অভিভাষণ : ফিরে দেখা: ৮৯তম জন্মদিনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অভিভাষণ
রাষ্ট্র বদলেছে, প্রতীক বদলায়নি, তবুও আছে আশা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী [জন্ম: ২৩ জুন ১৯৩৬]
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪ | ০৮:৫১
মানুষ সামনের দিকে এগোয়, কিন্তু পেছনের দিকে তাকিয়ে জীবনকে বোঝে। আমিও পেছন দিকে তাকিয়ে জীবন, ঘটনা ও অভিজ্ঞতাকে বুঝতে চাইছি। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পাই– আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে তিনটি রাষ্ট্রে জীবন যাপন করার। ব্রিটিশের রাষ্ট্র, পাকিস্তানের রাষ্ট্র, বাংলাদেশের রাষ্ট্র। এই তিনটি রাষ্ট্র আকৃতিতে, পতাকায়, নামে ভিন্ন। এই তিন রাষ্ট্রে উন্নয়ন ঘটেছে এটা সত্য। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ভেঙেছে। কিন্তু উন্নয়নের ধারা ভাঙেনি। সেই ধারা পুঁজিবাদী ধারা। এটিই হচ্ছে বাস্তবতা।
ব্রিটিশ আমলে আমরা উপনিবেশ ছিলাম। পাকিস্তান আমলে অভ্যন্তরীণ একটি উপনিবেশ তৈরি হচ্ছিল। সেই রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই ভেঙে পড়েছে, মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এরপর যে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি, সেখানেও কিন্তু ওই ঔপনিবেশিতাই রয়ে গেছে। এই রাষ্ট্রীয় উপনিবেশটির চরিত্র, ঔপনিবেশিকদের চরিত্র আমরা জানি। ঔপনিবেশিকরা কী করেন? লুণ্ঠন করেন, শোষণ করেন এবং এই লুণ্ঠন ও শোষণের ফলে যা পান তা পাচার করে দেন। বাংলাদেশেও সেই ঘটনা চলছে। বাংলাদেশে ধনী যারা, তারা ধন উপার্জন করেছেন শ্রম দিয়ে নয়; যারা শ্রম দিয়েছেন তাদের উদ্বৃত্ত অপহরণ করে। সেটি লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে ঘটেছে। ব্যাংক থেকে লুণ্ঠন, ভূমি-নদী-বৃক্ষ দস্যুতা– নানান ধরনের দস্যুতার মধ্য দিয়ে তা ঘটেছে। সেই দস্যুতার টাকা তারা বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন, ঠিক আগের শাসকরা যেমনটা করেছিলেন। বাংলাদেশের ধনীরা পুঁজিবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত এবং তারা ওই রকম ঔপনিবেশিকতার চর্চাই করছেন। এখন যদি আমি আমার শৈশবে ফিরে যাই, বলতে হয়, আমাদের শৈশব ছিল আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমাদের এলাকাকে আমরা বিক্রমপুর নামে চিনি। এর অনেক খ্যাতি আছে। অনেক বিখ্যাত মনীষী ও মহীয়সী এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই এলাকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র। নিচু এলাকা, ফসল ভালো হয় না। যে কারণে চাকরিই হচ্ছে এখানকার প্রধান উপজীবিকা। চাকরির জন্য শিক্ষার খুব দরকার ছিল। যে কারণে ক্রমশ বিক্রমপুরের মানুষ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সবাই শিক্ষা পায়নি। শিক্ষা ছিল অল্প মানুষের জন্য, সেটিও সত্য। আমার শৈশব কেটেছে আমাদের এই এলাকার একটি প্রান্তিক জায়গায়। আড়িয়াল বিলের কাছে। সেখানে আমরা বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ছিলাম। তখন আমার বয়স ছয়-সাত বছর হবে। সেখানে তখন দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, আপনারা শুনেছেন। পঞ্চাশের মন্বন্তর। বলা হয়, সেই মন্বন্তরে ৩৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা কোনোভাবে বেঁচেছি। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কিছু টাকা পাঠাতে পারতেন। তা দিয়ে চলত সাধারণ জীবনযাপন। কোনো স্কুল ছিল না। আমরা যাওয়ার পর প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সেখানে একদিন শুনলাম একজন ফাঁসি নিয়েছেন। আমার বেশ কৌতূহল হলো। ফাঁসি জিনিসটা কী জানি না। আমরা গিয়ে দেখলাম, গাছের সঙ্গে একজন মানুষ ঝুলছে– যেন পুতুলের মতো; যেন উড়ছে বাতাসে। সেই প্রথম এমন অভিজ্ঞতা। তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি, সেই মানুষটি বেকার ছিলেন। অনাহারে, অর্ধাহারে, অসহায় অবস্থায়, হতাশ হয়ে– যে হতাশার কথা আজকের বাংলাদেশে আরও বেশি সত্য– তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।
আমার কাছে ব্রিটিশ শাসনের ছবি, ওই আত্মহত্যার ছবি। যদি একটি রূপক খুঁজি, আমার মনে হয়, ফাঁসি নেওয়া সেই মানুষের ছবিটি ব্রিটিশ শাসনের রূপক ছবি।
তারপর আমরা স্বাধীন হলাম, পাকিস্তান হলো এবং পাকিস্তান অর্থ দাঁড়াল দেশভাগ। দেশভাগে আমরা দেখলাম, কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তখন উপলব্ধি করিনি, পরেও উপলব্ধি করিনি। এখন উপলব্ধি করি তাকিয়ে দেখে, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা, তা হলো স্বাধীনতার নামে সাতচল্লিশের দেশভাগ।
আমাদের পরিবার রাজশাহী থেকে কলকাতায় গিয়েছিল। কলকাতায় গিয়ে আমরা খানিকটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা পাখির বাসার মতো একটি বাসা তৈরি করেছেন, থাকবেন অনেক দিন। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং হয়ে গেছে। এর মধ্যে হঠাৎ স্বাধীনতাও চলে এলো। দেশভাগ। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কলকাতা ছেড়ে চলে এলাম।
চলে আসার সময় যে কথাটা আমার মনে হয়েছিল, যে বন্ধুদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে– রাজশাহীতেও আমরা দীর্ঘকাল ছিলাম, সেখানেও অনেকে বন্ধু হয়েছিলেন– আমার বন্ধু রূপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী, ওর সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। দেখা হয়ওনি। কিন্তু যখন স্বাধীন হলো, ১৪ আগস্ট, তার আগেই কলকাতায় আমাদের পরিবারের যারা ছিলেন, তারা সবাই রাজশাহীর গ্রামে চলে এসেছিলেন। আমাদের এই রাজশাহী এলাকার মানুষ কিন্তু কলকাতা চিনতেন, ঢাকা চিনতেন না। আমরা এসে উঠেছিলাম আমাদের নানাবাড়িতে। বেশ মানুষে জমজমাট। সবাই ফেরত এসেছে। যিনি চাকরি করতেন তিনি, যিনি ছাত্র ছিলেন তিনি, যিনি ব্যবসা করতেন তিনি– সবাই এসেছেন। কিন্তু আমি কোনো উৎসবমুখরতা দেখিনি। একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন বলে একটা চাঞ্চল্য ছিল, কিন্তু সদ্য স্বাধীনতার যে উল্লাস, তা ছিল না। বরং দুশ্চিন্তা দেখেছি।
আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি কলকাতার হেড অফিসে ছিলেন, সৌভাগ্যক্রমে ঢাকার অফিসে বদলি হয়েছেন। কিন্তু আমরা কোথায় উঠব, কোথায় থাকার জায়গা হবে, তা জানতাম না। এই ঢাকায় যখন আমরা নামি, আমার সেজো ভাই– কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন, প্রকৌশলী– বলছিলেন, ফুলবাড়িয়া স্টেশনে নেমে তাঁর কান্না পেয়েছিল। আমরা কোথা থেকে কোথায় এলাম! কোথায় শিয়ালদহের সেই আলো, সেই মানুষ, সেই প্রাচীন প্রাচুর্য! যেখানে নামলাম, সেখানে টিমটিম করছে বাতি। আলোর চাইতে বেশি অন্ধকার। ঘোড়ার গাড়ি, দুর্গন্ধ, ধুলো– আমরা কোথায় গিয়ে উঠব ঠিক নেই। মনে আছে, আমরা এক নম্বর নাজিরাবাজারে একজন আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। তাদের তো বাড়িতে ভাড়া দেওয়ারও কথা ছিল না। জোর করে উঠেছি; বিদ্যুৎ নেই, স্যুয়ারেজ নেই। সেখান থেকে আমরা বের হয়ে বেগমবাজারে আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। সেখান থেকে আমরা স্কুলে যেতে থাকলাম। এই অবস্থা কেবল আমাদেরই ছিল না।
এই ছিল পার্টিশন। পার্টিশনের ১৪ আগস্টের কথা মনে করে বলছি। স্বাধীনতা দিবস। আমাদের ওই জলাঞ্চলে এর উদযাপনটা কীভাবে হবে? আমাদের স্বজনরাসহ অন্যরাও গিয়ে উঠলেন স্টিমার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ওপরে। স্টিমার আসবে গোয়ালন্দ থেকে। পাকিস্তান যেন আসছে ওই গোয়ালন্দ থেকে! স্টিমার এলো। কাগজের ফুল দিয়ে স্টিমার সাজানো হয়েছে। স্টিমারের সামনে পাকিস্তানের পতাকা বাঁধা। উড়ছে পতপত করে। নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার ধ্বনি উঠছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ! প্ল্যাটফর্মের ওপর থেকেও আমরা একই আওয়াজ দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, এখন আরও বেশি করে মনে হয়, চতুর্দিকে একটা বিষণ্নতা ছিল। কোথাও কোথাও চাপা কান্না ছিল। বিশেষ করে যারা সংখ্যালঘু, তাদের ভেতর কান্না ছিল সেদিন।
এই সময়ে দুটো ঘটনাকে আমার প্রতীকের মতো মনে হয়।
প্রথম প্রতীকের কথা বলি। আমাদের প্রতিবেশী এক পরিবারের দু’জন মানুষ হায়াত আলী ও জামাত আলী। তখন কিন্তু শ্রেণিবিভাজন আজকের মতো ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা তো আমাদের গ্রামে একেবারেই ছিল না। আমাদের খালের এপারে মসজিদ, দূরে মন্দির; মসজিদে আজান হয়, মন্দিরে ঘণ্টা বাজে। কোনো বিরোধ আমরা দেখিনি, জানতামও না। পাকিস্তান তো হলো। পাকিস্তানের মধ্যে আমি বড় হলাম। আমি এমএ পরীক্ষা দিয়ে মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজের লেকচারার হই। একদিন দেখি, আমার সঙ্গে একজন মানুষ দেখা করতে এসেছেন। জামাত আলী। জামাত আলী নৌকা চালাতেন। আমরা তাঁকে ডাকতাম তুফানি চাচা। তুফানের বিরুদ্ধে নৌকা চালাতে পারতেন এবং তুফানের মতো নৌকা চালাতে জানতেন। তাকে দেখে বললাম, ‘চাচা, আপনি এখানে হঠাৎ?’ তিনি বললেন, ‘আমি শুনলাম তুমি এখানে পড়াও, সে জন্য দেখা করতে এসেছি।’ আমি বললাম, ‘কী জন্য এসেছিলেন মুন্সীগঞ্জে?’ তিনি বললেন, ‘আমাকে ডাকাতির মামলায় আসামি করা হয়েছে।’
ডাকাতির মামলার আসামি হয়ে এসেছেন তুফানি। আমাকে এটা এমন ধাক্কা দিল! হতে পারে তিনি ডাকাতিতে যুক্ত ছিলেন। কারণ তাঁর তো কোনো পেশা ছিল না। কোনো জমিজমা ছিল না। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র তো তাঁকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।
আমাদের তুফানি চাচার সেই চেহারা আমার কাছে পাকিস্তানের প্রতীক হিসেবে আসে।
দ্বিতীয় প্রতীক ভীষণ ভয়ংকর। সেই সময়ে একজন নারী কবিতা লিখতেন। তাঁর কথা এখন কেউ মনে করে না। তিনি এমন কিছু বড় কবিও ছিলেন না। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। মেহেরুন্নেসা। এই মেহেরুন্নেসার ইতিহাস পাকিস্তানের ইতিহাস। মেহেরুন্নেসার বাবা কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত খিদিরপুরে থাকতেন। ভবানীপুরে তাঁর দুটো দোকান ছিল। রায়টের সময় দোকানগুলো লুট হয়ে গেল। এরপর বাবা কয়লার আড়ত দেন। মেহেরুন্নেসার আর পড়াশোনা হলো না। তিনি বাবার আড়তে বসে থাকতেন, বাবাকে সাহায্য করতেন। পঞ্চাশে এপারে ওপারে ভয়ংকর রায়ট হলো, তারা আর থাকতে পারলেন না। সব বিক্রি করে দিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। মেহেরুন্নেসার বাবার আর কোনো পুঁজি ছিল না। মেহেরুন্নেসার লেখাপড়া আর হয়নি, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতেন। বাবার পাশেও দাঁড়াতে চাইতেন। বাংলা একাডেমিতে নকলনবিশের কাজ করতেন, প্রুফ দেখতেন, ফিলিপস কোম্পানিতে একটি চাকরিও নিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে ক্যান্সারে বাবা মারা গেলেন। মেহেরুন্নেসা তাঁর মা ও ছোট ভাইসহ মিরপুর এলাকায় চলে এলেন। সেখানকার বিহারি অধ্যুষিত এলাকায়। ভীষণ তেজি মেয়ে। জয় বাংলা স্লোগান দেন। মিছিল করতেন। বিহারিরা সব জানত। ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমির মাঠে কবিদের এক অনুষ্ঠানে বিপ্লবী কবিতা পাঠ হয়েছিল। মেহেরুন্নেসা সেখানে কবিতা পড়েন। আমি শুনেছি সেই কবিতা ২৫ মার্চ বেগম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ২৫ মার্চ মেহেরুন্নেসাদের বাড়ি আক্রমণ করল অবাঙালিরা। মা তখন কোরআন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সামনে, ‘আমরা তো মুসলমান!’ অবাঙালিরা তখন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে উন্মত্ত। সেদিন সেখানে তারা তিনজনকেই হত্যা করল। ভাইয়ের মাথা কেটে নিয়ে চলে গেল। মেহেরুন্নেসাকে হত্যা তো করেছিলই। তাঁর মরদেহ পাখার সঙ্গে বেঁধে চালিয়ে দেওয়া হলো। পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রতীক।
বাংলাদেশে আমরা কোনটিকে প্রতীক হিসেবে ধরব? অনেক তো ঘটনা।
স্বাধীন পাকিস্তান যখন হলো, তখনও তো দুর্ভিক্ষের অবস্থা। তখন রেশন কার্ড সংগ্রহ করাটা বড় কৃতিত্বের কাজ ছিল। রেশনে পচা গম দেওয়া হতো, সেই গম ভাঙাতে কিশোর বয়সে আমিও গিয়েছি। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, তখন আমাদের আবারও রেশন কার্ডের কাছে যেতে হয়েছে। এবং তখন একগাদা রেশন কার্ড হলে বাঁচা যাচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর তো দেশ স্বাধীন হয়েছিল, আমরা স্মরণ করি, ১৭ ডিসেম্বর কী দেখলাম। ১৭ ডিসেম্বর বেরিয়েছি আমি ও আমার এক আত্মীয়। আমরা দেখেছি, লুণ্ঠন চলছে। আমরা দেখলাম গভর্নমেন্ট হাউস লুট হয়ে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। উল্লাস করছে, যেন একটা উৎসব! দেখলাম, একজন একটা সুইং মেশিন নিয়ে যাচ্ছে, যেন বিয়েবাড়ির উপহার নিয়ে যাচ্ছে। এই একটা ঘটনা দেখলাম। আরেকটা ঘটনা দেখলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ হয়েছে এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে বক্তৃতা করছেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তাঁর নাম না-হয় নাই বললাম। বক্তৃতা করার পর তিনি বললেন, ‘আমরা তিনটে রাজাকারকে ধরেছি। তাদের বিচার হয়েছে। তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড এখনই সভা শেষে কার্যকর করা হবে।’
কীভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, আমি জানি না। তবে তিনটি গুলির শব্দ শুনেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে আছে। লুণ্ঠন তখনও চলছে। ১৬ ডিসেম্বরের আগের সকালবেলা পর্যন্তও যারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ করছিল, সেই তাদেরই দেখলাম, তখন ‘জয় বাংলা’ করছে। আমাদের বিক্রমপুরের একজন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। সেই তরুণ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর যিনি কমান্ডার, তিনি বলছেন, ‘ঢাকায় যেতে হবে।’ সেই কমান্ডার তাঁর একটি গ্রুপ নিয়ে ঢাকায় গেলেন। ওই তরুণ বোঝেননি। ভাবছিলেন, যুদ্ধ তো শেষ হয়েছে, এখন আবার ঢাকায় কেন যাওয়া। ঢাকায় কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? পরে তিনি শুনলেন, ওই কমান্ডার ঢাকার ইসলামপুরে যে সোনা, কাপড়, ঘড়ির দোকানগুলো, সেগুলোতে লুটপাট করেছেন। এটি হলো তাঁর অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা।
আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন তিনি। একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, দেখলেন একটি লোক মাটি কেটে ঝাঁকায় করে নিয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখলেন, লোকটি পরিচিত। তাদের একটি ব্যান্ড পার্টি ছিল, তারা ব্যান্ড বাজাতেন। সেই তরুণ গাড়ি থেকে নেমে সেই মানুষটির কাছে গিয়ে বললেন, ‘চাচা, কী করছেন আপনি!’ সেই লোকটি বললেন, ‘বলেছিলি না মুক্ত হবো? এই যে মুক্তি। আমি এখন মাটি কাটছি।’
এ রকম অজস্র ঘটনা তো ঘটেছে। লুণ্ঠন চলেছে। আমি এবার আত্মহত্যার কথাটাই বলি।
এর আগে তো বলেছিলাম ব্রিটিশ আমলের সেই আত্মহত্যার কথা। এবার তা বাংলাদেশে, আমাদের গাঁয়ে। তিনজন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, একই পরিবারের। ছয়-সাত বছর আগের ঘটনা। তারা ঋণ নিয়েছিলেন মাছের ব্যবসা করবেন বলে। শোধ করতে পারেননি সেই ঋণ। তাগাদা আসছে। অসহায় অবস্থায় বাবা খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ভাত খেয়ে বাবা মরেছেন, মা মরেছেন, মেয়েটাও মরেছে।
একে কি আমি প্রতীক বলব?
সেই একজন। এবার তাঁর জায়গায় তিনজন। এই উন্নতিকে কি আমি উন্নতি বলব? এও তো একটা উন্নতি যে একজনের জায়গায় তিনজন আত্মহত্যা করেছে! প্রতিদিন আত্মহত্যার কথা চলছে। কিছুদিন আগের কথা। বরিশালের একজন মানুষ, আমার নামটিও মনে আছে, কামালউদ্দিন মজুমদার। ৬৭ বছর বয়স। স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বাড়ির সামনে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঋণের দায়ে এই আত্মহত্যা। তিনি সামান্য কেউ নন, সম্ভ্রান্ত মানুষ।
একে কি আমি প্রতীক বলব?
কিছুদিন আগে আনু মুহাম্মদ যখন রেল দুর্ঘটনার শিকার হলেন, দুই ধরনের ঘটনা ঘটল। এক রকমের ঘটনা হলো, কিছু লোক ছবি তুলছিলেন। এ রকম ঘটনা তো রক্ষা করার মতো। একজন ভিডিও করছিলেন। দেখাতে যে এ ঘটনার আমিও সাক্ষী! কিন্তু একজন লোক ছুটে এসে সাহায্য করেছেন। সাহায্য করলেন সিএনজি ডেকে আনতে, আনু মুহাম্মদের সহযাত্রীর সঙ্গে মিলে তাঁকে গাড়িতে ওঠাতে; ইমার্জেন্সিতে পৌঁছে দিয়ে, এরপর চলে গেলেন। এই মানুষটি আনু মুহাম্মদ কে, তা জানতেন না। পরে খবরের কাগজে পড়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে আনু মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা করে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছেন। তাঁর পরিচয় কী? পরিচয়, পুরান ঢাকার মানুষ। পরিচয়, মসলা ব্যবসায়ী।
এই যে মানুষ আছে, মনুষ্যত্ব আছে। অধিকাংশ মানুষই ভালো। অধিকাংশ মানুষই চায় পরিবর্তন। কিন্তু ব্যবস্থা এমনই– সেই ব্যবস্থা মানুষকে মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। তার মনুষ্যত্ব কেড়ে নিচ্ছে। মানুষ সামাজিক জীব। তার সামাজিকতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এবং এ কথা তো সত্য, যত উন্নতি হচ্ছে তত বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। যত উন্নতি হচ্ছে তত বেকারত্ব বাড়ছে। যত উন্নতি হচ্ছে তত বৈষম্য বাড়ছে।
এই বেকারত্ব, বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি সবকিছুই পুঁজিবাদী উন্নতির লক্ষণ। যে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বুর্জোয়ারা বলে, সেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অবস্থা তো আপনারা দেখছেন। আমেরিকাতে আবারও ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের জায়নবাদীরা কী নিষ্ঠুরভাবে মানুষ মারছে। অথচ তারাও একদিন এমনই নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিল। তারা আজ অসহায় বন্দি ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। শিশুদের, নারীদের হত্যা করছে। এই হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নতির চেহারা। পুঁজিবাদ এখন শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এটা আশার আরেকটা কারণ। এরপর পুঁজিবাদের আর কিছু দেবার থাকবে না।
পুঁজিবাদ যে ফ্যাসিবাদের আকার ধারণ করেছে, এর কারণ, ধমক দেওয়ার কেউ নেই। এই ব্যবস্থা চিরদিন চলবে না। মানুষের ভেতর আজও মনুষ্যত্ব আছে, স্বপ্ন আছে। সে পরিবর্তন চায়। মানুষের ওপর আস্থা আমাদের রাখতেই হবে। v
[২৯ জুলাই ২০২৪, ঢাকার শিশু একাডেমিতে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণ ‘ফিরে দেখা’র অংশবিশেষ। গ্রন্থনা ও পরিমার্জনা করেছেন হামিম কামাল]
- বিষয় :
- ফিরে দেখা