ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ভ্রমণ

রূপকথার জনকের দেশে

রূপকথার জনকের দেশে

কোপেনহেগেনের নুইহাওন নগরের রূপকথাসদৃশ বাড়িগুলো

রিজওয়ানুল ইসলাম

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৪ | ২৩:৫৯ | আপডেট: ০৩ মে ২০২৪ | ০০:০২

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ। ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে গ্রীষ্ম ভালোভাবেই শুরু হয়েছে। অন্তত সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন– এসব দেশে এ রকমই ছিল আবহাওয়া। কিন্তু কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে বের হতেই একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল গায়ে। প্লেন পার্ক করেছিল টারমাকে খোলা জায়গায়; সুতরাং সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হলো। আর তখন টের পেলাম যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে। আমি অবশ্য কোনোটাতেই তেমন অবাক হইনি, কারণ যাওয়ার আগে আবহাওয়ার খবরে এমনটিই বলা হয়েছিল। শুধু হাওয়াটার কথা মনে ছিল না। ডেনমার্ক দেশটির আর কোপেনহেগেন শহরের ভৌগোলিক অবস্থান ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে দেশটি একটি উপদ্বীপ আর কোপেনহেগেন শহরের ভেতরে এবং আশপাশে বেশ কয়েকটি নদী আর সাগরের অংশ। ফলে দমকা হাওয়ার ঝাপটা লেগেই আছে। 
আমার শ্যালিকা ফ্লোরার মেয়ে অ্যানারিটার বিয়েতে আমার স্ত্রী গীতশ্রী আর আমি নিমন্ত্রিত। সে কারণেই কোপেনহেগেন যাওয়া। দুটো দিন বিয়ের অনুষ্ঠান; তার সাথে আরও দু’দিন যোগ করে বেড়ানোর পরিকল্পনা।
আমরা যারা রূপকথার গল্প পড়তে পড়তে বড় হয়েছি, তাদের কাছে প্রথমে এসেছে ঠাকুরমার ঝুলি। একটু বড় হতেই পরিচিত হয়েছিলাম হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন আর গ্রিম ভাইদের গল্পের সাথে। তখন এত বুঝতাম না কে কোন দেশের। অনেক পরে জেনেছি, প্রথম জন ডেনমার্কের আর গ্রিমরা দুই ভাই জার্মানির। এবার কোপেনহেগেন যাওয়ার আগে একটু খোঁজ করলাম হান্স সম্পর্কে; জানলাম যে তাঁর জন্ম এই শহরের বাইরে হলেও এখানে তিনি থেকেছেন একটু বড় হওয়ার পর থেকেই। অনেক গল্প লিখেছেন এখানে থেকেই। দুটি বাড়ির ঠিকানাও পেলাম, যেখানে ছিল তাঁর বাসস্থান। দুটিই শহরের সুপরিচিত নুইহাওন (লেখা হয় Nyhavn) এলাকায়। সেখানে যাওয়াটাও আমাদের তালিকায় ছিল। সুতরাং এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো ছিল সেখানে যাওয়া। 
আমাদের হোটেলটা ছিল সুন্দর এক এলাকায়। বের হলে সামনেই বড় রাস্তা, আর তার ওপারে একটি নদী। নদীর পাড় ধরে একটু এগিয়ে ডান দিকে গিয়ে বাঁয়ে কয়েক মিনিট হাঁটলেই মেট্রো স্টেশন নরেপোর্ট। সেখান থেকে এক স্টেশন গিয়ে নামলাম কনজেন নুইটর (Kongens Nytorv)। ওই স্টেশন থেকে দুই মিনিট হাঁটলেই নুইহাওন এলাকা। সরু খালের দু’পাশে রাস্তা, আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে টাউনহাউস ধরনের দালানের সারি। যেমনটি দেখেছিলাম কোপেনহেগেন শহরের ওয়েবসাইটে, ঠিক তেমনি। প্রায় চারশ বছর পুরোনো এই এলাকার রাস্তা এবং বাড়িগুলো। এই বাড়িগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের সামনের দেয়ালের রং। বেশির ভাগ বাড়িই হলুদ, লাল বা সে রকম কোনো উজ্জ্বল রঙে রং করা। খালের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে বাড়িগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় এক রূপকথার দেশেই এসে গিয়েছি।
আসলে এই খাল সাগর থেকে ঢুকে যাওয়া একটি খাড়ি। জাহাজ এসে ভিড়ত একসময়। এখন বড় জাহাজ আর সেখানে আসতে পারে না, কারণ খালের ওপরে সেতু হয়েছে। কিন্তু এখনও এই জায়গা নতুন বন্দর নামেই চলছে। রাস্তার এক পাশে সার বেঁধে রেস্তোরাঁ আর বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট। গ্রীষ্মকালে রেস্তোরাঁগুলোর বসার ব্যবস্থা বাইরে– একেবারে খালের পাড়ে। সেগুলোতে সাধারণভাবে ট্যুরিস্টের ভিড়ই বেশি। স্থানীয় লোকজনও আসে অবশ্য। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি তখন বিকেল। বাতাসের তেজ কমে গিয়েছিল, আর রোদও উঠেছিল। যেখানে মেঘ-বৃষ্টি-বাতাস লেগেই থাকে সেখানে এ রকম একটি বিকেল পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার বৈকি! স্বাভাবিকভাবেই রেস্তোরাঁগুলোতে ছিল প্রচুর জনসমাগম। রাস্তায় হাঁটছিল অনেক লোক; খালের পাড়ের বেঞ্চগুলোতে জায়গার জন্য চলছিল প্রতিযোগিতা। আমরা অবশ্য তাতে যোগ না দিয়ে আমার অভীষ্ট বাড়িগুলো খুঁজতে শুরু করলাম। 
সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি ৯ নম্বর, ১৬৮১ সালে বানানো, এবং এখনও দাঁড়িয়ে আছে বেশ ভালোভাবেই। রূপকথার জনক হান্স যে বাড়িতে ১৮ বছর বাস করেছেন, ৬৭ নম্বর, সেটিও পাওয়া গেল সহজেই। 
যদিও তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সেই বাড়ি তেমনভাবে সংরক্ষিত হয়নি, বাড়িটির দেয়ালে তাঁর নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। নম্বর আর দেয়ালের সেই খোদাই দেখে সহজেই চিহ্নিত করতে পারলাম বাড়িটি। আমার কৌতূহল ছিল তার সামনে গিয়ে দেখব কেমন ছিল সেই বাড়ি, যেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এত সুন্দর সুন্দর সব গল্প। আসলে হান্স সফল লেখক হলেও প্রথম জীবন তাঁকে কাটাতে হয়েছে সংগ্রাম করেই। সুতরাং বাড়িও ছিল খুবই সাধারণ। এখন সেখানে একটি ক্যাফে-রেস্তোরাঁ–  নাম অ্যান্ডারসন ক্যাফে। দ্বিতীয় যে বাড়িতে হান্স বেশ কয়েক বছর বাস করেছিলেন, ১৮ নম্বর, সেটি রাস্তার অন্য পাশে। এখন সেখানে একটি স্যুভেনিরের দোকান।
হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের একটি বিখ্যাত রূপকথার গল্প “দ্য লিটল মারমেইড”, যা বিশ্বের অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সেই গল্প নিয়ে ব্যালে, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি হয়েছে। সে রকম এক ব্যালে দেখতে এসেছিলেন এক শিল্পপতি। দেখতে দেখতে গল্পটি যেমন তাঁর মনে ধরে গেল, তেমনি পছন্দ হয়ে গেল ব্যালেরিনাকেও। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে এই ব্যালেরিনার মুখের আদলে লিটল মারমেইডের একটি ভাস্কর্য মূর্তি দেখতে চান। এবং তিনি তাঁর খরচ বহন করতে রাজি। একজন খ্যাতিমান ভাস্করকে দেওয়া হলো সেই কাজ। আর তারই ফল কোপেনহেগেনের একপাশে সমুদ্রের ধারে পাথরের ওপর বসে থাকা মৎস্যকন্যার মূর্তিটি। 
কেন সাগরের কিনারে রাখা হলো এই মূর্তিটি? গল্পটির নায়িকা এক রাজপুত্রকে দেখে তার প্রেমে পড়ে গেল। সেই রাজপুত্রের জন্য সে তার সাগরের জীবন ছেড়ে দিতেও রাজি। তাকে দেখার জন্য সে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দু’বার সাগর থেকে ডাঙায় উঠে আসত। এই গল্প অনেক লম্বা। এ ধরনের অনেক গল্পেই যা হয়, রাজপুত্র এক রাজকন্যাকে বিয়ে করে, আর তার ভগ্নহৃদয় প্রেমিকা অনন্তকাল ধরে শোকে মুহ্যমান থাকে এবং তার সুখে নিজের সুখ খোঁজে! 
হোটেলের রিসেপশনে একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম কীভাবে যাওয়া যায় মৎস্যকন্যাকে দেখতে। নরেপোর্ট স্টেশন থেকে মেট্রো নিয়ে একবার বদল করে পরের ট্রেনে চার স্টেশন। সুতরাং সময় বেশি লাগা উচিত নয়। তবে মেট্রো স্টেশন থেকে মিনিট দশেক হাঁটতে হবে। ট্যাক্সির ভাড়া বিবেচনা করে আমরা মেট্রোই নিলাম। সেদিন রোদ উঠেছিল; ঠান্ডাও তেমন ছিল না। রাস্তার দোকানপাট দেখতে দেখতে এবং পরের একটু অংশ পার্কের ভেতর দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালই লাগল। 
ছুটির দিন না হলেও মৎস্যকন্যাকে দেখতে যথেষ্ট ভিড় হয়েছিল। কিন্তু ভাস্কর্যের উচ্চতা দেখে আমার মনটা একটু হলেও দমে গিয়েছিল। বিশেষ করে সাগরের অথৈ জলরাশি পেছনে থাকাতে মূর্তিটিকে তুলনামূলকভাবে ছোটই মনে হলো। তবে তামা ও টিনের মিশ্রণে (অর্থাৎ ব্রোঞ্জের) তৈরি এটি। সুতরাং খরচ এবং এত খোলা জায়গায় রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয় হয়তো ছিল। 
জায়গাটা সাগরের পাড়ে, কিন্তু পাথুরে আর একটু খাড়া বলে বেশ সাবধানে নামতে হচ্ছিল। ছবি তোলার জন্য দরকার একটু সুবিধাজনক জায়গা যেখানে পা শক্ত করে দাঁড়ানো যায়। তাছাড়া আমি সেলফি তুলতে চাই, আবার “সেলফি তুলতে গিয়ে বৃদ্ধ আহত” ধরনের খবর হতে চাই না। আর লোকের ভিড় বাদ দিয়ে শুধু মূর্তিটির অথবা ওর সাথে একমাত্র আমার ছবি তুলতে চাইলেও একটু অপেক্ষা করতে হয়। তার ওপর ছিল সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি। কন্যার মুখে সূর্যের আলো পড়েছে এ রকম একটি ছবি তুলতে চাইছিলাম। সবকিছু দেখে কাজটি সারা একেবারে সহজ ছিল না। 
আমার দেখা এবং ছবি তোলার কাজ শেষ করে উপরে উঠে আসতেই দেখলাম একজন শাড়ি পরা মহিলা মৎস্যকন্যার কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন এবং ছবি তোলার জন্য তৈরি হচ্ছেন। এদিক থেকে একটি কম বয়সী মেয়ে তাকে নির্দেশ দিচ্ছে, মা এখানটায় দাঁড়াও। বুঝতে পারলাম, ওরা বাঙালি। তবে বাংলা বলার ধরন শুনে আন্দাজ করলাম, পশ্চিমবঙ্গের হবে হয়তো। কোপেনহেগেনের কয়েক দিনে কোনো দক্ষিণ এশিয়া ধরনের পর্যটক দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই পরিবারটিকে আলাদা করে তাই চোখে পড়েছিল।

আরও পড়ুন

×