থমথমে মিয়ানমার

মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে অবরুদ্ধ পার্লামেন্ট ভবন সংলগ্ন এলাকায় সেনা প্রহরা - এএফপি
রাসেল পারভেজ
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৪:৩৩
সেনাবাহিনীর পুরো কবজায় এখন মিয়ানমার। দেশজুড়ে থমথমে অবস্থা। সামরিক অভিযান, জরুরি অবস্থা ও শীর্ষ নেতাদের আটকের ঘটনায় দেশটির জনগণের মনে ভর করেছে সেই পুরোনো আতঙ্ক। সামরিক খাঁচায় থাকার স্মৃতি আবার তাড়া করে ফিরছে তাদের। দিন কাটছে উৎকণ্ঠা আর সংশয় নিয়ে। চারদিকে শুধু নীরবতা। রাস্তায় সারিবদ্ধ সেনাদের গাড়ি। কিছু দূর পরপর ব্যারিকেড। সবার গতিবিধি নজরদারি করা হচ্ছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশের জটলা। ক্ষোভ থাকলেও নেই কোনো বিক্ষোভ, মিছিল বা স্লোগান। আইনপ্রণেতা সবাই গৃহবন্দি। মুখ খুলছেন না কেউ। সাংবাদিকরাও রয়েছেন সেনা পর্যবেক্ষণে। এ অবস্থায় মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে যা কিছু হচ্ছে, সবই বহির্বিশ্বে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ অং সান সু চির মুক্তি ও নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চাপ প্রয়োগ শুরু করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে বৈঠক ডেকেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। একই সঙ্গে রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর নড়েচড়ে বসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। শতাধিক এমপিসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়। এদিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে মিয়ানমার। দিনে জরুরি অবস্থা ও রাতে কারফিউয়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশজুড়ে। তবে ইয়াঙ্গুনের পার্শ্ববর্তী চায়না টাউনে মানুষের চলাচল থাকলেও স্বাভাবিকের তুলনায় তা একেবারেই কম। গতকাল রাত ১১টার দিকে গণমাধ্যমে বলা হয়, এই ইয়াঙ্গুনের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসহযোগের ডাক দিয়েছেন। কয়েকটি হাসপাতালে থালাবাসন ও গাড়ির হর্ন বাজিয়ে তারা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ধর্মঘট ডাকারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। তাদের এই ধর্মঘট আদৌ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ও আছে। কারণ, পুরো দেশ চলে গেছে সেনা নিয়ন্ত্রণে।
ইন্টারনেট সেবা সীমিত করায় বহির্বিশ্ব থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন মিয়ানমার। জরুরি অবস্থার মধ্যে কোনোমতে যারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন, তারাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিয়ানমারে গণতন্ত্র রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাও করতে হচ্ছে মৃত্যুভয় নিয়ে। এই বুঝি সেনা-পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়; গুম করে দেয়- নানা শঙ্কায় সময় কাটছে তাদের।
গত সোমবারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত মিয়ানমারে উল্লেখযোগ্য কোনো বিক্ষোভ হয়নি। গতকাল সকালে এক ট্যাক্সিচালক এএফপিকে বলেন, 'আমরা বিক্ষোভ করতে চাই। তবে আমাদের মা (অং সান সু চি) তাদের হাতে। আমরা বেশি কিছু করতে পারছি না।'
সোমবার ভোরের আলো ফোটার আগেই মিয়ানমারে সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে রাজধানী নেপিদো থেকে আটক করে সেনাবাহিনী। ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগেই সু চির দল এনএলডির মুখপাত্র মিয়ো নিয়ন্ট বিষয়টি বিশ্ব-গণমাধ্যমকে জানান। পরে রাজধানীর সব রাস্তা বন্ধ করে দেয় সেনাবাহিনী। রাজধানীজুড়ে সাঁজোয়া যানসহ সেনাবাহিনীর গাড়ির টহল চলে। আকাশ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে শহরজুড়ে নজরদারি চালায় তারা। গতকালও দেশজুড়ে এ অবস্থা বহাল ছিল।
সোমবার ভোরে আটকের পর সু চির অবস্থান সম্পর্কে এখনও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তিনি জীবিত না মৃত- সে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে উঠেছে। নানা আশঙ্কার মধ্যেও এনএলডি তার অবস্থান জানার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে যতটুকু যা তথ্য নেতাকর্মীদের কাছে আসছে, তাও বলতে পারছেন না ভয়ে। এনএলডির এমন একজন এমপি বিবিসিকে বলেন, 'মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে গৃহবন্দি করে রেখেছে সেনাবাহিনী। তারা আমাদের উদ্বিগ্ন না হতে বলেছেন। তবে আমরা উদ্বেগমুক্ত হতে পারছি না। তাদের অবস্থানের কোনো ছবি হাতে এলেও কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারতাম।' এ অবস্থায় গতকাল রাতে এক প্রতিবেশীর বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, সু চিকে তার বাড়ির কম্পাউন্ডে হাঁটতে দেখা গেছে।
এনএলডির ওই এমপি আরও জানান, সেনাবাহিনীর হাতে আটক অন্যান্য সংসদ সদস্যকে রাজধানী নেপিদোতে নিজ নিজ সরকারি বাসভবনে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। এনএলডির কেন্দ্রীয় তথ্য কমিটির এক কর্মকর্তা ফেসবুক পোস্টে 'সু চির স্বাস্থ্য ভালো আছে' বলে জানিয়েছেন। তবে এসব তথ্যের সত্যতা কোনো গণমাধ্যম প্রমাণ করতে পারেনি।
ছয় দশকের বেশি সময় ধরে সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের মানুষের রয়েছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। সামরিক অভ্যুত্থানের পর কী হয়, তা দেশটির বেশিরভাগ মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আছে। বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের ব্যবসায়ী মা নান তেমন একজন। গতকাল এএফপিকে তিনি বলেন, 'আমি ভয়ে আছি- নিত্যপণের দাম বেড়ে যেতে পারে। আমার ভয়ের আরেকটা কারণ হলো, আমার মেয়ের এখনও স্কুলের পড়াশোনা শেষ হয়নি। আরও অর্ধেক পথ বাকি তার। তার ওপর এখন মহামারিরও সময়।'
ইয়াঙ্গুনের গৃহবধূ থান নান্ট বলেছেন, 'সামরিক শাসনের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। মানুষ এ নিয়ে বিদ্রোহ করতে পারে। আমার বিশ্বাস, অং সান সু চি এবং অন্য নেতাদের আজ হোক কাল হোক ছেড়ে দিতেই হবে।'
সামরিক অভ্যুত্থানের পর ওই দিন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ব্যাংকগুলোও বন্ধ ছিল। গতকাল ব্যাংকগুলো খুলে দেওয়া হলেও বন্ধ ছিল শেয়ারবাজার। জরুরি অবস্থা জারির পর মিয়ানমারের সরকারি টিভিতে এক ঘোষণায় সু চি সরকারের ২৪ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে নতুন ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা করা হয়।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে ছয় লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমাদের আশঙ্কা, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ওপর আরও অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে পারে। তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরাও বিলম্বিত হতে পারে। এর মধ্যেই মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে জরুরি বৈঠক ডেকেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।
২০১৭ সালে দেশটির রাখাইনে সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমানা টপকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে চলে আসে। প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় থাকা ওই রোহিঙ্গারা এখন শরণার্থী শিবিরে জীবন কাটাচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড। মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেছেন, 'আমরা সেখানে (বৈঠক) শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি হুমকি নিয়ে কথা বলতে চাই। এ বিষয়ে অবশ্যই মিয়ানমারের এশিয়া ও আসিয়ান প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।' তবে এর আগে মিয়ানমারের বৃহত্তম প্রতিবেশী চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল মূলত মন্ত্রিসভায় রদবদলের ঘটনা মাত্র। আসিয়ান বলেছে, সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে চীন সবই আটকে দিয়েছিল। সোমবার জাতিসংঘ মিশনে চীনের এক মুখপাত্র জানান, মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানা যাবে বলে তারা আশা করছেন। তিনি বলেন, 'আমরা আরও আশা করছি, পরিষদ এমন পদক্ষেপই নেবে, যা মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে আরও জটিল না করে সেখানকার স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।'
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, 'নির্বাচনে জালিয়াতির' প্রতিক্রিয়ায় তারা সু চি ও অন্যদের আটক করে সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং হদ্মাইংয়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে।
সু চিসহ সামরিক বাহিনীর হাতে আটক হওয়া নেতাদের ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মুখপাত্র ডুজারিক বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের মিয়ানমার বিষয়ক দূত ক্রিস্টিন স্কানার বার্গনার পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছেন এবং তিনিই সম্ভবত নিরাপত্তা পরিষদে এ-সংক্রান্ত ব্রিফ করবেন।
মিয়ানমারে গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি ফের বড় জয় পায়। পার্লামেন্টের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে সেনা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পায় মাত্র ৩৩টি আসন। এই নির্বাচনের ফল ঘিরে সংকট ঘনীভূত হয়। সেনাবাহিনী ও ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনের পর থেকেই ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে আসছে। এ নিয়ে সু চির সঙ্গে সেনাপ্রধান মিন অং হদ্মাইংয়ের মতবিরোধ তৈরি হয়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কার কথা জানায়। তবে সঙ্গে সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে সংবিধান মেনে চলার কথা জানায় সেনাবাহিনী। এই নাটকীয়তার মধ্যে সোমবার মিয়ানমারের নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। তারা একটি স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ক্ষমতা দখলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুন কমিশন গঠন করেছে তারা। সূত্র ইরাবতি, বিবিসি ও এএফপি।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর নড়েচড়ে বসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। শতাধিক এমপিসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়। এদিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে মিয়ানমার। দিনে জরুরি অবস্থা ও রাতে কারফিউয়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশজুড়ে। তবে ইয়াঙ্গুনের পার্শ্ববর্তী চায়না টাউনে মানুষের চলাচল থাকলেও স্বাভাবিকের তুলনায় তা একেবারেই কম। গতকাল রাত ১১টার দিকে গণমাধ্যমে বলা হয়, এই ইয়াঙ্গুনের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসহযোগের ডাক দিয়েছেন। কয়েকটি হাসপাতালে থালাবাসন ও গাড়ির হর্ন বাজিয়ে তারা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ধর্মঘট ডাকারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। তাদের এই ধর্মঘট আদৌ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ও আছে। কারণ, পুরো দেশ চলে গেছে সেনা নিয়ন্ত্রণে।
ইন্টারনেট সেবা সীমিত করায় বহির্বিশ্ব থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন মিয়ানমার। জরুরি অবস্থার মধ্যে কোনোমতে যারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন, তারাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিয়ানমারে গণতন্ত্র রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাও করতে হচ্ছে মৃত্যুভয় নিয়ে। এই বুঝি সেনা-পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়; গুম করে দেয়- নানা শঙ্কায় সময় কাটছে তাদের।
গত সোমবারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত মিয়ানমারে উল্লেখযোগ্য কোনো বিক্ষোভ হয়নি। গতকাল সকালে এক ট্যাক্সিচালক এএফপিকে বলেন, 'আমরা বিক্ষোভ করতে চাই। তবে আমাদের মা (অং সান সু চি) তাদের হাতে। আমরা বেশি কিছু করতে পারছি না।'
সোমবার ভোরের আলো ফোটার আগেই মিয়ানমারে সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে রাজধানী নেপিদো থেকে আটক করে সেনাবাহিনী। ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগেই সু চির দল এনএলডির মুখপাত্র মিয়ো নিয়ন্ট বিষয়টি বিশ্ব-গণমাধ্যমকে জানান। পরে রাজধানীর সব রাস্তা বন্ধ করে দেয় সেনাবাহিনী। রাজধানীজুড়ে সাঁজোয়া যানসহ সেনাবাহিনীর গাড়ির টহল চলে। আকাশ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে শহরজুড়ে নজরদারি চালায় তারা। গতকালও দেশজুড়ে এ অবস্থা বহাল ছিল।
সোমবার ভোরে আটকের পর সু চির অবস্থান সম্পর্কে এখনও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তিনি জীবিত না মৃত- সে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে উঠেছে। নানা আশঙ্কার মধ্যেও এনএলডি তার অবস্থান জানার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে যতটুকু যা তথ্য নেতাকর্মীদের কাছে আসছে, তাও বলতে পারছেন না ভয়ে। এনএলডির এমন একজন এমপি বিবিসিকে বলেন, 'মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে গৃহবন্দি করে রেখেছে সেনাবাহিনী। তারা আমাদের উদ্বিগ্ন না হতে বলেছেন। তবে আমরা উদ্বেগমুক্ত হতে পারছি না। তাদের অবস্থানের কোনো ছবি হাতে এলেও কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারতাম।' এ অবস্থায় গতকাল রাতে এক প্রতিবেশীর বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, সু চিকে তার বাড়ির কম্পাউন্ডে হাঁটতে দেখা গেছে।
এনএলডির ওই এমপি আরও জানান, সেনাবাহিনীর হাতে আটক অন্যান্য সংসদ সদস্যকে রাজধানী নেপিদোতে নিজ নিজ সরকারি বাসভবনে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। এনএলডির কেন্দ্রীয় তথ্য কমিটির এক কর্মকর্তা ফেসবুক পোস্টে 'সু চির স্বাস্থ্য ভালো আছে' বলে জানিয়েছেন। তবে এসব তথ্যের সত্যতা কোনো গণমাধ্যম প্রমাণ করতে পারেনি।
ছয় দশকের বেশি সময় ধরে সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের মানুষের রয়েছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। সামরিক অভ্যুত্থানের পর কী হয়, তা দেশটির বেশিরভাগ মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আছে। বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের ব্যবসায়ী মা নান তেমন একজন। গতকাল এএফপিকে তিনি বলেন, 'আমি ভয়ে আছি- নিত্যপণের দাম বেড়ে যেতে পারে। আমার ভয়ের আরেকটা কারণ হলো, আমার মেয়ের এখনও স্কুলের পড়াশোনা শেষ হয়নি। আরও অর্ধেক পথ বাকি তার। তার ওপর এখন মহামারিরও সময়।'
ইয়াঙ্গুনের গৃহবধূ থান নান্ট বলেছেন, 'সামরিক শাসনের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। মানুষ এ নিয়ে বিদ্রোহ করতে পারে। আমার বিশ্বাস, অং সান সু চি এবং অন্য নেতাদের আজ হোক কাল হোক ছেড়ে দিতেই হবে।'
সামরিক অভ্যুত্থানের পর ওই দিন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ব্যাংকগুলোও বন্ধ ছিল। গতকাল ব্যাংকগুলো খুলে দেওয়া হলেও বন্ধ ছিল শেয়ারবাজার। জরুরি অবস্থা জারির পর মিয়ানমারের সরকারি টিভিতে এক ঘোষণায় সু চি সরকারের ২৪ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে নতুন ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা করা হয়।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে ছয় লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমাদের আশঙ্কা, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ওপর আরও অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে পারে। তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরাও বিলম্বিত হতে পারে। এর মধ্যেই মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে জরুরি বৈঠক ডেকেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।
২০১৭ সালে দেশটির রাখাইনে সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমানা টপকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে চলে আসে। প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় থাকা ওই রোহিঙ্গারা এখন শরণার্থী শিবিরে জীবন কাটাচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড। মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেছেন, 'আমরা সেখানে (বৈঠক) শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি হুমকি নিয়ে কথা বলতে চাই। এ বিষয়ে অবশ্যই মিয়ানমারের এশিয়া ও আসিয়ান প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।' তবে এর আগে মিয়ানমারের বৃহত্তম প্রতিবেশী চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল মূলত মন্ত্রিসভায় রদবদলের ঘটনা মাত্র। আসিয়ান বলেছে, সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে চীন সবই আটকে দিয়েছিল। সোমবার জাতিসংঘ মিশনে চীনের এক মুখপাত্র জানান, মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানা যাবে বলে তারা আশা করছেন। তিনি বলেন, 'আমরা আরও আশা করছি, পরিষদ এমন পদক্ষেপই নেবে, যা মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে আরও জটিল না করে সেখানকার স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।'
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, 'নির্বাচনে জালিয়াতির' প্রতিক্রিয়ায় তারা সু চি ও অন্যদের আটক করে সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং হদ্মাইংয়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে।
সু চিসহ সামরিক বাহিনীর হাতে আটক হওয়া নেতাদের ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মুখপাত্র ডুজারিক বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের মিয়ানমার বিষয়ক দূত ক্রিস্টিন স্কানার বার্গনার পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছেন এবং তিনিই সম্ভবত নিরাপত্তা পরিষদে এ-সংক্রান্ত ব্রিফ করবেন।
মিয়ানমারে গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি ফের বড় জয় পায়। পার্লামেন্টের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে সেনা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পায় মাত্র ৩৩টি আসন। এই নির্বাচনের ফল ঘিরে সংকট ঘনীভূত হয়। সেনাবাহিনী ও ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনের পর থেকেই ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে আসছে। এ নিয়ে সু চির সঙ্গে সেনাপ্রধান মিন অং হদ্মাইংয়ের মতবিরোধ তৈরি হয়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কার কথা জানায়। তবে সঙ্গে সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে সংবিধান মেনে চলার কথা জানায় সেনাবাহিনী। এই নাটকীয়তার মধ্যে সোমবার মিয়ানমারের নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। তারা একটি স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ক্ষমতা দখলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুন কমিশন গঠন করেছে তারা। সূত্র ইরাবতি, বিবিসি ও এএফপি।
- বিষয় :
- থমথমে মিয়ানমার