ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’

নারীসত্তার মানবিক অভিঘাত

নারীসত্তার মানবিক অভিঘাত

আবু সাঈদ তুলু

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৩ | ০৪:২০

মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে স্বাধীনতা-উত্তর দেশে অনেকে অভূতপূর্ব সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। নারী মুক্তিযোদ্ধারা কী পেয়েছেন? ধর্ষিতার গ্লানি ছাড়া তাঁদের ভাগ্যে আর কী জুটেছে? জুটেছে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত জীবন। ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিও তাদের চিড়িয়াখানার জন্তুতে পরিণত করেছে। সেই বীভৎস রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে নারীর অসহায়ত্বে যেন দর্শকের মন কেঁদে-কেঁপে উঠছিল।

নাটকটির শিরোনাম– ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। স্পর্ধা প্রযোজিত নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। নাটকটির কাহিনি গ্রহণ করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম রচিত বীরাঙ্গনা নারীর আত্মজীবনীমূলক ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গল্পগ্রন্থ থেকে। এতে মুক্তিযুদ্ধে সাতজন বীরাঙ্গনার বীভৎস অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। নাট্যনিদের্শক সেই সাতজন বীরাঙ্গনাকে মঞ্চে এনে দু’জনের আত্মকাহিনি উপস্থাপন করেছেন। এ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতাসহ যুদ্ধোত্তর সময়ে নিগৃহীতের মর্মপীড়া অনবদ্য শিল্প আলেখ্যে নান্দনিক কুশলে উপস্থাপিত হয়েছে।

 “আমি একজন বীরাঙ্গনা। ...তা লোকচক্ষে রয়ে গেলাম ‘বারাঙ্গনা’।” গানে গানে সাতজন নারী যখন মঞ্চে আক্ষেপের সুর তোলেন, তখন বীরাঙ্গনা নারীদের যে হৃদয়ভরা কষ্ট-ক্ষোভ, অসীম যন্ত্রণা– তা শ্লেষাত্মকভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দর্শকের কাছে। ‘ময়না’ চরিত্রে শারমিন আক্তার শর্মীর দেহ-মনের গহিনে সেই কষ্ট যেন ঠিকরে উঠছিল। ভারী, ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে শুরু করেন নির্মম অভিজ্ঞতা। তিনি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার ছাত্রীলীগের সদস্য ছিলেন। তারপর ২৫ মার্চের কালরাত, গ্রামে চলে যাওয়া, থানায় বন্দি, রাজাকারদের নির্মমতা, অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাকিস্তানি হানাদারদের ঘৃণ্য আচরণ যেন ভুলতে পারেন না।

ময়নার কষ্ট-আবেগ শারীরিক নানা ক্রিয়ার কোরিওগ্রাফির মঞ্চমায়ায় আলো-আঁধারির বুননে সংগীতের নিনাদে দৃশ্যমান। ‘ঢাকায় গণহত্যা, জগন্নাথ হলে গণকবর, ঠিক তেমনি প্রতি রাতে গণধর্ষণ।’ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ময়নাকে সইতে হয় অসম্মান আর নিঃগৃহীতের যন্ত্রণা। স্বামী-সংসার পেলেও রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে ময়নার জীবন বিধ্বংস। অন্যদিকে মেহেরজান। মহসিনা আক্তারের ভাবে-ভাষায়, চলনে-বচনে পুরুষের লালাসিক্ত জন্তুর আঁচড়। জীবনের দীর্ঘ আট মাসের অভিজ্ঞতা, অনুভব-উপলব্ধি নারী জন্মকেই নানাভাবে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। মেহেরজানের বাড়ি ছিল কাপাসিয়ায়। ওই এলাকার তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন বলে এলাকার মানুষ ছিল মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সমর্থক। মঞ্চে মেহেরকে দেখতে পাওয়া যায় প্রায় সাদা শাড়ি পরা। মেহের ফিরে যান অতীতে– ‘হ সাব, এইডাই মেহেরজানগো বাড়ি, বহুত খুব সুরত লেড়কি।’ আতঙ্কিত মেহেরকে দরজা ভেঙে যখন পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে যায়, তখন অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া বালিকা মেহের কী বোঝেন জীবন কিংবা রাষ্ট্রের হিসাব! সংগীতের অপূর্ব কষ্টের নিনাদ আর অভিনয়, কোরিওগ্রাফিতে যেন বেদনাগুলো দৃশ্যমান। ‘চুপ খানকি’ বলে অপমানও যেন দর্জি বাবার জোয়ান অব আর্ককে মুক্তির পথ দেখাতে পারে না।

অন্ধকার প্রকোষ্ঠে চলে নির্মম নির্যাতন। প্রথম প্রহর কাঁদতে হতো পশুদের অত্যাচারে, বাকি রাত মনের কষ্ট আর দেহের যন্ত্রণা ভোগ করে। আত্মহত্যা করারও কোনো উপায় ছিল না। আত্মসম্মান বাঁচাতে যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানে চলে গিয়েও কোথাও কি নারীত্বের মর্যাদা পেয়েছেন? জামিল আহমেদ বরাবরই মঞ্চে ইঙ্গিতময় বাস্তবতা নির্মাণ করেন। এ নাটক তার ব্যতিক্রম নয়। আলোর নানা অর্থ যেমন আবেগের গভীরতাকে উস্কে দেয়, তেমনি মিউজিকের অনবদ্যতা হৃদয়ের অতলকে নাড়া দিয়ে যায়। গল্পকথনের সুরে, দৃশ্য নির্মাণের অলংকরণে ভালো লাগা ছুঁয়ে যায়।

সংলাপ প্রক্ষেপণ, বিশ্বাসযোগ্য চলন, শারীরিক ভঙ্গি, অভিনয়ের যুগপৎ সম্মিলনে অনবদ্য। এ জাতীয় দালিলিক বিষয়ে নাট্যনির্মাণ কঠিন হলেও নাটকটির শিল্পমাত্রা আবেগে আপ্লুত করে। আসলে বীরাঙ্গনা যে বারাঙ্গনা নয়, সেটিই এ নাটক বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। 

আরও পড়ুন

×