ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সবিশেষ

যেভাবে সাদি মহম্মদকে দেখা উচিত

যেভাবে সাদি মহম্মদকে দেখা উচিত

সাদি মহম্মদ [৪ অক্টোবর ১৯৫৭–১৩ মার্চ ২০২৪]

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪ | ০৫:৫৪ | আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৪ | ১৯:৫৩

‘সবাই বাবার নাম বলে সুবিধা নেয়, আমি পারব না’

সাদি মহম্মদ মারা গেলেন; আত্মহত্যা-আত্মহনন নানান কথা উঠছে। যারা তার সান্নিধ্য পেয়েছেন তারা জানবেন, একাত্তরের ভয়াবহতার ভেতর দিয়ে যারা গেছে, তারা বাকি জীবনে আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারেনি। 

আমরা দেখেছি আমাদের বন্ধুবান্ধবের ভেতর যাদের বাবা, মা বা পরিবারের কেউ চলে গেছে, তাদের ভেতর তীব্র কষ্ট। প্রচণ্ড আঘাত তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন। বন্ধুদের ভেতর একজনের নাম উল্লেখ না করে বলছি, তার বাবাকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই বন্ধুটি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। সারাজীবনে আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। বন্ধুদের বাইরে কেউ জানেও না তার কথা। কারণ তার নীরবতা। সর্বাবস্থায় সে নীরব থাকে। সহ্য করতে না পেরে একদিন আমি বলেছিলাম, “তুই তোর বাবার কথা বলিস না কেন?” 

ও বলেছিল, “আমি বলব না। সবাই বাবার নাম বলে সুবিধা নেয়, আমি পারব না।”

কপালগুণে সেই ছেলেটির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল। তার বাবার নাম সরকারকে কোনোদিন জানায়ওনি, কোনো সুবিধাও নেয়নি। আরেকটা ছেলের কথা মনে পড়ে, যার বাবা একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী ছিলেন। সেই ছেলেটাকে মাদক একবারে শেষ করে দিয়েছিল। ছেলেটা মাদকাসক্ত হিসেবেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে। সারাক্ষণ নেশা করে পড়ে থাকত। 
একাত্তরের আঘাত যে কত প্রচণ্ড আঘাত সে কথা ভাবাও যায় না। পরের বন্ধুটি পরবর্তী সময়ে একটা চাকরি পেয়ে বিদেশে চলে যায় এবং এখন সে অনেকটাই সুস্থ। 

‘একাত্তরের ভয়াবহতা কোনো সরল ভয়াবহতা নয়’

সাদি মহম্মদের কথায় আসি। তাঁকে আমি বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। আমি দেখেছি, তিনি আর স্বাভাবিক নেই। স্বাভাবিক থাকা সম্ভব না। তাদের বাড়িতে কয়েকবারই গিয়েছি, প্রতিবার আমার মনে হয়েছে– সাদির বাবা সলিমউল্লাহ্‌র সঙ্গে একাত্তরে যা ঘটেছে, সাদিকে কেবল তার সঙ্গেই বসবাস করতে হতো না, আরও অনেক কিছুর সঙ্গে বসবাস করতে হতো; তার মা বেঁচে আছেন (তখনও তিনি বেঁচে ছিলেন), বোন আছে, ছোট ভাই আছে; ২৬ মার্চের পরের শুক্রবার দিন যে ঘটনাটি ঘটেছিল, ওটা তো তাদের জীবন থেকে কখনো মুছে যাওয়ার নয়। 

তাঁর মায়ের যে বিবরণ আছে, তা থেকেই তো বোঝা যায় সেই অভিজ্ঞতা কী ভয়াবহ ছিল, এবং এই সেই ভয়াবহতাও কিন্তু কোনো সরল ভয়াবহতা নয়, জটিলতম ভয়াবহতা। 

এমন নয় সবাই মিলে শহীদ সলিমউল্লাহ্‌কে মেরে ফেলেছিল, এমন নয় যে সমস্ত বিহারী খারাপ; তাঁর মাকে ও তাঁদেরকে বাঁচিয়েওছিল কিন্তু বিহারীদেরই একটা অংশ; আর এও তো সাদিকে দেখতে হয়েছে— যে ছেলেটা তার মাকে বাঁচিয়েছিল  সেই বিহারী ছেলেটিকেও গুলি করে মেরে ফেলা হয়। পরের মাসে ১৭-১৮ তারিখের কথা। 

‘যে কারণে মানুষ আজ জানতে চায় না একাত্তরে ইতিহাস’

এই যে একাত্তরের জটিলতা, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের কল্যাণে, আমাদের কাল্পনিক একাত্তরের কারণে, মানুষগুলোর তো ক্ষতি হয়েছেই, আমাদের ইতিহাস-চর্চাও বিঘ্নিত হয়েছে। বিঘ্নিত বলব না, আমি ‘নষ্ট হয়েছে’ বলতে চাই। যে কারণে মানুষ আজ জানতে চায় না একাত্তরে ইতিহাস। আজকে আমি যদি বলি, “আমি যুদ্ধের সন্তান!” মানুষ ভাববে হয় আমি ভাতা চাই, নয় টাকা চাই, নয়ত বাড়ি চাই। আমাকে তো ভাববে না আমি একজন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। 

সাদি মহম্মদকে এই জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছে। মনে রাখা দরকার, রাস্তাটার নাম সলিমউল্লাহ্‌ রোড। কিন্তু যে বাড়িতে ওনারা থাকেন, সেটা তাদের একাত্তরেরও আগেকার বাড়ি। এটা সরকারের কোনো দয়াদাক্ষিণ্যে পাওয়া না। 

আমার মনে আছে, একটা অনুষ্ঠানে একবার আমরা এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ করছিলাম। ওখানে মালেকা আপাও ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের। মালেকা আপা যুদ্ধশিশুদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন; সাংবাদিক সুমনা শারমিনের মা। মালেকা আপার ভাইকেও পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে মেরে ফেলেছে। তিনিও একজন ট্রমাটাইজড মানুষ। 
লক্ষণীয়, ওনারা কিন্তু ট্রমাটাইজড মানুষের সঙ্গেই বেশি সহজ হতে পারতেন। কারণ তারা জানতেন কষ্টের তীব্রতাটুকু, যেটা আমরা বুঝতে পারব না। 

আমার তো কোনো আত্মীয় স্বজন চলে যাননি। যুদ্ধে যাই বা চোখের সামনে যত মানুষকেই হত্যা করতে দেখি না কেন, ওদের মতো আমি ওই কষ্টটা ভোগ করি না। 

আজকে যখন তিনি আত্মহত্যার পর এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়ে গেছে, তখন বলতে হয়, এটা আত্মহত্যা না আত্মহনন জানি না, তবে এটা হত্যা। 

ওকে হত্যা করেছে একাত্তর। একাত্তরের থাবা থামেনি। একাত্তরের থাবা শুধু যে আমাদের মতো মানুষকে আক্রান্ত করেছিল তাই না, আজ যারা সত্তরের ঊর্ধ্বে, এই থাবা আরো আক্রান্ত করেছিল তখনকার শিশুদের। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা ঢাকা শহরের কথা জানি, সাদি মহম্মদ একজন নামকরা মানুষ তাঁর কথা জানি, কিন্তু আমরা তো সাধারণ গ্রামের মানুষের কথা জানি না, যাঁদের জীবনে এই একই ব্যাপার ঘটেছে, আরো বেশি হয়েছে। কারণ গ্রাম-গ্রাম উজাড় করা হয়েছে মানুষ মেরে, তাদের পালিয়ে যেতে হয়েছে। একটা শরণার্থলী বুকের ভেতর যে গাঢ় কষ্ট তা কি তাদের নিয়ে যারা  কোনো গবেষণা করেনি বা তাদের সঙ্গে মেশেনি তারা কেউ আদৌ কল্পনাও করতে পারবে?

আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানটা হচ্ছে একটা ভদ্রলোক সুশীলের বয়ান, একটা কাল্পনিক বয়ান, একটা বানানো একাত্তরের বয়ান। এসব দেখে আমার কাছে অপমানজনক লাগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চর্চা করতে। কারণ মনে হয়, মানুষ তো শুনতে চায়— আমি গেলাম, দশটা মানুষকে মেরে ফেললাম, বিশটা পাকিস্তানি সৈন্য মেরে ফেললাম, ভয়ানক পাকিস্তানি সৈন্য এসে পাঁচশ লোককে গুলি করে মেরে ফেলল, তিন হাজার মেয়েকে ধর্ষণ করল! 

এরকম কিছু বয়ান তৈরি করে আমরা আসল ঘটনাগুলো একেবারে বিলীন করে দিয়েছি। এইসমস্ত কারণে আমি ওনাদের পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনিসহ পরিবারের প্রায় সবাই মিলে সাক্ষাৎকারটা দিয়েছিলেন। ২০০১ সালের ঘটনা। আমার সঙ্গে ছিলেন কুররাতুল আইন তাহমিনা; মিতি আপা; আমাদের নেওয়া সাক্ষাৎকারটা বিবিসিতে শোনানো হয়। ওই সাক্ষাৎকারটা একটা বৃহৎ সাক্ষাৎকার। আমি ছোট্ট একটা অংশ পড়ে শেষ করছি। তাতে বোঝা যাবে কষ্টটা কী রকম। 

বিবিসিতে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকার, উপসংহার

ওনারা একটা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তটস্থ হয়ে। বাথরুমের ভেতরে ছিলেন। বাথরুমের মধ্যেই ঘটনাটা ঘটে। ওনার বাবাকে ছুরি মেরে দেয়। সাদি মহম্মদের বোন এ কথাগুলো বলছেন।  ছুরিটা মেরে দেওয়ার পরে; সাদি সামনে ছিল, আব্বার পিঠে চাপ দিয়ে ধরল; রক্ত বের হচ্ছিল। তারপর ধরবার পরে, আব্বা বেশ খানিকক্ষণ পরে বললেন, “আমার মাথাটা কেমন যেন ঘোরাচ্ছে। আমাকে একটু খোলা জায়গায় নিয়ে যা।” সাদি ওখান থেকে নেমে (বাবাকে নিয়ে) রাস্তায় চলে গেল। চাপ দিয়ে ধরে আছে। আব্বার অনবরত রক্ত বের হচ্ছিল। খানিকক্ষণ পর দেখছি যে, বেশ দূর থেকে তিন চারজন লোক বড় ছুরি নিয়ে সাদির দিকে আর আব্বার দিকে আবার এগিয়ে আসছে, মারবে বলে। ঠিক এই সময় আব্বা বলল, “সাদি, তুই আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যা। আমি তো মরতেছি। তুই অন্তত বেঁচে থাক।” সাদি ছাড়ছে না আব্বাকে। কিছুক্ষণ পর সাদি আব্বাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড় মারল। সাদ দৌড় মারার পরপরই আব্বা মাথা ঘুরে ওখানেই রাস্তার ওপরে পড়ে গেলেন।” 

এই যার একাত্তরের অভিজ্ঞতা, সে একাত্তরের পর এতোদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল— এ থেকেও বোঝা যায় মানুষটা কী পরিমাণ সাহস ছিল। তার পরিবারের প্রতিটি মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত।  এই ধরনের কষ্ট তো একজন দুজনের হয় না, গোটা পরিবারের ওপর পড়ে। সাদি মহম্মদ সেই রকম একটা পরিবারের মানুষ। আমাদের সেইভাবেই তার দিকে তাকানো উচিত। 

আরও পড়ুন

×