স্মৃতি
আমাদের র্যাংকিন স্ট্রিটের বাড়িটা

সালেহা চৌধুরী
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০
আমাদের বাড়িটার নাম ছিল ধল্লা হাউস। নিচে আমার বাবার স্কুল টেক্সট বোর্ডের অফিস আর ওপরে থাকতাম আমরা। ওয়ারীর সেই বাড়ির পাশের বাড়িতে থাকতেন ডাক্তার নন্দী। তাঁর মেয়ে মন্দিরা নন্দী আমার বন্ধু। আমরা রোজ একসঙ্গে হলি ক্রস কলেজে যাই। র্যাংকিন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঠাটারিবাজারের সারি সারি মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে, গুলিস্তান ছাড়িয়ে আমাদের রিকশা চলেছে। আমরা দু'জন গল্প করতে করতে একসঙ্গে চলেছি। সময় ৬০-৬১ সাল। তখন আমরা একটু একটু করে শামসুর রাহমানকে জানছি। আমরা তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করছি। তাঁর 'একান্ত গোলাপ' নিয়ে আলোচনা করছি। হয়তো আমরা দু'জনেই শামসুর রাহমানের একান্ত গোলাপ হতে চেয়েছি। কিংবা আলোচনা ও আবৃত্তি করেছি তাঁর 'দুঃখ' নামের কবিতা। আলোচনা করেছি জীবনানন্দের কবিতা। সেই উপমা- পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে। তারপর কথার মাঝখানে এসে পড়েছে বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, সন্তোষ সেন গুপ্ত, সুবোধ ঘোষ- এইসব। প্রতিভা বসুর 'সুমিত্রার অপমৃত্যু' নিয়ে কথা বলতে বুকে ব্যথা লাগছে, আবার কষ্ট হচ্ছে 'সমুদ্র হৃদয়' নিয়ে কথা বলতে। এসবের পর আমরা একসময় পৌঁছে গেছি আমাদের হলি ক্রস কলেজে। শুভ্র সুন্দরী 'নান' সেখানে আমাদের পড়ান। যেখানে পড়াশোনায় আনন্দ কোথায়? কোনো কিছু না পারলে আমাদের ক্লাসের পর আটকে রাখা হয়। যখন সে বিষয় ঠিকমতো আয়ত্তে আসে, আমরা বাড়ি যেতে পারি। লজিকের 'সিলোজিজম' বা কিটসের কোনো কবিতা মুখস্থ হয়নি কেন- এইসব নানা ঘটনা। কলেজে যেতে রিকশা ভাড়া এক টাকা। ফিরে আসি মন্দিরার বাবার গাড়িতে। কলেজ থেকে বাড়ি এসে, এক কাপ চা হাতে সোজা ছাদে। মন্দিরার কাছ থেকে ধার পাওয়া বই না হলে ধল্লা হাউসের ওপরতলার লাইব্রেরি থেকে পাওয়া কোনো বই। তখনই পড়েছি আমি 'তেইশ নম্বর তৈলচিত্র', ইবনে ইমামের 'চিত্র বিচিত্র' এবং আরও নানা বই। লাইব্রেরির চাবি থাকে আমার বাবার কাছে। সন্ধ্যার পর সেই লাইব্রেরিতে আমি একা। বেশ লাগে। ও বাড়ির ছাদ থেকে মন্দিরা বলে-
এই শোন, আগামী শুক্রবার আমার সঙ্গে প্রেস ক্লাবে যাবি।
বলি-
কেন?
ও বলে-
জহির রায়হান আসছেন।
আমি বলি-
আচ্ছা।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানি আমার মা মন্দিরার মায়ের মতো নন, তিনি কিছুতেই ওসব প্রেস ক্লাবটদ্মাব করতে দেবেন না। ভাবলাম থাক মাকে বলবার দরকার নাই। বলব ওদের বাড়িতে বেড়াতে যাব। তারপর আমি আর মন্দিরা একেবারে 'শেষ বিকেলের মেয়ে'র মতো জহির রায়হানের সামনে। ভাবতেও বুকের ভেতর সুখপাখি ডানা ঝাপটায়। কারণ, আমরা দু'জনেই তখন জহির রায়হানের ভক্তপাঠক এবং এক কথায় অনুরাগী। খুব ভালো করে সাবানঘষা মুখে প্রচুর স্নো-পাউডার ঢেলে চুল বেঁধে যাব বলে প্রস্তুত। মা বলেন-
শোন, আজ আমি রাজিয়াবুকে দেখতে যাব। তুই যাবি আমার সঙ্গে।
আমি বলি-
না। আজ মন্দিরাদের বাড়িতে আরও অনেকে আসবে। মা তুমি কাল যাও রাজিয়াখালাকে দেখতে।
আমি ভয়ে ভয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাই- আমার মায়ের জহুরি চোখ কি বুঝতে পেরেছে, মন্দিরাদের বাড়ি আসলে অজুহাত। আমরা চলেছি অভিসারে। পাউডার কি খুব বেশি হয়ে গেছে? চোখের কাজল? ঠোঁটে হালকা একটু রং, তাও কি আমার মায়ের চোখে পড়েছে, ভ্রু আরও একটু কালো করার প্রয়াস?
মা বলেন-
প্রায় প্রতিদিন তুই মন্দিরাদের বাড়িতে যাস। একদিন না গেলে কী হবে।
এরপর মা কাপড় পরতে চলে যান। দোতলার বারান্দায় বাবা কী সব লেখালেখি করছেন। আমি টুক করে যে চলে যাব তারও উপায় নেই। জহির রায়হানের জন্য দু-একটা চড়-থাপ্পড়! ও আর এমন কী? কিন্তু বাবাকে মা যে কী বলেছেন কে জানে! বাবার সামনে দোতলা থেকে নিচে নামার লোহার গেট। বন্ধ। চাবি মায়ের কাছে। বাবা বলেন-
মা রুনু, তোর মায়ের তো কাপড় পরা হয়নি। চট করে এক কাপ চা বানিয়ে আন তো।
যাওয়া হলো না। মন্দিরা আমার জন্য অপেক্ষা করে ওর দিদি ইন্দিরাকে নিয়ে চলে গেছে।
সন্ধ্যার ছাদে চাঁদ। মন্দিরাদের ছাদ খালি। আমি আলসেতে বুক লাগিয়ে লোকজন দেখছি। আমার তখন খুব কান্না পাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি। বুকে ব্যথা। একসময় নিচে নেমে আমি একটি কবিতা লিখি। বেদনা নিয়ে কবিতা সেই প্রথম। আমি কবিতা লিখেছি শামসুর রাহমানের 'জার্নাল, শ্রাবণ' ভেবে- 'বাগানের দরজা খুলে ফাল্কগ্দুনের বিহ্বল সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে/ এসো শিশিরের মত স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে, হাওয়ায়/ প্রীত তুমি মৃদু টোকা দেবে না দরজায়।'
আমি লিখেছি- 'তোমাকে দেখিনি কোনোদিন, পাইনি কাছে/ আজ তাই তোমার ছবি আমার বুকের ভেতর/ চিরকালের শিশির, গাঁথা হয়ে আছে।'
এমনিভাবে ষোলো লাইনে আমার বিষাদ কবিতার রূপ নিয়েছে। পুরো কবিতা আমার মনে নেই। এমন অনেক কবিতা হারিয়ে গেছে। লুকিয়ে রেখেছি। পরে পাইনি। খুঁজে পেলে বেশ হতো। আর কখনও মন্দিরা এইসব যাওয়ায় আমাকে ডাকেনি। আমি এরপর আর কোনোদিন জহির রায়হানকে দেখিনি। শামসুর রাহমানকেও নয়। ও দেখেছে। দীর্ঘ পথে সেসব গল্প শুনেছি। ওর মা আমার মায়ের মতো কঠিন নন। তাই একদিন দেখি ও চৌধুরী আবদুর রহিমের সঙ্গে একই রিকশায় বাসার সামনে এসে রিকশা থেকে নামে।
বলি-
একই রিকশায়? তোর মা কিছু বলবেন না?
না। মা-ই তো যেতে বললেন। বললেন, যাও নিউমার্কেট থেকে এসব কিনে আনো।
আমি অবাক হয়ে ওকে দেখি। ও হাসতে হাসতে সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি চলে যায়, আমি বাড়ি ফিরে আসি।
মন্দিরা আমাকে অনেক সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে, বিবিধ বই পড়িয়েছে, ওদের গল্প করেছে, আমাকে বোরিস পেস্টারনেক নিয়ে কথাও বলেছে। ও আমার সামনে একটি আলোর প্রদীপ তুলে ধরেছে। আর ভালোবেসে আমার নাম দিয়েছে- দিঠি। কারণ? ও কারণ বলেনি।
র্যাংকিন স্ট্রিটের বাড়ি আর মন্দিরা অবিচ্ছেদ্য। আর আমার ভালো লাগা সেইসব বই। আমার বাড়ির ছাদ। সবকিছু ছাপিয়ে আছে জহির রায়হানকে দেখতে যেতে না পারার বেদনা। আমার প্রথম বেদনার কবিতা।
এই শোন, আগামী শুক্রবার আমার সঙ্গে প্রেস ক্লাবে যাবি।
বলি-
কেন?
ও বলে-
জহির রায়হান আসছেন।
আমি বলি-
আচ্ছা।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানি আমার মা মন্দিরার মায়ের মতো নন, তিনি কিছুতেই ওসব প্রেস ক্লাবটদ্মাব করতে দেবেন না। ভাবলাম থাক মাকে বলবার দরকার নাই। বলব ওদের বাড়িতে বেড়াতে যাব। তারপর আমি আর মন্দিরা একেবারে 'শেষ বিকেলের মেয়ে'র মতো জহির রায়হানের সামনে। ভাবতেও বুকের ভেতর সুখপাখি ডানা ঝাপটায়। কারণ, আমরা দু'জনেই তখন জহির রায়হানের ভক্তপাঠক এবং এক কথায় অনুরাগী। খুব ভালো করে সাবানঘষা মুখে প্রচুর স্নো-পাউডার ঢেলে চুল বেঁধে যাব বলে প্রস্তুত। মা বলেন-
শোন, আজ আমি রাজিয়াবুকে দেখতে যাব। তুই যাবি আমার সঙ্গে।
আমি বলি-
না। আজ মন্দিরাদের বাড়িতে আরও অনেকে আসবে। মা তুমি কাল যাও রাজিয়াখালাকে দেখতে।
আমি ভয়ে ভয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাই- আমার মায়ের জহুরি চোখ কি বুঝতে পেরেছে, মন্দিরাদের বাড়ি আসলে অজুহাত। আমরা চলেছি অভিসারে। পাউডার কি খুব বেশি হয়ে গেছে? চোখের কাজল? ঠোঁটে হালকা একটু রং, তাও কি আমার মায়ের চোখে পড়েছে, ভ্রু আরও একটু কালো করার প্রয়াস?
মা বলেন-
প্রায় প্রতিদিন তুই মন্দিরাদের বাড়িতে যাস। একদিন না গেলে কী হবে।
এরপর মা কাপড় পরতে চলে যান। দোতলার বারান্দায় বাবা কী সব লেখালেখি করছেন। আমি টুক করে যে চলে যাব তারও উপায় নেই। জহির রায়হানের জন্য দু-একটা চড়-থাপ্পড়! ও আর এমন কী? কিন্তু বাবাকে মা যে কী বলেছেন কে জানে! বাবার সামনে দোতলা থেকে নিচে নামার লোহার গেট। বন্ধ। চাবি মায়ের কাছে। বাবা বলেন-
মা রুনু, তোর মায়ের তো কাপড় পরা হয়নি। চট করে এক কাপ চা বানিয়ে আন তো।
যাওয়া হলো না। মন্দিরা আমার জন্য অপেক্ষা করে ওর দিদি ইন্দিরাকে নিয়ে চলে গেছে।
সন্ধ্যার ছাদে চাঁদ। মন্দিরাদের ছাদ খালি। আমি আলসেতে বুক লাগিয়ে লোকজন দেখছি। আমার তখন খুব কান্না পাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি। বুকে ব্যথা। একসময় নিচে নেমে আমি একটি কবিতা লিখি। বেদনা নিয়ে কবিতা সেই প্রথম। আমি কবিতা লিখেছি শামসুর রাহমানের 'জার্নাল, শ্রাবণ' ভেবে- 'বাগানের দরজা খুলে ফাল্কগ্দুনের বিহ্বল সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে/ এসো শিশিরের মত স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে, হাওয়ায়/ প্রীত তুমি মৃদু টোকা দেবে না দরজায়।'
আমি লিখেছি- 'তোমাকে দেখিনি কোনোদিন, পাইনি কাছে/ আজ তাই তোমার ছবি আমার বুকের ভেতর/ চিরকালের শিশির, গাঁথা হয়ে আছে।'
এমনিভাবে ষোলো লাইনে আমার বিষাদ কবিতার রূপ নিয়েছে। পুরো কবিতা আমার মনে নেই। এমন অনেক কবিতা হারিয়ে গেছে। লুকিয়ে রেখেছি। পরে পাইনি। খুঁজে পেলে বেশ হতো। আর কখনও মন্দিরা এইসব যাওয়ায় আমাকে ডাকেনি। আমি এরপর আর কোনোদিন জহির রায়হানকে দেখিনি। শামসুর রাহমানকেও নয়। ও দেখেছে। দীর্ঘ পথে সেসব গল্প শুনেছি। ওর মা আমার মায়ের মতো কঠিন নন। তাই একদিন দেখি ও চৌধুরী আবদুর রহিমের সঙ্গে একই রিকশায় বাসার সামনে এসে রিকশা থেকে নামে।
বলি-
একই রিকশায়? তোর মা কিছু বলবেন না?
না। মা-ই তো যেতে বললেন। বললেন, যাও নিউমার্কেট থেকে এসব কিনে আনো।
আমি অবাক হয়ে ওকে দেখি। ও হাসতে হাসতে সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি চলে যায়, আমি বাড়ি ফিরে আসি।
মন্দিরা আমাকে অনেক সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে, বিবিধ বই পড়িয়েছে, ওদের গল্প করেছে, আমাকে বোরিস পেস্টারনেক নিয়ে কথাও বলেছে। ও আমার সামনে একটি আলোর প্রদীপ তুলে ধরেছে। আর ভালোবেসে আমার নাম দিয়েছে- দিঠি। কারণ? ও কারণ বলেনি।
র্যাংকিন স্ট্রিটের বাড়ি আর মন্দিরা অবিচ্ছেদ্য। আর আমার ভালো লাগা সেইসব বই। আমার বাড়ির ছাদ। সবকিছু ছাপিয়ে আছে জহির রায়হানকে দেখতে যেতে না পারার বেদনা। আমার প্রথম বেদনার কবিতা।
- বিষয় :
- স্মৃতি
- সালেহা চৌধুরী