ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

শরীরে সিসা নারী-শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি

শরীরে সিসা নারী-শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি

দূষণের সঙ্গে বাড়ছে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি

ইমরান হোসেন

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২২ | ২৩:৫১

দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু শরীরে উচ্চমাত্রার সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলছে, বড় হয়ে তাদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার শঙ্কাও প্রবল- আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থা ইউনিসেফের উদ্যোগে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআর,বির সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। নারী-শিশুর ওপর দূষণ ও সিসার এ প্রভাব নিয়ে লিখেছেন ইমরান হোসেন

সিসা আমাদের অজান্তেই নীরব ঘাতক হিসেবে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। সিসার ক্ষতিকারক প্রভাব এতটাই ভয়াবহ যে, এটি শিশুর মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবে অপরিপকস্ফ হওয়ার পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে ভয়ের কথা- অন্তঃসত্ত্বা নারী ও গর্ভের ভ্রূণের ক্ষেত্রে সিসার প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ। তা ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর রক্তে অতিরিক্ত সিসা অপরিণত শিশুজন্মের কারণ হতে পারে। গ্রাম এলাকায় পরীক্ষা করা ৩০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। সিসা মিশ্রিত হলুদের গুঁড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে উচ্চমাত্রার সিসার উপস্থিতির অন্যতম কারণ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বেশ কয়েক বছর থেকেই অসুস্থ, অপরিণত, প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক শিশু জন্ম নেওয়ার হার বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থা ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) সম্প্রতি পরিচালিত গবেষণায় ঢাকাসহ দেশের পাঁচ জেলায় শতভাগ শিশুর শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, ব্যাটারি পুনর্ব্যবহারের কারখানা, ফেলে দেওয়া ইলেকট্রনিক সামগ্রী, রং, অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের তৈজসপত্র, কসমেটিকস, জালের কাঠি, খাবারের প্যাকেটে ব্যবহূত রং, খেলনা, ধাতব গহনাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্যে ব্যবহূত সিসা থেকে এর বিষক্রিয়া ছড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশু বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত।

গবেষণা প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝুঁকি এবং সমস্যাগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সিসা মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকির কারণ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মানবসম্পদকে মানবশক্তিতে পরিণত করার ব্যাপারে অনেক বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত; সিসার প্রভাবে কোনো নারী ও শিশু আক্রান্ত হলে সেটি দেশ ও জাতির জন্য আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করবে। ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) ধারণা মতে, সিসাদূষণের কারণে বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে এবং শুধু ২০১৯ সালেই প্রায় দুই কোটি বছরের বেশি সুস্থ জীবনকাল ব্যাহত হয়েছে। পরিবেশ দূষণ ও সিসার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, পাশাপাশি সরকার এবং মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে আইসিডিডিআর,বির প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমান সমকালকে জানান, তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণা শিশুর ওপর পরিচালনা করা হয়। তবে পূর্ববর্তী গবেষণায় তাঁরা অন্তঃসত্ত্বা নারীর বিষয়টিও দেখেছিলেন। ঢাকা শহরে ২৪ থেকে ৪৮ মাস বয়সী ৫০০ শিশুর ওপর তাঁরা এই গবেষণা পরিচালনা করেন। শিশুর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করার পর দেখা যায়, সব শিশুর রক্তেই সিসার উপস্থিতি রয়েছে। তিনি বলেন, 'সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সিসা শিশুর মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা বেশি থাকে, তারা যখন বড় হয়, তাদের আচরণগত সমস্যা থাকে এবং তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। সিসার উপস্থিতি শিশুর পড়াশোনার আগ্রহ, উদ্ভাবনী শক্তি ও অন্যান্য কাজের আগ্রহ কমিয়ে দেয়।' এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, 'সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ওয়ার্কশপ আয়োজন ও টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করলেও সেটি পর্যাপ্ত নয়। এটি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা আবশ্যক।'

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাকিল আহম্মদ বলেন, 'সিসা এক ধরনের বিষ। এটি মানুষের শরীরে সামান্যতম উপস্থিতিতেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকলাঙ্গ করে ফেলতে পারে। শিশুর মস্তিস্কের গঠনের সময় সে যদি সিসা দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে তার মস্তিস্কের ব্যাপক ক্ষতি হয়। মস্তিস্কের ক্ষতি স্থায়ী ক্ষতি, এটি পূরণ হয় না। শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ থেকে শুরু করে অন্যান্য বিকাশ প্রচণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়।' তিনি আরও বলেন, 'সিসা শরীরে গেলে রক্তশূন্যতা হয়। ফলে অ্যানিমিয়া হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। সিসা সবার ওপরে প্রভাব ফেললেও শিশুর বিকাশমান শরীরের জন্য বেশি ক্ষতিকর। অন্তঃসত্ত্বা নারীর সুস্থ শিশু জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ওপর সিসার প্রভাব মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।' এই শিশু যক্ষ্ণা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সার্বিকভাবে দেশকে সিসামুক্ত করতে হবে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, 'সরকার পেট্রোল থেকে সিসামুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে, এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীকে সিসার ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। ক্যাম্পেইন ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পুরো দেশের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারলে আশানুরূপ অগ্রগতি সম্ভব।' এর পাশাপাশি তিনি আইন প্রণয়নের দিকটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হকের মতে, 'বাংলাদেশ অনেক বেশি দূষণের সম্মুখীন। দূষণের কারণে বাতাসের মাধ্যমে শাকসবজি এবং অন্যান্য খাবারে সিসার উপস্থিতি থাকছে। খাবারের মধ্যে ভেজাল থাকলে সেটা অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর জন্য অনেক ক্ষতিকর। ভেজালমুক্ত খাবার আমাদের প্রত্যেকের অধিকার।' খাবার ভেজালমুক্ত করতে সরকারের আরও শক্ত ভূমিকা প্রয়োজনীয় বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, 'আমরা শুধু অর্থনীতি এবং আয়-ব্যয়ের জায়গায় মনোযোগ দিয়েছি; কিন্তু স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত জায়গায় মনোযোগ না দেওয়ার কারণে বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সিসা শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে মানসিক স্বাস্থ্যও প্রভাবিত হচ্ছে।' অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুকে এই ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে রেস্টুরেন্ট, পরিবার, স্কুল সব জায়গাতেই খাবারের হাইজিন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম. আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, 'সিসা মায়ের দুধের গুণাগুণে প্রভাব ফেলছে। সিসার প্রভাবে অনেক সময় শিশুর মস্তিস্কের সঠিক গঠন হচ্ছে না। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে যেসব শিশু বিকলাঙ্গ, তারা সমাজের অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।' তাঁর মতে, 'ওয়েস্টার্ন ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্সের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার না জেনে আমরা সার্বিক উন্নয়নে ব্যবহার করে ফেলছি। আমরা ফসলের অধিক ফলনের জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করছি। খাবারের মাধ্যমে সিসা গ্রহণ করে ফেলছি- যেটা নারী, শিশু এবং সবার জন্যই বিপজ্জনক।' এ থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে তিনি বলেন, 'বৈশ্বিক কাঠামোকে পুনঃসংস্কার করতে হবে। আইন এবং আদেশের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি তৃণমূলের সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।'

আরও পড়ুন

×