সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে। বইটির মূল উপজীব্য- ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাবা হারানোর গল্প। ২০০৩ সালে কিকুকো সুজুকি উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন।
এক বিষণ্ণ সুন্দর কিশোর। সে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করে যাচ্ছে; আদতে সে সবচেয়ে মধুর সবচেয়ে মহান স্মৃতির মধ্যে হাতরে ফিরে। আব্বুকে তার মনে পড়ে এবং মনে পড়ে না। মনে পড়ে না বলেই আব্বুকে তার বেশি মনে পড়ে। আবার যাকে ভোলা যায় না, তাকে কী করে মনে পড়বে! এক মহাযুদ্ধ এসেছিল তার জীবনে। সবার জীবনে। ওই মহাযুদ্ধের নাম মুক্তিযুদ্ধ। তার সুন্দর মধুর কবিতায় ভরা আব্বু গিয়েছিল সেই মহাযুদ্ধে, আর ফেরেনি। তারপর সবার জীবন ভরে উঠেছে স্বাধীনতায়; কিন্তু তার জীবন ভরেনি আব্বু ফেরেনি বলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ছিল শিশু, এই উপন্যাসে সে বলেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা। তার হারানোর কথা। সুখের কথা। স্বপ্নের কথা। আনন্দের কথা। বুকের ভেতরে জমে থাকা জলের কথা। হুমায়ুন আজাদ কবিতার মতো করে শিশুকিশোরদের বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের এমন গল্প, যা বুকে জাগিয়ে দেয় হাহাকার।
একজন শিশু, যার মনে পড়ে না তার আব্বুর মুখাবয়ব, কেমন ছিলেন আব্বু? কিন্তু মনে পড়ে আব্বুকে। স্বপ্ন বাঁধে। আশাভঙ্গ হয়। নিরাশা ভর করে; কিন্তু আব্বুকে মনে পড়ে! আব্বু কেমন করে চুল আঁচড়াত, কেমন করে কলিংবেল বাজাত, কেমন ছিল সে আওয়াজ; এসব তাকে কুরে কুরে খায়। কিচ্ছু জানে না। বুঝতে চায় না। তার আব্বু কি মোটা ছিল, না হালকা? নাহ্! কোনো কিছুই জানে না। মানবিক, করুণ বর্ণনা দিয়ে বইটি শেষ করেছেন লেখক।
স্মৃতিচারণ থেকে-
"দরোজায় দাঁড়িয়েই আব্বু বলতো, 'কোথায়?'
আমি চিৎকার করে বলতাম, 'এ-ই-যে।'
আব্বু আবার বলতো, 'কো-থা-য়?'
আমি বলতাম, 'কে খায়?'
তখন তার হাতে উঁচু ক'রে ধরা থাকত চকোলেট।
আমি খুশিতে আব্বুকে জড়িয়ে ধ'রে নাচতে নাচতে বলতে থাকতাম, 'আমি খাই। আমি খাই। আমি খাই।'"
শিশুদের মনস্তত্ত্ব কতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করলে, এভাবে উপস্থাপন করা যায়! এখানেই হুমায়ুন আজাদের পারদর্শিতা।
ছেলেটি যখন জন্মেছিল, চারদিক তখন উন্মাতাল। 'সবাই কি ওর বিরুদ্ধে? ও আসবে বলে ক্ষেপে উঠেছে মানুষেরা?' লিখেছিলেন ছেলেটির বাবা, তাঁর দিনপঞ্জিতে।
বাবার সঙ্গে খেলে, হামাগুড়ি দিয়ে, বিড়াল পুষে, পরীদের কথা শুনে বেড়ে উঠতে থাকে ছেলেটি। ছেলেটি যখন পা দিয়েছিল চার-এ, সেটি ছিল তখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। বাবা পরিবারসহ চলে আসেন গ্রামের বাসায়। হানাদাররা হানা দেয় সেখানেও। আবার তাদের ফিরতে হয় তাদের শহর-ঢাকাতে। বাবা যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। এভাবেই গল্পের শুরু। বাবার মুক্তিবাহিনীতে চলে যাওয়ার খবর চিঠিতে লিখে জানান।
দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে স্বাধীনতার গান। সবুজের বুকে এক টুকরো লাল সূর্য। কী অপূর্ব দৃশ্য! যে দৃশ্যে মন কাড়ছে বাংলার মানুষের। কিন্তু বাবা আর ফিরে না! কলিংবেল বাজে না। ঘুমের তালে দরজার আওয়াজ পায়, দৌড়ে যায়। কিন্তু না, কেউ নেই! ছেলেটি মনে মনে আব্বুকে খোঁজে, 'আব্বু তুমি কোথায়' বলে ডাকে? তুমি কি জাগ্রত আব্বু, তুমি কেন শোনো না বলে আকুতি জানায়!
স্মৃতিচারণ থেকে- ''আব্বু, তুমি কোথায় আছো? আব্বু, আমার আব্বু? এখনি চ'লে এসো, আব্বু। এখনি চ'লে এসো। আমার ঘুম আসে না, আম্মুর ঘুম আসে না।
আমার খেতে ইচ্ছে করে না, আম্মুর খেতে ইচ্ছে করে না। আমি চুপ ক'রে ব'সে থাকি। আম্মু চুপ ক'রে ব'সে থাকে।...''
এমন হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়ে বইটি সাজানো, যা বাবাহারা পুত্রের আকুতিকে উপলব্ধি করতে সহযোগিতা করে। 'তোমার জন্য আমাদের কারো ঘুম হয় না, আব্বু।' জীবনের এ ডায়ালগটি যাঁরা পিতৃহারা হয়েছেন, তাঁরা অনুভব করতে পারবেন। যাঁরা বাবাকে হারিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে কিংবা কোনো হঠাৎ ঝড়ে!
এভাবেই বইয়ের পরিধি বেড়েছে। আকুলতা বেড়েছে। বাবাকে হারানোর বেদনার প্রকাশ ঘটেছে। যে ঘটনাকে কখনও নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার ইচ্ছা জাগে। কখনওবা অজান্তেই আপ্লুত হয়ে যেতে চাই। আব্বুকে ফিরে পেতে চায়, আব্বু ফিরে আস, গান গাইব; পরীদের সঙ্গে গল্প করব! কিন্তু আব্বু যে দেশের জন্য জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন, দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করেছেন। এ বোধ তো ছোট্ট কিশোরের মনকে শান্ত করতে পারে না।
যে কোনো সাহিত্যেই শিক্ষণীয় বিষয় থাকলে, সেটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- বিষয় :
- বইয়ের ভুবন
- লাবণী মণ্ডল