ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

প্রচ্ছদ

কোন কোন পিটানিকে আপনার সহিহ্ মনে হয়?

কোন কোন পিটানিকে আপনার সহিহ্ মনে হয়?

মানস চৌধুরী

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

প্যাঁদানিকে প্যারামিটার ধরে সমাজ বুঝবার অনেক প্রচলন নেই। এ রকম প্রচলনের জন্য আমার নৃশংস মনোভাবের পরিচয়ও আপনারা পেয়ে যেতে পারেন, কিন্তু এর পরও নানান কিছুতে বাস্তবানুগ চিন্তাপদ্ধতি গড়ে তুলতে (বড় বড় এনজিও, যার নাম আদর করে দিয়েছে মডিউল) আমার জুড়ি অনেক বেশি নেই। তবে এটা ঠিকই যে এ রকম সৃজনশীল দুর্দান্ত সব চিন্তাপদ্ধতি দাঁড় করানো সত্ত্বেও যথেষ্ট ভাবগম্ভীরভাবে সেগুলো করি না বলে, আর ‘সঠিক’ ও ‘বলবান’ গোষ্ঠীর স্ট্যাম্পসমেত প্রকাশ করি না বলে, এসব আবিষ্কারের কদর তৈরি হয়নি। এই কদরহীনতার বেদনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে আমি নয়া-নয়া চিন্তাপদ্ধতি গড়ে তুলতে মনোনিবিষ্ট হই। যাদের এই দাবি মানতে সমস্যা হচ্ছে, তারা এক্ষুনি প্রমাণ পেয়ে যাবেন হাতেনাতে। যেমন, এখন আমার প্রস্তাব হলো: কোন কোন পিটানিকে আপনার ন্যায্য বা সহিহ্ মনে হয় তার তালিকার দিকে সামান্য মনোযোগ দিলেই আপনি কী ধরনের গণতান্ত্রিক প্রাণী তার ভালোরকম খোঁজ পাওয়া যাবে; উপলব্ধি করা যাবে।

 পিটানি বা প্যাঁদানি বললাম বটে, তবে একে আদ্যোপান্ত ভৌত একটা প্রহার-প্রণালি হিসেবে না দেখতে সুপারিশ করি। বরং, এটাকে দেখতে হবে অভৌত ক্রমাগত নিষ্পেষণের সমার্থে। ভৌত প্রহার তো থাকলই, সাথে এই অভৌত নিষ্পেষণকে না যোগ করলে পুরো প্রক্রিয়াটা সম্বন্ধে ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ বোঝাবুঝি হবে। সনাতন গ্রামদেশে যেটাকে কখনও কখনও ‘গাদন’ বা আরও সুলভ কোনো পদবাচ্য দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে। সনাতন লোকসমাজের সকল পদবাচ্যই যে আমি জানি তা একেবারেই নয়, আবার যেসব শব্দ জানি তা অকাতরে নাগরিক সাহিত্যমনস্ক লোকের সামনে ব্যবহার করতে চাই তাও নয়, আরও বিশেষে, সকল শব্দের অবধারিত যৌনহিংস্রতা কিংবা হিংস্রতা-রসময়তাকে আমি একই মূল্যে গ্রহণ করি না তাও সত্য। ফলে বোঝাতে সহজ হলেও সকল সময়ে আমি পদ প্রয়োগে অনায়াস দক্ষতায় আগাই না। অনায়াস দক্ষতা ধরে আগালে বাড়তি সুবিধাও কোনো নেই। কারণ, একই পদের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যমান তৈরি হবে কেবল কারক ও আক্রান্তের পক্ষবিচারে। ঠিক সেই বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে বসেছি। ইংরেজিতেও দুটো শব্দ অধুনা সাইবারসচেতন পাঠকদের কাছে পরিচিত– লিঞ্চিং আর শেমিং। এর মধ্যে শেমিং বা শরম প্রদানকে অনায়াসে পাঠকেরা অভৌত জমিনে বুঝতে পারবেন। লিঞ্চিং বা টানাহেঁচড়ার মতো বিষয়ের ভৌত ও অভৌত/বিমূর্ত মাত্রা দুটোই বলবৎ আছে। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, এবং বিপজ্জনক, তা হচ্ছে এসব বিষয়ে মানুষজনের বোঝাবুঝি আছে মানে মোটেই এই নয় যে বোঝাবুঝিওয়ালারা এই কাজগুলো করে থাকেন না। একদম উল্টো বরং। বোঝাবুঝি আছে বলেই কাকে কখন শেমিং বা লিঞ্চিং করা হচ্ছে তার কারিগরি সজাগ সচেতন স্বতঃস্ফূর্ত। শরম-দেওয়া আর ছেঁচড়ে-হিঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করার শক্তিমত্তার কারণেই ওগুলো প্রয়োগকৃত। যিনি বা যারা এসব করতে থাকেন তারা স্বীয় স্বীয় কর্মকাণ্ডগুলোর একগাদা সাফাইকারী যুক্তিমালা বানিয়ে ফেলে তা করেন। করতে করতে বানাতে থাকেন। বানাতে বানাতে করতে থাকেন। কাজটা গুরুতরভাবে রাজনৈতিক হলেও তা চলমান তথাকথিত প্রায় সকল বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক জমিনে– সাহিত্যে, সংগীতে, কারুকলায়, থিয়েটারে, চলচ্চিত্রে; খোদ রাজনৈতিক জমিনে তো বটেই। কেন ও কীভাবে কিছু কিছু পেটাই-টানাটানি কিছু কিছু মানুষ ‘ন্যায্য’ মনে করেন এবং অন্য কিছু আক্রমণকে করে না সেগুলোর নৈতিক-রাজনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। আছে স্পষ্ট পক্ষপাত ও বলসর্বস্বতা। কিন্তু পক্ষপাত বলার মাধ্যমেই কি তাহলে একে রাজনৈতিক বলা হলো না? হ্যাঁ হলো, আমি পক্ষপাতের দিক থেকে একে রাজনৈতিকই বললাম। কিন্তু প্রথমে যে অর্থে নৈতিক-রাজনৈতিক ভিত্তি নেই বললাম সেখানে বোঝাতে চেয়েছি সেই তথাকথিত রাজনীতি যেখানে ন্যায্যতা এবং আদর্শ এবং এসব হাবিজাবি বিষয় দিয়ে রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। পিটানি কিংবা পিটানির ইচ্ছা কিংবা পিটানার সাফাইগান খোদ রাজনীতি; শরমদান বা টানাহেঁচড়া কিংবা তার ইচ্ছা কিংবা তার সাফাইগান খোদ রাজনীতি; পক্ষপাতের কারণে ব্যাখ্যাগুলোকে পল্টান দিয়ে বানিয়ে ফেলা খোদ রাজনীতি। ‘আদর্শে’র জয়গান করতে করতে একটা শক্তিসর্বস্ব বাহিনিতে পরিণত হওয়া বিশাল রাজনীতি। তাহলে কি আমার বক্তব্য এই যে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র কিংবা ‘নৈতিকতা’র একটা সকলের-জন্য-অভিন্ন নীতিমালা থাকা সম্ভব? না। আমি এখনও ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের বিপক্ষে নই। বিগত আমলের ‘শ্রেণিশত্রু খতম’কেও ঢালাওভাবে ‘নির্মম হত্যা’ হিসেবে দেখি না। পোর্টালে ছায়াছবির জরাতে ‘রিভেঞ্জমূলক’ উৎপাতগুলো দেখতে বসে নিগৃহীত নারী বা হতভাগ্যের ‘নিজ হাতে বিচার’ তুলে নেওয়া দেখে উত্তেজিত না বোধ করে থাকতে পারিনি। এমনকি সাবেকি অমিতাভ বচ্চন যখন ‘ন্যায়প্রতীক’ হিসেবে ভিলেনকে পেটাই দিতেন আচ্ছামতো, তাতে হর্ষপ্রকাশে বাধা পাইনি; এখন দেখতে বসলেও কোনো অস্বস্তি ছাড়াই নায়কপক্ষ অবলম্বন করতে পারব। প্রশ্নটা পরিপ্রেক্ষিত ও বলবিন্যাসের। আমি আয়নার মতো করে আমার ফেসবুকে ঢুকি, দেখি। নানান কিছুর আমি আচমকা তাল পাই না, তখন একে তাকে ইনবক্স বা কল করে জেনে নিই ঘটনা কী? ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচন যে হচ্ছে আমার মতো প্রথাবদ্ধ আত্মমগ্ন সাইবার প্রজা তা জানতে পেরেছে হিরো আলম আক্রান্ত হবার পরই কেবল। ঘটনা হচ্ছে, তিনি যখন আক্রান্ত হন, কাকতালে তার কিছুক্ষণ পরেই আমি পরলোকগত বাবার পকেটের কলম বিষয়ে, কিংবা হয়তো বাবা বিষয়ে, আসলে আমি বিষয়েই একটা রচনা পোস্ট করি। এতে আমার রাজনৈতিক অসংবেদনশীলতা আন্দাজ করে একজন সংক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন। তাঁর ওই পোস্টের কারণেই আমি এমনকি নির্বাচনের বিষয়ে ঠিকঠাক লক্ষ্য করি। আসলে সেই মন্তব্যকারীকে আমার নানান কারণেই পছন্দ হয়েছে। প্রথমত, ঘটনাটি আমি জানলাম তাঁর কারণে; দ্বিতীয়ত, নির্বাচনটি নিয়েও আমার মাথা সজাগ হলো তাঁর বার্তাতেই; তৃতীয়ত ও মুখ্যত তিনি ‘মাইর খাইছে ভালো হইছে’ দলের নন বলে। দেখা গেল সাইবারে অনেক মানুষ যদি এই হামলাতে সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন; অন্য অনেক মানুষ এই হামলাতে ব্যাপক আমোদও পেয়েছেন। যেহেতু হামলাটা ভৌত, সুষ্পষ্টভাবে ভিডিওকৃত, পর্যাপ্তভাবে সাইবারে সম্প্রচারিত তাই এই ব্যাপারটাতে ‘হয়ে থাকলে’, ‘প্রমাণিত হলে’ ইত্যাদি ভাষার আড়াল নেওয়া এমনকি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের পক্ষেও নেওয়া সম্ভব হতো না। সাইবারের কল্যাণেই লক্ষ্য করি যে ‘নাক-খতের’ একটা আগাম ঘোষণা কোনো বড় কর্মকর্তা দিয়ে ফেলেছিলেন। আমার আর ধৈর্যে কুলায়নি লক্ষ্য করতে যে তিনি সেই নাক-রক্ষার জন্য কী ধরনের সাফাইগীত রচনা করছেন। আর যা-ই হোক, আমি তাঁর, বা যে-কারোরই নাকহীনতার অমঙ্গল কামনা করি না। এত সবের মধ্যে যিনি এমপি হতে যাচ্ছিলেন, এবং তখনও হয়ে সারেননি, তিনি সংবাদ সম্মেলনে জানালেন যে তিনি সত্য ও ন্যায়ের পথেরই লোক, এবং ‘সন্ত্রাসীরা যদি আমাদের দলেরও হয়ে থাকে…’। এই অংশটা এখন কমবেশি সকলেরই মুখস্থ। জনাব মোহাম্মদ এ আরাফাত তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জনাব হিরো আলমকে নিশ্চিন্তে ও ‘বিপুল’ ভোটে পরাজিত করেছেন। এতে তাঁর, তাঁর দলের হেডকোয়ার্টার্সের, আর চিত্তানুগত বুদ্ধিজীবীদের আনন্দ হতে পারে। সেই আনন্দে তাঁর হক আছে। কিন্তু প্রকৃত ‘বিপুল’ যারা, ভোট দিতে আসেননি যারা, তাদের অর্ধেক লোকও যদি এই নির্বাচনের দিকে কয়েক সেকেন্ড মন দিয়ে তাকান (আমার মতো না আরকি) তাহলে হিরো আলমকে অতটা পরাস্ত তাদের নাও মনে হতে পারে, যতটা বিজয়ী পক্ষের নিজেদের মনে হচ্ছে হাত তুলে ‘ভি’ দেখানোর সময়। কারণ, ভোটদানে বিরতগণ গুরুতর রকমের বড় সংখ্যা। এত বড় সংখ্যা যে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যকার পার্থক্যকে বেশ গৌণ সংখ্যার মনে হয়। কিন্তু ভোটের সংখ্যা বা নির্বাচনী কায়দাকানুন আজকে আমার আলোচ্য-বিবেচ্য নয়। আর তার জন্য পত্রিকার এই সাহিত্য পাতাকে ব্যবহার উৎপাতও বটে। এটা অনেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খাত দিয়ে সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর মতো। সেটা অনাচারই না কেবল, তছরুপের পর্যায়ে পড়ে। সেজন্য সেই বিষয়েও এখানে বলছি না। আমার প্রধান আগ্রহের জায়গাই হলো এটা বোঝা যে– কী কী ভাষায়, চিন্তায়, চিন্তার বর্গ দিয়ে একজন হিরো আলমকে নাগরিক প্রজারা ‘টার্গেট’ করেন, ‘ছাঁচীকরণ’ করেন, তারপর বিধিবদ্ধভাবে ঘৃণার চর্চা চালান, এবং পরিশেষে হামলার মতো ঘটনাতে সেই কৃতকর্ম দিয়ে অর্জিত ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে সাফাই গাইতে থাকেন। এই পুরো প্রক্রিয়ার দুর্দান্ত সূক্ষ্ম আত্মমগ্ন স্বৈরাচারী কলাকৌশল যদি সাহিত্যকর্মীরা না দেখেন তো কে দেখবেন! হিরো আলম যখন ভিডিওতে নাচাকোঁদার কারণে তামাশাকৃত হতেন, তখন নাচাকোঁদার ব্যাকরণটা বোঝা যেমন জরুরি, তেমনি তামাশার ব্যাকরণটাও। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, একজন উপাচার্যের একটা নাচের ভিডিও সাইবারে প্রচার করে উপাচার্য মহাশয়ের ‘চরিত্রহননের’ চেষ্টা হয়েছিল। আমি একটুও আরাম পাইনি, এবং সে কথা নিকটজনেরা জানেন। প্রাক্তন সেই উপাচার্যের নাচ নিজগুণেই নিন্দনীয় ও কুৎসিত ছিল; কিন্তু সেটাকে তাঁর পদমর্যাদার সাথে মিলিয়ে ‘অনৈতিক’ সাব্যস্ত করা ছিল বেহুদা ও পুলিশগিরির কাজ। তার থেকেও বড় কথা, সেই উপাচার্যের ফালতু ও স্বৈরতন্ত্রী কর্মকাণ্ডের ১০১টা ফিরিস্তি জানার পরও তাঁর নাচ নিয়ে হইচই করাটা মাত্রার দিক থেকেও বিপজ্জনক। ‘ভিপি’ নুরের পোশাকের বনেদিমূলক রদবদল নিয়েও পত্রিকায় নিন্দাকারী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আমি গত কদিনে সাইবার ‘রিসার্চ’ করেছি। সিরিয়াসলি! একদা তিনি ‘নিরীহ’ পোশাক পরতেন বলে আজীবনের জন্য সেটাই ইউনিফর্ম বানাতে হবে? পোশাকের বদল খোদ এত বড় প্রসঙ্গ হলে তো বরং গান্ধীকে নিয়ে আর কোনো আলাপেরই সুযোগ থাকে না। আচমকা গুচ্ছের সুট ছেড়ে নেংটিমূলক আত্মপ্রকাশের চমকানি সারাতে সারাতেই তো আমাদের ১০০ বছর লাগার কথা। আর বাংলাদেশের মন্ত্রীদের লাইন দিয়ে হাতাকাটা কোট বানানো নিয়েই বা কী আলাপ করব আমরা? এগুলো আসলেই আলাপের ভরকেন্দ্র? আসলেই নুর ছাড়া বাংলাদেশের বাকি সকল রাজনৈতিক নেতার ‘আর্থিক স্বচ্ছতা’ বিষয়ে আপনাদের প্রমাণ পাওয়া হয়ে গিয়েছে? প্রসঙ্গটা হলো কে কোন চূড়ায় বসে কাকে অবলোকন করছেন। গভীরভাবে প্যানপটিক্যাল। আপনার বসে-থাকার চূড়াটি যদি আরামদায়ক, সুবিধাজনক ও ক্ষমতাসীন বর্গের সমান্তরালেই হয়ে থাকে, আপনার চিন্তার ডিভাইসগুলো যদি অবিকল কান্ডারিরাও ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে আপনি দুরবিন নিয়ে যার যার দিকেই তাক করুন না কেন সেই লোকগুলো থেকে আপনার দুরবিনের গুণ (বা দোষ) আমার অধিক পরিলক্ষিত হবে, আপনার চূড়ার মোলায়েমত্ব আমার অধিক বিবেচনায় থাকবে। আর অবশ্যই আপনার কর্মকাণ্ডকে মনে হবে শাসকের সমান্তরালে থাকার ঐকান্তিক মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে। হিরো আলমের নাচের মান, নুরের কথার কামান– এগুলো তখন মুখ্য বিবেচ্য নয়। আপনি শিকারে নেমেছেন ভাই! আপনি রাজশিকারি! 

আরও পড়ুন

×