ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ফসলের মাঠ থেকে ক্রিকেটের মাঠে

ফসলের মাঠ থেকে ক্রিকেটের মাঠে

মারুফা আক্তার - ছবি : অনলাইন

আমিরুল হক

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

মারুফা আক্তার। বলা যায়, ১৮ বছর বয়সী এ পেসারের হাত ধরেই এসেছে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ঐতিহাসিক জয়! সেই ম্যাচে তাঁর ২৯ রানে ৪ উইকেটের সৌজন্যে ভারতকে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে হারায় বাংলাদেশ। মসৃণ রানআপ, দুর্দান্ত ইনসুইং এবং উইকেট থেকে মুভমেন্ট আদায় করে নেওয়ার অনন্য দক্ষতা মারুফাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে। এই তরুণ ক্রিকেটারের রানআপ মসৃণ হলেও, জীবন মোটেও মসৃণ ছিল না। কেমন করে গ্রামের ফসলের মাঠ থেকে উঠে এসেছেন জাতীয় দলে– সেই গল্প শুনে লিখেছেন আমিরুল হক

মা রুফার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্পটা এখন দেশ ছাড়িয়ে কেবল ভারতীয় ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করছে না; বিশ্বের যে কোনো দেশের মেয়েদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে স্বপ্নজয়ের সোনালি রেখা। সেই এইটুকুন বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন মারুফা। পড়াশোনার পাশাপাশি ফসলের মাঠে পড়ে থাকা মারুফা নিজের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটাও বাঁচিয়ে রেখেছেন। করেছেন পরিশ্রম। তারপর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভালো করে জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়াটা সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই মনে হবে। চলুন, চিত্রনাট্য থেকে বেরিয়ে তাঁর সত্যিকারের জীবন সংগ্রামটা জেনে নিই–

বিশ্বকে জানান দিতে আসছেন মারুফা… লিকলিকে পাতলা দেহের গঠন আর চেহারায় কৈশোরের ছাপ! এ বয়সেই নারী ক্রিকেট দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন। তাঁর বোলিং অ্যাকশন আর ঝোড়ো গতি ব্যাটারদের কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ভারতবধের যেই ইতিহাস রচিত হয়েছে। তাঁর পাতা সুসজ্জিত করেছেন তিনি ৭ ওভারে ২৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে। তাঁর ক্যারিশমাটিক বোলিংয়ে মুগ্ধ বিশ্ব। তাই তো ২১ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে ভারতের সহঅধিনায়ক স্মৃতি মান্ধানা গাইতে বাধ্য হন মারুফার জয়গান। মান্ধানা বলেন, ‘মারুফা খুব ভালো একজন ক্রিকেটার। গত ম্যাচ শেষে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছি, তার পারফরম্যান্স আমাদের সবাইকে দারুণ অনুপ্রাণিত করেছে। মারুফার বয়স কত, এটি কোনো বিষয় নয়। মাঠে যেভাবে সে নিজেকে উপস্থাপন করছে, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে যেভাবে সে নিজেকে মেলে ধরছে, তা সত্যিই অসাধারণ! মারুফার ভেতরে যে আগুন দেখেছি, তাতে আমি এটা নিশ্চিত যে, সামনের পথচলায় সে বাংলাদেশের জন্য অসাধারণ এক ক্রিকেটার হয়ে উঠবে। তার অ্যাকশন একদমই আলাদা। সে যতটা জোরে বল করে, অ্যাকশনের কারণে সেই বল আরও দ্রুতগতির মনে হয়। মারুফার রিলিজ পয়েন্ট থেকে আমাদের ধারণার চেয়ে একটু বেশি স্কিড করে তার বল। তাই ব্যাটারদের একটু বেশি সচেতন ও প্রস্তুত থাকতে হয়। আমরা এখন যে উইকেটে খেলছি, সেই উইকেট অবশ্যই তাকে খুব একটা সহায়তা করছে না। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় আগামীতে সে কেমন করে, তা দেখার অপেক্ষায় আছি।’

জন্ম ও বেড়ে ওঠা মারুফা আক্তারের জন্ম নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের ঢেলাপীর এলাকায়। বাবা আইমুল্লাহ হক বর্গাচাষি আর মা মর্জিনা বেগম গৃহিণী। মা-বাবা, চার ভাই-বোনসহ ছয়জনের বেশ বড়সড় পরিবার। বড় ভাই আল-আমিন অনার্স করছেন নীলফামারী সরকারি কলেজে। মেজো ভাই আহসান হাবিব একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন কাদিখোল কম্পিউটার কলেজে। তাঁর পিঠেপিঠি বড় বোন মাহফুজা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। গৃহিণী এই বোনের স্বামী কৃষি কাজ করেন। কেবল ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো জায়গা-জমি নেই মারুফাদের। ঘরের যেই ভিটে তাও মারুফার নানার দেওয়া।

ভাইয়ের প্রাইভেট পড়ানো টাকায় ব্যাট-বল ও জাতীয় দলে সুযোগ ছোটবেলা থেকেই ভাই-বোনেরা মেতে থাকেন খেলাধুলায়। তাদের মধ্যে মারুফা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। তাই ছোট বোনের আবদার সাধ্যমতো পূরণ করতেন বড় ভাই আল-আমিন। প্রাইভেট পড়িয়ে সেই বেতনের টাকা দিয়ে বোনের জন্য ব্যাট, বল ও খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনে নিয়ে আসতেন। বড় ভাইয়ের আন্তরিকতা দেখে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন মারুফা। স্বপ্নকে করেছেন আরও প্রসারিত। বাড়ির পাশে কাদিখোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেই মারুফা ভাইয়ের কাছে একদিন বায়না ধরেন সৈয়দপুর শহরে গিয়ে কোচ ইমরানের কাছে ক্রিকেট অনুশীলনের। এতে মা-বাবার চরম আপত্তি থাকলেও তা উপেক্ষা করে রেলওয়ে মাঠে অনুশীলন শুরু করেন মারুফা। এরই মধ্যে ২০১৮ সালে প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে বিকেএসপির নজরে আসেন। তারপর ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক নৈপুণ্য দেখিয়ে ১৮ বছর বয়সেই ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে।

মায়ের বকুনি ও ছোট্ট মেয়ের চ্যালেঞ্জ ফেলে আসা দিনের কথা জানতে চাইলে মারুফা বলেন, ‘ছোটবেলায় ভাইদের সঙ্গে ক্রিকেট খেললে মা-বাবা বকাঝকা করতেন। তবুও আমি পড়ে থাকতাম ক্রিকেট নিয়ে। মা যাতে আমার ওপর রাগ না হন, এ জন্য মায়ের হাতের সব কাজ করে দিতাম। স্কুলে যাওয়ার আগে খুব সকালে বাবার সঙ্গে ক্ষেতে গিয়ে বাবাকেও সাহায্য করতাম। স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া শেষ করেই ব্যাট-বল হাতে ভাই ও পাড়ার ছেলেদের নিয়ে কখনও উঠানে আবার কখনও রেললাইনের পাশে ক্রিকেট খেলতাম। মনে পড়ে, একদিন খেলার কারণে মায়ের হাতে বেদম মার খেয়েছি। এ সময় সবার সামনেই আমি মাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম– দেখ, একদিন আমার স্বপ্ন পূরণ করেই ছাড়ব!’

মারুফার বাবা মারুফার বাবা আইমুল্লাহ হক একসময় যে মেয়েকে ক্রিকেট খেলতে বারণ করতেন, দিতেন বকাঝকা তা স্বীকার করে বলেন, ‘আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ দেশের হয়ে সুনাম কুড়াচ্ছে, এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে। আমার চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট সন্তান মারুফা। বড় সন্তানের নামে কেউ আমাকে এখন ডাকে না। সবাই মারুফার বাবা হিসেবে আমাকে সম্বোধন করেন। এই ডাক শুনে আমার আনন্দে বুক ভরে যায়। মারুফার এই পর্যন্ত পথ পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না। মেয়েটি আমার খুব কষ্ট করেছে জীবনে। আমার নিজের কোনো জমি কিংবা বসতভিটা নেই। শ্বশুরের দেওয়া বাড়িতে থাকি। অন্যের জমি বর্গাচাষ ও দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছি। আশা করি, সে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে। এ জন্য সবার দোয়া কামনা করছি।’

আগামীর স্বপ্ন বাংলাদেশের এমন সাফল্যে মারুফার স্বপ্নটা খোলা আকাশে মুক্ত বলাকার মতোই যেন ডানা মেলছে! তুমুল আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী মারুফার কাছে আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন এখন জাতীয় দলের বোলিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়া। এই স্বপ্নটা আজকের নয়; সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি। বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। কেউ যেন আমাদের এই লাল-সবুজের দেশের দিকে আঙুল তুলে কথা বলতে না পারে।’

আরও পড়ুন

×