ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বইয়ের ভুবন

অন্ধ সময়ের শূন্য বাস্তবতা

অন্ধ সময়ের শূন্য বাস্তবতা

অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে, লেখক-ইমতিয়ার শামীম, প্রকাশক-কথাপ্রকাশ, প্রচ্ছদ-সব্যসাচী হাজরা, দাম-১৫০ টাকা

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

উপন্যাসের শিল্পরূপ বা শিল্পসাফল্য সাধারণত নির্ভর করে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান আখ্যান বা কাহিনি ও চরিত্রের ওপর। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ নাম, প্রেক্ষাপট, পটভূমি, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার, বিভিন্ন পরিচর্যার প্রয়োগ, বর্ণনায় বিভিন্ন রীতির প্রয়োগ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-অলংকারের ব্যবহারও উপন্যাসকে ভিন্নমাত্রা দেয়। এ ছাড়াও লেখকেরা প্রায়ই আখ্যান বর্ণনায় বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে থাকেন। উপন্যাসের শিল্পরূপ বিশ্লেষণে এ সবকিছুই বিচার্য। যে বিচার্য বিষয় নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা রয়েছে। মতভিন্নতা রয়েছে।
যে কোনো লেখকের নিজস্বতা জরুরি। নিজস্ব শব্দশৈলী, ভাষাশৈলী ও চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটিয়েই লেখার তাৎপর্য গুরুত্ববহ করে তোলা যায়। একজন লেখককে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হলে, তাকে দৃশ্যশিল্পী হতে হয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়। কথাশিল্পী ইমতিয়ার শামীম ‘অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে’ উপন্যাসে সে চেষ্টাই করেছেন।
‘অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে’ বইটির কাহিনি কোনো এক দেশের বা কোনো এক পৃথিবীর বন্দি সময়ে মানুষের কথা দিয়ে শুরু। যারা সময়ের করতালে বন্দি। যেখানে শুধু ভয় আর ভয়। ভয়ের সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন গোটা পৃথিবী। সে পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবার কতটা অসহায়, নিঃসঙ্গ ও কাতর হয়ে উঠতে পারে; সেটি তিনি শব্দের মোহনায় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন।
এক স্থপতির উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে ‘অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে’ উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে চলে। পরিবারে আহাজারি। ডিএনএ টেস্ট। শত শত লাশের ভেতর স্থপতিকে খুঁজে ফিরছে তার স্ত্রী-কন্যা। একের পর এক ধূম্রজাল। স্থপতির ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট মেলেনি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কন্যার সঙ্গে। নতুন নাটক। পরিবারের বাবা-মায়ের সঙ্গে রিপোর্টে মিল পেলেও, নিজ জন্মদাতা কন্যার সঙ্গে মিল না পাওয়াটাই যেন তাদের জীবনে কাল হয়ে উঠল। জীবনকে দুবির্ষহ করে তুলল এক ডিএনএ রিপোর্ট। সাদাসিধে জীবনকে সাগরের ঢেউয়ের মুখে ফেলে দিল। মা-মেয়ের এ জীবনকে বইয়ে বেড়ানোর সঙ্গে লেখক দেখিয়েছেন সমাজে নারীর অবস্থান। নারীর দুবির্ষহ চিত্র। ক্ষমতা ও টাকার দাপট। মেয়ে তার বাবা হারানোর শোকটাও প্রকাশ করতে পারেনি। স্ত্রী বাকরুদ্ধ। নির্বাক। ছলছল দৃষ্টিতে অবাকপানে তাকিয়ে থাকা। প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে ভাবতে থাকেন—টাকা দিয়ে কী ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট ভুয়া বানানো হলো! আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে নরক করে তোলার জন্যই কী এ ষড়যন্ত্র। এই ফ্ল্যাট, অর্থবিত্তই কী জীবনের জন্য বড় দুঃসংবাদ হয়ে উঠল। শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই ফ্ল্যাট ছেড়ে যাওয়ার হুমকি। যে সমাজে স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায়ই স্ত্রী প্রাপ্য মর্যাদা পায় না, সেখানে ডিএন টেস্ট না মিললে সে পরিবারের মেয়েটির বাস্তবিক অবস্থা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে লেখক তাই ফুটিয়ে তুলেছেন। হঠাৎ করেই ডিভোর্স পেপার নিয়ে একদল মানুষ হাজির। কে বা কারা এই মানুষগুলো? তারা এতদিন কোথায় ছিল? মারা যাওয়ার পূর্বেই না কি ডিভোর্স করে গেছেন স্ত্রীকে- ক্ষমতার দাপটে হেরে গেলেন মা-মেয়ে। চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে হলো স্থপতির স্ত্রীকে। শুধু তা-ই নয়- হেনস্তা আর হুমকি। কালো কাচ-ঘেরা মাইক্রোতে কারা যেন তাকে তুলে নিয়ে ঘুরপাক খেল সারাদিন। মেয়ের মনে নানান প্রশ্ন। তবে কী সে তার বাবার কন্যা নয়! মায়ের প্রতি কিছুটা হলেও ক্ষুব্ধ। পরমুহূর্তে ভাবে হয়তো সব ভুয়া। এভাবেই পরিধি বেড়েছে উপন্যাসের।
নতুন জীবন। অনিশ্চিত যাত্রা। কোথায় বাঁধবে বাসা। কোথায় দাঁড় করাবে নিজেদের। মা-মেয়ের জন্য এ এক অদ্ভূত বাস্তবতা। ক্লেদাক্ত, কষ্টকর, কর্কশ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত এসব ঘটনা ঘটে থাকে। কখনও নিজ জীবনে এসে পড়ে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়, কখনওবা সমাজের হাজারও মানুষের সঙ্গে ঘটে। মা-মেয়ের এ যাত্রায় সঙ্গী হয়নি কোনো আত্মীয় কিংবা স্বজন। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে যে যার মতো। যদিওবা কেউ কথা বলেন, তাতে থাকে কৌতুক আর শ্লেষ। এ অনিশ্চিত জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করার তাড়নায় থাকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে। যদিও ইতিমধ্যে ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার পাটও চুকিয়ে গেছে তার। কিচেনের দিকে যায়, আবার ফিরে আসে। নেই কোনো বাজারসদাই। কিন্তু পেটের যন্ত্রণা দমায় কে? ভীষণ ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত।
ঘোর সন্ধ্যায় মায়ের বাসায় ফেরা। মেয়ের অপেক্ষার পালা ভারী হওয়া। মনটা কেমন যেন দিনে দিনে সন্দেহবাতিক হয়ে উঠছে। সবকিছু ঘোলাটে লাগে। অচেনা। অপার্থিব। আকাশে মাঝেমধ্যে যেমন বিদ্যুৎ চমকায়, মনের ভেতর ঠিক একই অনুভূতি হয়। বিধ্বস্ত লাগে। সবকিছু কেমন বিবর্ণ। ভাষাহীন এ হৃদয়ের কথা কে শোধায়?
হঠাৎ মেয়ের কারাগারে যাত্রা। মায়ের খুন হওয়ার দৃশ্য। বাবার ফিরে আসার দৃশ্য কল্পনার জগতে বার বার আসা। এ যেন কোনো ঘোরলাগা গল্প। সেই বিরূপ পরিবেশ, যা আমাদের আশপাশেই বিরাজ করছে। ‘জারজ’ মেয়ে হওয়ার যে ক্ষুব্ধতা তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল, সেই ক্ষোভ থেকেই মাকে মেরে ফেলা। কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে। এগুলো নিত্যদিনের ঘটনা। সংবাদপত্র খুললেই দেখতে পাই এ ধরনের খবর। ছেলের হাতে বাবা খুন, মেয়ের আক্রোশের বলি বাবা-মা। এ যে আমাদের সুললিত, সুন্দর সমাজেরই অপর পিঠ; যা কলুষতা ও অসুন্দরে ভরা।
লেখকদের, বিশেষত ফিকশন লেখকদের ভাষাজ্ঞান ও ভাষার সঠিক প্রয়োগের দক্ষতাটা থাকতে হয়।  ‘অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে’ উপন্যাসটি যদিও পরিসরের দিক থেকে খুব দীর্ঘ নয়, তবে এর অন্তর্লীন বিচ্ছুরণ ভীষণ গভীর। এ গল্প শুধু স্থানিক বাস্তবতা নয়, বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নারীর অবস্থান, কর্তৃত্ববাদী বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে। একজন নিবিড় পাঠক ফিকশনের মধ্য দিয়ে যখন সেই বাস্তবতার দেখা পান, তখন সেটি তাঁর চিন্তা জগতে ও মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাস্তবতা তুলে এনেছেন, সেখানে ভণিতা নেই। জীবনযাত্রার ওই গল্প হয়তো আমার বা আপনার। যে কারণেই লেখককে ‘দৃশ্যশিল্পী’ আখ্যায়িত করা না অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়।

আরও পড়ুন

×