ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জীবনের গল্প শুনি

জীবনের গল্প শুনি

অনাথ শিশুদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে বিদ্যানন্দ

সত্যজিৎ বিশ্বাস

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০৫:১৭

'পড়বো, খেলবো, শিখবো'- এ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে বিদ্যানন্দের কার্যক্রম শুরু হয়। এখন সে কাজ সারাদেশে ছড়িয়েছে। বেড়েছে কাজের পরিধি। লিখেছেন সত্যজিৎ বিশ্বাস

গল্প-১
'এই পুরো লাউটাই আমার? বলো কি বাবা? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।' কোরমা-পোলাও লাগে না গরিবের মুখে হাসি ফোটাতে। সামান্য শাকসবজি পেলেই যেন বিশ্বজয়ের হাসি এসব মানুষের মুখে। অনেকেই যখন ভাবছেন, এইবার বুঝি বিদ্যানন্দ কৃতিত্ব দাবি করবে। ঠিক তখনই বিদ্যানন্দ সরল স্বীকারোক্তি দেয়- না, কিনে আনিনি তো এসব। এগুলো এসেছে রাজধানীর বিভিন্ন অনলাইন শপ থেকে। অবিক্রীত পণ্যগুলো তারাই আমাদের হাতে তুলে দেন দরিদ্র মানুষের কল্যাণে। এতেই হাসি ফুটে দরিদ্র পরিবারগুলোর ভাঙা ঘরে।

গল্প-২
শুস্ক মরুভূমির মতো প্রান্তরে খাবার ভর্তি পাতিল নিয়ে অবিরাম ছুটে চলেছেন একদল তরুণ। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী তাঁরা। দুর্গম পথ দেখে যেখানে বাকিরা মুখ ফিরিয়েছেন, সেখানে বিদ্যানন্দের সদস্যরা হাল না ছেড়ে ছুটেছেন ক্ষুধার্ত মানুষের খোঁজে। চরাঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির কাছে যেন বারবারই অসহায়। সেসব মানুষের মুখে আহার তুলে দিতে স্বেচ্ছাসেবীদের এই শ্রম। তাঁদের এই শ্রম আর ভালোবাসার নাম বিদ্যানন্দ।

গল্প-৩
'ধরে দেখেন চাচা, লুঙ্গি আপনার পছন্দ হয় কিনা?'
'হ মা, লুঙ্গি তো নতুন। কাপড়টাও আরাম হবে মনে হয়। কয় টাকা দেওয়া লাগবে?'
'এক টাকা দেওয়া লাগবে চাচা।'
মলিন পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক টাকা বের করে এগিয়ে দিলেন বৃদ্ধ চাচা। আর কিনে নিলেন নিজের পছন্দের লুঙ্গিটি। বিদ্যানন্দ ত্রাণের কাপড় দিয়ে দানবীর হতে চায় না। চায়, মানুষকে পছন্দ করার স্বাধীনতা দিতে। যেটা অবস্থাসম্পন্ন মানুষ বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমলে গিয়ে করেন। ঘুরে ঘুরে নিজের কাপড় কেনার ইচ্ছাটুকু পূরণ করতে এসেছে বিদ্যানন্দের ভ্রাম্যমাণ মার্কেট।

গল্প-৪
নাতনির পছন্দের খাবারগুলো এক এক করে প্লেট ভর্তি করে নিয়েছেন দাদি। তারপর লোকমা ধরে মুখে তুলে দিচ্ছেন পরম যত্নে। অন্যদিকে, ময়লা লুঙ্গি আর দানের এক বিবর্ণ কোট পরা বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে এসেছেন দূরের গ্রাম থেকে। খাওয়া শেষে বিল চাইলে কোমরে গুঁজে রাখা কয়েনটি বের করে এগিয়ে দেন তাঁরা। খাবার শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা মানুষের খুশির সাক্ষী হয়ে থাকল কুড়িগ্রামের হলোখানা ইউনিয়নের চর সুভার কুটি।

গল্প-৫
শীতের সবজি চলে যাচ্ছে। অথচ সে সবজিও চড়া দামের কারণে গরিবের কপালে জোটে না।'সন্ধ্যার পর বাজারে অপেক্ষায় থাকি বাবা, যদি অল্প পয়সায় বাসি সবজিগুলো কেনা যায়।'

'চাচি, সব মিলিয়ে ১০০ টাকার সবজি নিতে পারবেন। কিন্তু দিতে হবে ২ টাকা। এবার বলেন, কোনটা কোনটা নেবেন আপনি?'
খেটে খাওয়া মানুষের জন্য 'দুই টাকায় বাজার' বসিয়েছে বিদ্যানন্দ। প্রতিদিন কোনো না কোনো বস্তিতে যাচ্ছেন তাঁরা আর দুই টাকায় ব্যাগভর্তি সুখ কিনে নিয়ে যাচ্ছে দুস্থ পরিবারগুলো।

ওপরের গল্পগুলো সবই বাস্তব। এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, তার নাম বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ। জন্ম চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম বলে অবহেলা, বঞ্চনা আর দারিদ্র্যের সংগ্রামে নিজেদের টিকিয়ে রাখাটাই তাঁদের কাছে দুঃসাধ্য ছিল। এক সময় মন্দিরে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করা সে মানুষটি প্রতিষ্ঠিত হলেন। চুয়েট থেকে পাস করে প্রকৌশলী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেন। জীবনের অনেক বাঁক পেরিয়ে কিশোর কুমার দাশ এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে বসবাস করছেন। সাতটি এতিমখানা, দুটি স্কুল ও চারটি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে বিদ্যানন্দ। বিশাল কোনো পরিকল্পনা নিয়ে নয়, বরং দেশের সাধারণ মানুষের সহযোগিতা নিয়ে বিদ্যানন্দ চায় ভালো কাজে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে। এতেই বিদ্যানন্দের সার্থকতা। অস্থিরতা, দারিদ্র্য, হিংসা, হানাহানির ভীষণ অন্ধকারের মাঝে আশার আলো হয়ে পথ দেখিয়ে যাচ্ছে বিদ্যানন্দ। নির্মোহ এ পথ চলার ধারাবাহিকতায় এবার সংগঠনটি সমাজসেবা বিভাগে একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছে। অব্যাহত এ পথচলায় সমাজে বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে বিদ্যানন্দ। যেখানে তাঁরা আনন্দ খুঁজে পান।

লেখক :কার্টুনিস্ট, সমাজকর্মী

আরও পড়ুন

×