কেন বার বার ঘুরে দাঁড়ায় হিজবুল্লাহ

ছবি: সংগৃহীত
মো. মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৩৯ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৪ | ১৫:৫৯
ইসরায়েলের বিমান হামলায় শুক্রবার লেবাননভিত্তিক শিয়া ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে ছিলেন নাসরাল্লাহ। তার মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি অনিশ্চিত।
নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে, আর তা হলো- হিজবুল্লাহ নেতাদের এভাবে হত্যা করে কি সংগঠনটিকে দমিয়ে রাখা যাবে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, তাদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। বার বার ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস রয়েছে হিজবুল্লাহর।
হিজবুল্লাহর শুরুর কথা
হিজবুল্লাহ শব্দটি আরবী। এর অর্থ আল্লাহর দল অথবা স্রষ্টার দল। লেবাননভিত্তিক শিয়া ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। সংগঠনটির জিহাদ কাউন্সিল নামে সামরিক এবং লয়ালটি টু দ্য রেসিস্ট্যান্স ব্লক নামে রাজনৈতিক শাখা রয়েছে। এটি ইরান ও সিরিয়া থেকে আর্থিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, বাহরাইন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে। মূলত এটি কোনো ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠন নয়।
লেবাননে ১৯৭৫ সালে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। দেশটিতে বিশৃঙ্খলার সময় ১৯৮২ প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসলামিক আমাল’। দলটি প্রতিবেশি দেশ ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কাছ থেকে উল্লেখ করার মতো সামরিক ও সাংগঠনিক সহায়তা পায়। লেবাননের বেকা ভ্যালিভিত্তিক দল ‘ইসলামিক আমাল’ পরবর্তী সময়ে শিয়া মিলিশিয়াদের সবচেয়ে পরিচিত ও কার্যকর দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। একপর্যায়ে এটিই সশস্ত্র হিজবুল্লাহ সংগঠনে রূপ নেয়।
‘ওপেন লেটার’ নামে একটি প্রকাশনা বের করার মধ্য দিয়ে ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার কথা জানায় হিজবুল্লাহ। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় দেশটির দক্ষিণাঞ্চল নিজেদের দখলে নেয় হিজবুল্লাহ। ১৯৯২ সাল থেকেই দেশটির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে সংগঠনটি। লেবাননের প্রথম সারির রাজনৈতিক দল হিসেবেও এদের বিবেচনা করা হয়। বিবিসির মতে, হিজবুল্লাহর রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাজারো সেনা। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে সংগঠনটির ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার।
হিজবুল্লাহ আসলে কী চায়?
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার প্রথমেই নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিল হিজবুল্লাহ। প্রকাশ করে তাদের ইশতেহার। তাতে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের আধিপত্য বন্ধ করা হবে।
কেন বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে হিজবুল্লাহ?
কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের হত্যা করে তাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। সংগঠনের সাময়িকভাবে গতি কমে গেলেও এর শক্তি আরও বেড়ে যায়। ইসরায়েলের নিজস্ব ইতিহাস থেকেই এটা জানা উচিত। কারণ, ২০০৮ সালে হিজবুল্লাহর সামরিক নেতা ইমাদ মুগনিয়াকে সিরিয়ার দামেস্কে হত্যা করে ইসরায়েল। তাকে হত্যার পর থেকে সংগঠনটি আরও শক্তিশালী হয়েছে।
চার বছর আগে ইসরায়েল হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যা করে। তাতেও দমানো যায়নি হামাসকে। দুই দশক পর তারা ইসরায়েলে বড় ধরনের হামলা করেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামলায় একদিনে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা করেছে হামাস।
গত জুলাই মাসে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ। তারপরও গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। শক্তির কোনো কমতি নেই হামাসের।
যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে সশস্ত্র সংগঠনের নেতাদের হত্যার ইতিহাস রয়েছে। ২০০৬ সালে ইরাকে আল কায়েদা নেতা আবু মুসাব আল জারকায়িকে হত্যা করে দেশটি। একে তারা বড় সাফল্য হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু ৮ বছর পর ইরাকে আল কায়েদা আইসিস রূপে আবির্ভূত হয়। এরপর এটি পশ্চিমাদের ত্রাস হয়ে ওঠে।
২০১৬ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পাকিস্তানে হামলা করে তালেবান নেতা মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মনসুরকে হত্যা করেন। কিন্তু এখনো তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতায়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাগদাদে হামলা করে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের কুদস ফোর্সের প্রধান কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করেন। কিন্তু তার মৃত্যু ইরানের আঞ্চলিক শক্তি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে দমাতে পারেনি। এরপরও হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েল ও ইরাকে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র তালেবান, হুতি, হামাস, আইসিস ও হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের হত্যা করে সেই সংগঠনকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। হয়তো সাময়িক ওই সংগঠনের কার্যক্রম কমে যায়। এছাড়া কিছুই হয় না। এসব সংগঠন পরে আরও ভালোভাবে গুছিয়ে তাদের শক্তি আরও বাড়িয়ে তুলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহসহ কয়েকজন ঊচ্চ পদস্থ নেতাকে হত্যা করে ইসরায়েল। তবুও সংগঠনটি খুব বেশি একটা ঝামেলায় পড়বে না। এটি খুব দ্রুতই আবার নিজেদের সংগঠিত করে ফেলবে। পূর্ণ উদ্যমে শুরু করবে তাদের কার্যক্রম।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিউ আমেরিকার তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ২০০৮ সালে আফগানিস্তান সীমান্তে আল কায়েদার অনেক নেতাকে এভাবে হত্যা করেছিল।
পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়। লাদেনের মৃত্যু জঙ্গিদের প্রতি আল-কায়েদার আবেদন ও হামলা চালানোর ক্ষমতা কমাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। কারণ, ওসামার উত্তরসূরি আয়মান আল-জাওয়াহিরির আল-কায়েদাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ক্যারিশমা বা সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল না। ফলে সংগঠনটি তার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
নাসরুল্লাহর হত্যাকে ইসরায়েলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার বলা যায়। হিজবুল্লাহর ওপর দফায় দফায় হামলা, সংগঠনটির সদস্যদের পেজার ও ওয়াকি-টকিতে বিস্ফোরণ, ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর অবকাঠামো ধ্বংসের মতো সাফল্য পাওয়া দাবি করেছে ইসরায়েল। নেতা হারিয়ে হিজবুল্লাহ এখন বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়লেও এত দ্রুত সশস্ত্র গোষ্ঠীটির শেষ লেখা যাবে না। ইতিহাস বলে, হিজবুল্লাহ আবার ঘুরে দাঁড়াবে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘ লড়াই চালু রাখতে অন্য নেতাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেবে।
সূত্র: রয়টার্স, আল জাজিরা, বিবিসি।
- বিষয় :
- হিজবুল্লাহ
- হত্যা
- যুদ্ধ
- লেবানন
- ইসরায়েল
- মধ্যপ্রাচ্য
- আক্রান্ত
- হামলা
- সংগঠন