নারীরা কি তালাক দিতে পারে?

--
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
এ বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে পাঠকের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান
আমাদের বাড়ি পাবনার চিনাখরায়। ২০১৮ সালের কথা। তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়তাম। আমার স্বামী ব্যবসায়ী। তাঁর অনেক টাকা। সম্ভবত টাকার লোভেই আমার অমতে পরিবার থেকে বিয়ের আয়োজন করা হয়। আমার বয়স তখন ১৫। সহপাঠীদের তৎপরতায় এলাকায় বিয়ে দিতে না পেরে আমাকে গাজীপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে এনে বিয়ে দেওয়া হয়। কোন কাজির মাধ্যমে এ বিয়ে হয়েছে তা জানি না। এমনকি আমার বাবাও জানেন না। সাক্ষী হিসেবে যাকে রাখা হয়েছে, তাঁকেও আমি চিনি না। বিয়ের পর আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এক সপ্তাহ পর বাড়িতে ফিরে গেলে স্বামীর সঙ্গে দু’একবার দেখা হওয়া ছাড়া ছয় বছরে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ফিরে আসার পর আমি আবার পড়াশোনা শুরু করি। ঢাকায় একটি কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। ২০২২ সালে আমি নিজ থেকে তালাক নোটিশ (ডিভোর্স লেটার) পাঠাই স্বামীর কাছে। কারণ, তাঁর সঙ্গে আমার কোনো বোঝাপড়াই গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আমার স্বামী সেই তালাকের কাগজ গ্রহণ করেননি। কাবিননামা আমাকে দেওয়া হবে না বলেও জানিয়ে দেন। শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে বলা হয়, মেয়েরা তালাক দিতে পারে না। আমার সঙ্গে আবার তিনি সংসারও করতে চান না। সম্প্রতি জানতে পারি, তিনি করোনাকালে লুকিয়ে বিয়ে করেছেন। তবে আমি নতুন করে বিয়ের চেষ্টা করলেই তিনি ‘নিজের বউ’ দাবি করে সম্পর্ক ভেঙে দেন। এখন আমি এ স্বামীর কাছ থেকে মুক্তি পেতে চাই। মেয়েরা কি তালাক দিতে পারে? কাবিননামা বা কাজির ঠিকানা না জানলে কি আমি তালাক দিতে পারব? আমার যে ক্ষতি হয়েছে, তার কি কোনো প্রতিকার আমি পাব?
সাথী আক্তার (ছদ্মনাম), ঢাকা
প্রিয় সাথী আপনি যে সমস্যার বর্ণনা এখানে দিয়েছেন, তার একাধিক আইনি দিক বা প্রেক্ষাপট আছে। আপনার পরিস্থিতির দুটো আঙ্গিক আছে এবং দু’ভাবে আপনার পরিস্থিতিকে দেখার সুযোগ রয়েছে। প্রথমটা হলো, আপনি উল্লিখিত লোকের স্ত্রী। আপনার কাছে কাবিননামা নেই; কোন কাজি অফিসে গিয়েছিলেন, সেটাও জানেন না। এ ক্ষেত্রে আপনি আদালতে একটি এফিডেভিটের মাধ্যমে অঙ্গীকার করে আদালতকে জানাতে পারেন, ছয় বছর আগে একটি বিয়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৫ বছরের নাবালক বয়সে আপনার অসম্মতিতে আপনাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এরপর স্ত্রী হিসেবে সব ধরনের আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, আপনার কাবিননামা আপনাকে দেওয়া হয়নি এবং কাজির ঠিকানাও জানেন না। তখন আদালত আপনার স্বামীকে কাবিননামা দিতে বাধ্য করবেন এবং কোন কাজি অফিসে আপনার কাবিন পড়ানো হয়েছিল, সেই তথ্যটিও আপনি আদালতের মাধ্যমে জানতে পারবেন। স্ত্রী হিসেবে আপনি আপনার স্বামীকে তালাক দিতে পারেন, যদি কিনা আপনার কাবিননামায় ‘তালাকে তাওয়াফফুজ’-এর উল্লেখ থাকে। না থাকলে আপনি পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন ১৯৮৫-এর সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯-এর ধারা ২-এর আওতায় বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। বিয়েবিচ্ছেদ আইনের ধারা ২-এ যে ৯টি শর্তের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা আছে, সেগুলোর সিংহভাগই আপনার জন্য প্রযোজ্য হবে। যেমন– ধারা ২(ক) বলছে যে, স্বামী যদি ৪ (চার) বছরের অধিক সময়ের জন্য নিরুদ্দেশ থাকেন। ধারা ২(খ) বলছে, যদি স্বামী দুই বছর ধরে ভরণপোষণ না দেন অথবা যদি তিনি আইন ভঙ্গ করে দ্বিতীয় বিয়ে করে থাকেন। আপনি লিখেছেন, আপনার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন বলে আপনি মনে করেন, কাজেই এই ধারাতেও আপনি বিয়েবিচ্ছেদ চাইতে পারেন। এরপর ধারা ২(ঘ) বলছে, যদি আপনার স্বামী তাঁর বৈবাহিক দায়িত্বগুলো তিন বছর ধরে পূরণ না করেন, তাহলেও আপনি বিয়েবিচ্ছেদ চাইতে পারেন। এ ছাড়া ধারা ২(ছ) বলছে, যদি শিশু বয়সে আপনার বাবা আপনাকে বিয়ে দিয়ে থাকেন তাহলে ১৯ বছর হওয়ার আগে আপনি এ বিয়ে মানেন না বলে দাবি করতে পারেন। যেহেতু ২০২২ সালে ১৯ বছর বয়স বা তার আগেই আপনি তালাকের নোটিশ পাঠিয়ে বিয়ে অস্বীকার করেছেন, তাই এ ঘটনাকে আপনি উল্লেখ করতে পারেন।
আপনার ঘটনার দ্বিতীয় একটি আইনি ব্যাখ্যা আছে। সেটি হলো আসলে আপনার বিয়েই হয়নি, বরং একটি বড় ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে আপনার সঙ্গে। কাজেই আপনি দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারায় মামলা করতে পারেন। এই ধারা বলছে, আইনসম্মতভাবে বিবাহিত না, অথচ প্রতারণামূলকভাবে বিয়ের দাবি করে যদি কোনো ব্যক্তি নারীকে দাম্পত্য জীবনযাপন করতে বাধ্য করেন, তাহলে এই অপরাধের জন্য তিনি দশ বছরের কারাদণ্ড পেতে পারেন। এই ধারায় মামলা করার যুক্তি হলো, আপনাকে আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি শোষণমূলক বন্দিদশায় রাখা হয়েছে। আপনার সঙ্গে যে বয়সে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, তখন আপনি আইনগতভাবে বিয়ের জন্য সম্মতি দিতে সক্ষম ছিলেন না। তাছাড়া নাবালক হিসেবেও আপনি সম্মতি দেননি, বরং বিয়ের একটা অনুষ্ঠান মাত্র হয়েছে কিন্তু বিয়ে হয়নি। কারণ, সম্মতি ছাড়া কারও বিয়ে হয় না। আবার আপনার বাবা, যিনি নাকি আপনার আইনগত অভিভাবক, তাঁকেও পুরো তথ্য দেওয়া হয়নি, এমনকি কাজি অফিসের ঠিকানাও তাঁকে জানানো হয়নি। এটা এক গুরুতর অন্যায়। এর ওপর আপনাকে আপনার কাবিননামা দেওয়া হয়নি, যা স্ত্রী হিসেবে আপনার প্রাথমিক অধিকার। এতে বোঝা যায়, আপনাকে অন্যায়ভাবে শোষণমূলক বন্ধনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে বিয়ের একটি ছলনামাত্র করে, স্বামী-স্ত্রী জাতীয় কোনো দাম্পত্য জীবনের অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করে, এক ধরনের বন্দিদশায় আপনাকে রাখা হয়েছে। কাজেই উল্লিখিত ধারাতেও আপনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।