রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আভ্যুদয়িক চেতনার ভেতর জাতীয়তাবাদ সক্রিয় ছিল পূর্ণোদ্যমে। এই জাতীয়তাবাদকে সাফল্যের সঙ্গে আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন এই ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও পরের সঙ্গে পার্থক্য রচনার রাজনীতি থাকে। প্রতিপক্ষের বিপরীতে একটি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং তাকে গেরিলা যুদ্ধের দিকে ধাবিত করতে প্রস্তুতি না থাকলেও, যে প্রজ্ঞার প্রয়োজন, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ঔপনিবেশিক মনোভাব ও শোষণের জবাবে যেভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাতেই তাঁর ভেতর অনাগতবিধাতার দেখা পায় পূর্ববঙ্গের মানুষ। এ কারণেই নেতা ও তাঁর ভাষণ হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে মূর্ত ও কার্যকরী প্রতীক। পরবর্তীকালে এই প্রতীক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বহু কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রে ঋজু ও কোমল দুই প্রকারেই হাজির থেকেছে। অতএব হাজির থেকেছেন শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ঘটনা ও ইতিহাসের অমোচনীয় চিহ্ন হিসেবে।
ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছিল জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) প্রামাণ্যচিত্রে। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের বর্বরতা থামানোর কথা বলতে গিয়ে জহির রায়হান লেনিনকে উদ্ধৃত করলেও, কোথাও শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নেননি। সেটি নিয়ে অবশ্য কম জল ঘোলা হয়নি। প্রযোজক ও পরিচালক ফজলুল হক ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বরাবর একটি চিঠি লেখেন, এই ছবি যেন প্রদর্শিত না হয়। ফজলুল হক ও তাঁর সমর্থকদের অভিযোগ ছিল– ছবিটি মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা দিয়ে শুরু না করে, কেন লেনিনের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হলো? পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি মন্ত্রিসভার সদস্যরা দেখেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছবির ছাড়পত্র প্রদান করেন।
‘স্টপ জেনোসাইডে’ শেখ মুজিবুর রহমানকে না রাখার বিষয়ে নির্মাতা জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের কেস প্লিড করতে হলে লেনিনের মতো মহামানবের উক্তিই ব্যবহার করতে হবে। কারণ নিজের বক্তৃতা দিয়ে নিজের কেস প্লিড করা যায় না।’
যারা ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখেছেন, তারা জানেন, জহির রায়হান ছবিটিতে জাতীয়বাদকে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় যেখানেই অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার হচ্ছে তা বন্ধ করার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের মানুষের ওপর স্বৈরাচারী আগ্রাসনের বিপরীতে তিনি মুক্তিকামী মানুষের মানবিক আবেদনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন এবং সেই আবেদনকে বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ করে তোলেন। তবে দেশ স্বাধীনের পর যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে ছবি বানিয়েছেন, তাদের ভেতর আর এই প্রচেষ্টা খুব একটা চোখে পড়ে না।
চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২) ছবিতে শেখ মুজিবুর রহমান আছেন, জাতীয় প্রধান নেতা হিসেবে, জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে। নির্মাতা এই ছবিতে মূল ঘটনার ফুটেজ জুড়ে দিয়েছিলেন। একই পরিচালকের ‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪) ছবিতেও শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখা যায়। তবে এবার মহাফেজখানার ছবি ব্যবহার করলেন না চাষী। সরাসরি শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে অভিনয়ই করালেন তিনি। ২০১৪ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রসঙ্গটি বিস্তার করেন।
চাষী নজরুল ইসলাম বলছেন, “আমি সংগ্রাম ছবির শেষ দৃশ্যের শুটিং করব। আমরা স্যালুট দেব আর তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) স্যালুট নেবেন। মার্চপাস্টে যেটা হয়। খসরু (অভিনেতা কামরুল আলম খান খসরু) বলল, ‘চলেন যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে।’ সোজা বঙ্গবন্ধুর কাছে চলে গেলাম। বঙ্গবন্ধুকে খসরু বলল, ‘আপনার কাছে একটা কাজে আইছি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কী কাজ? ক?’ খসরু বলল, ‘আমরা এই রকম একটা দৃশ্য করব, আপনি স্যালুট নিবেন।’ বঙ্গবন্ধু ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ, আমি ফিল্মে অ্যাক্টিং করব না।’ খসরু বলল, ‘এটা তো অ্যাক্টিং হইল না।’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘অ্যাক্টিং হইল না কী?’ তখন খসরুকে ধমক দিয়ে চলে যেতে বললেন। খসরুও নাছোড়বান্দা। ‘না আপনাকে করতেই হবে। আপনি না হলে সিনেমাটা শেষ করতে পারব না।’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মান্নানরে ডাক’ (তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নান)।... বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী তাইলে?’ ‘ওই ঠিকই আছে। তয় করবেন কবে?’ তখন বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন কাজটি করে দিতে। বললেন, ‘যা, করে দেব।’ আমরা পিলখানায় কাজটা করি। সব প্রস্তুতি নিই। যে পরিমাণ আয়োজন, এটা একবার মিস হইলে শেষ। আজকাল ইতিহাস পরিবর্তন নিয়ে সবাই ঝগড়া করে। কিন্তু কেন করে? জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফসহ সবাই বঙ্গবন্ধুর পেছনে লাইন ধরে বসা। এত ঘনিষ্ঠ তারা! কেন এখন সবাই একেক ধরনের কথা বলছে! বঙ্গবন্ধু স্যালুট গ্রহণ করলেন। একপর্যায়ে জানতে চাইলেন, ‘এই, কতক্ষণ হাত তুইলা রাখব রে।’ আমি তখন বললাম, ‘আর অল্প কিছুক্ষণ।’ তিনি বললেন, ‘আরে কী করস না করস তোরা।’ বঙ্গবন্ধু কী যে হেল্প করলেন, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে জাতীয়তাবাদের উপাদান হিসেবে জাতীয় নেতা ও তাঁর ভাষণকে বহুবার, বহুভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ (১৯৭২) ছবিতে বেশ দক্ষতার সঙ্গে দু’বার মুক্তিকামী মানুষের প্রতি আহ্বানের আকারে ব্যবহৃত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ। তবে সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ করা হয়েছে সাউন্ড মন্তাজের মাধ্যমে। ছবির মূল চরিত্র আনু যখন যুদ্ধের ভেতর কলকাতা গিয়ে হাজির হন, তখন ক্ষুদিরাম ও সুভাষচন্দ্র বসুর ভাস্কর্য এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দৃশ্যপটে রেখে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনিয়ে দেন সুভাষ দত্ত। বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে এই ভূখণ্ডের মানুষ লড়াইকে তিনি অবিচ্ছেদ্য ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখাতে চাইলেন।
‘গেরিলা’ (২০১১) ছবিতেও জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বিপ্লবী ও মানবিক নেতা এবং শান্তির দূত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রোথিত করেন: কোলাজের ভেতর তিনি মার্কস, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সূর্য সেন, মাদার তেরেসা, মার্টিন লুথার কিং, মাও সে তুং, হো চি মিন, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা প্রমুখের সঙ্গে এক সারিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্থান দেন।
মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১১) চলচ্চিত্রেও দেখা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের ডাক দেওয়া অসহযোগ আন্দোলনের কথা উঠে আসছে চরিত্রদের সংলাপে। একইভাবে জাতীয় নেতার নাম উচ্চারিত হয় শামীম আখতারের ‘রীনা ব্রাউন’ (২০১৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্রে।
এভাবে কোথাও ছবি, কোথাও সংলাপ, কোথাও বা মুজিবুর রহমানের চলচ্ছবি কিংবা তাঁর ভাষণকে ব্যবহার করা হয়েছে চলচ্চিত্রে প্রবহমান জাতীয়তাবাদকে সংহত করতে। জাতীয়তাবাদ কল্পিত একক গোষ্ঠী বা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চায়– ভাষার মাধ্যমে, সংস্কৃতির মাধ্যমে, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে, রাজনীতির মাধ্যমে। এখন কোনো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য যখন জাতীয়তাবাদকে মূলমন্ত্র করে গড়ে ওঠে, তখন সেখানে ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় নেতৃত্বের প্রসঙ্গও চলে আসে। যে দেশটি জাতিসত্তার উন্মেষের ভেতর দিয়ে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেই রাষ্ট্রের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ এলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের প্রধান হিসেবে এবং জাতির পিতা সম্বোধন হেতু শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ আসবে অবধারিতভাবেই। তাছাড়া কে না জানে, জাতিরাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদকে পুষ্ট করতে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের কাঠামো গ্রহণ করা হয় আদর্শ হিসেবে। সেই আদর্শই পুনঃউৎপাদিত হতে থাকে সে দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। u
সহায়
১. অনুপম হায়াৎ, বঙ্গবন্ধু ও চলচ্চিত্র, (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০২০)
২. মাহমুদা চৌধুরী ও আয়শা আকতার কণা, জহির রায়হানের চলচ্চিত্র: সমাজ ভাবনা, (ঢাকা: বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ২০১৭)
৩. আলমগীর কবির, চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি (আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ-১), (ঢাকা: আগামী, ২০১৮)
৪. চাষী নজরুল ইসলাম, কালজয়ী চলচ্চিত্রকার: চাষী নজরুল ইসলাম, (সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন জাহীদ রেজা নূর) (ঢাকা: চাষী নজরুল ফাউন্ডেশন, ২০১৬)