হিটলার, আইয়ুব ও পিনোশে
তিন একনায়কের পরিণতি

কোলাজ
বিপাশা মন্ডল
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৫:১২ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৫:২২
হিটলারের পৃথিবীর জঘন্যতম গণহত্যাকারী নিপীড়ক ও নির্মম স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে তা হলো, হিটলারের অন্তর্গত ঘৃণা, জাতিগত ঘৃণা। হিটলারই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কার্যকরভাবে পৃথিবীর মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও অনেকগুলো সমকালীন প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতিতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল কিন্তু এর পেছনের প্রধান কারণ ছিল অত্যন্ত উচ্চাভিলাষ ও ঘৃণা।
এই যুদ্ধ ঘনিয়ে ওঠার প্রধান দৃশ্যমান কারণগুলো প্রায় সবারই কমবেশি জানা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বাধ্যতামূলক গ্রহণ করা অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি, যেটা জার্মানির অভ্যন্তরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জিইয়ে রেখেছিল। সেই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের ভেতরে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। পৃথিবীব্যাপী মন্দার কারণে ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক সংকট কতগুলো কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রবর্তনের প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে, যার ফলে গণতন্ত্রের ওপর থেকে অনেক দেশের আস্থা পুরোপুরি উঠে যায়। লীগ অব নেশনস সম্রাট শাসিত জাপানি আক্রমণ থেকে এবং চেকোস্লোভাকিয়ার ওপর জার্মানি আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি আমেরিকার অর্থ সাহায্য এবং অংশগ্রহণের অভাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে জাতীয়তাবাদের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ এবং জাপানের সামরিকবাদী আন্দোলনও এজন্য বিশেষভাবে দায়ী। অন্যদিকে পৃথিবীর অন্যান্য প্রধান ক্ষমতাশালী দেশগুলোর চরম আত্মতুষ্টির সঙ্গে নিজেদের দুর্বল পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণ নিয়ে আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে প্রথমেই। এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে পাই নাৎসি জার্মানির ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণ, যেটা ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় একরকম বাধ্য করে। এ রকম পরিস্থিতিতে অ্যাডলফ হিটলারের মতো সর্বাত্মক একনায়কের উত্থান হয়। নাৎসি পার্টির উচ্চাভিলাষী অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশনীতির প্রতিফলন ঘটতে থাকে তাদের কার্যক্রমে।
কিন্তু ওপরে উল্লিখিত এসব কারণের আড়ালে ছিল একটি মূলনীতি, জাতিগত বর্ণবাদী নীতি। এবং হিটলারের ওরকম অপমানজনক পতনের মূল কারণ যেন মানবতার বিরুদ্ধে সেই অমোচনীয় অপরাধের ফলাফল। অন্য স্থান থেকে আসা কৃষিনির্ভর বসতি স্থাপনকারীদের জন্য থাকার জায়গা ব্যবস্থা করার জন্য জমি অধিগ্রহণ, বলশেভবাদের বিলুপ্তি, ইহুদি এবং দাসদের প্রতি “আর্য” বা “নর্ডিক”-দের প্রভূত্বমূলক বর্ণবাদী আধিপত্য। অন্যান্য যেসব বড় কারণ এই যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে তা হলো, ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিক ইতালির আগ্রাসন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হিটলার যখন বুঝতে পারলেন তার পরাজয় আসন্ন, কারণ ১৯৪৫ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বার্লিন শহরের পশ্চিমে অবস্থান নিল মার্কিন-ইংরেজ সৈন্য আর পূর্বদিকে রাশিয়ান সৈন্য। এই বার্লিন শহরেই হিটলারের বাঙ্কার তথা প্রেসিডেন্ট ভবন। শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে হিটলার হুকুম দিলেন বার্লিনে ও বার্লিনের চতুর্দিকে যেসব সৈন্য রয়েছে, তারা যেন সবাই একত্র হয়ে একজোটে সব ট্যাঙ্ক, সব জঙ্গিবিমান নিয়ে বার্লিনের দক্ষিণে রুশ সৈন্যদের আক্রমণ করে। হিটলারের সেনাবাহিনীকে একদিকে প্রচণ্ড শীতের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, অন্যদিকে লড়াই করতে হচ্ছে পর্যাপ্ত শীতপোশাক পরা শীতের সঙ্গে বসবাসকারী লড়াকু রাশিয়ান সৈন্যদের সঙ্গে। জার্মান সেনাদের ব্যাটালিয়নের পর ব্যাটালিয়ান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, অস্ত্র ফুরিয়ে গেছে, বোমারু বিমানগুলো জ্বালানির অভাবে মাটিতেই শত্রুর বোমায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যে হিটলার কমবেশি পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, সেই তিনি নিজের সুরক্ষিত বাঙ্কারে বসে নির্দেশ দিচ্ছেন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। মাটিতে রাশিয়া, আকাশে মার্কিন ইংরেজ বোমারু জঙ্গিবিমান জার্মানিতে দিনরাত অবিরল বোমা ফেলে বার্লিন শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ২১ এপ্রিল হিটলারের জন্মদিনের পরের দিন আক্রমণের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা ব্যর্থ। একটা বিমানও আকাশে উড়তে পারেনি জ্বালানির অভাবে।
হিটলারের মন্ত্রী-সেনাপতিরা হিটলারকে দক্ষিণ জার্মানি, উত্তর ইতালি ও বোহেমিয়া অঞ্চলসহ অন্যত্র থাকা শক্তিশালী সেনাবাহিনীর কথা জানালেন যে, এখন বার্লিন ত্যাগ করে শক্তি সঞ্চয় করে আবার যুদ্ধে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু পরাজয়ের পদধ্বনি শুনতে পাওয়া হিটলার আর নতুন উদ্যমে মাঠে নামলেন না, পতনের জন্য বার্লিনে বসেই দিন গুনতে লাগলেন। ২৫ এপ্রিল বিপক্ষ দল চারদিক থেকে চক্রব্যূহ আকারে বার্লিন ঘিরে ফেলেছে। এর সঙ্গে পূর্বদিক থেকে রুশ সৈন্য এবং পশ্চিমদিক থেকে মার্কিন সৈন্য এসে মধ্য জার্মানিতে মিলিত হয়েছে। জার্মানি দুই ভাগ হয়ে গেছে। হিটলারের সেনাপতি জেনারেল ভেঙ্কের কোনো খবর নেই। মাটির পঞ্চাশ ফুট নিচের বাঙ্কারে শ্বাস গ্রহণের সুবিধাও নেই। বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করাতে হয় সেখানে। এদিকে অনবরত গোলাগুলি ও বোমাবর্ষণের কারণে বাইরের বাতাসও আর তখন বিশুদ্ধ নেই। বাইরের বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে নোংরা ধূলাবালিও ঢুকে যেত বাঙ্কারে। তখন বাধ্য হয়ে কিছুক্ষণের জন্য বায়ু চলাচল যন্ত্র বন্ধ রাখতে হতো। তখন কি হিটলারের একবারও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে পড়েছিল? যে মৃত্যুকূপে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল কোনো অপরাধ না করেই। কে জানে? অক্সিজেনের অভাবে হিটলারের জীবনসঙ্গিনী ইভাসহ অন্যরা দমবন্ধ অবস্থায় থাকত কিছুক্ষণ।
রাশিয়ান সৈন্যরা বার্লিন শহরের ভেতরে ঢুকে গেছে। সামান্য যে কজন জার্মান সৈন্য প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের হত্যা করে এগিয়ে গেছে রুশ সেনাবাহিনী, হিটলার সিদ্ধান্ত নিলেন যেহেতু মুখোমুখি যুদ্ধ করার শক্তি আর নেই, তাই অবরুদ্ধ হওয়ার ভয়ে যুদ্ধে নামলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন পরাজয়ের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। হিটলারের সব সহকারী তাঁকে সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য বোঝাতে থাকলেন, কিন্তু হিটলার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। হিটলার একখানা রাজনৈতিক ও একখানা ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোট দু’খানা উইল করেন আত্মহত্যা করার আগে। মরার পরে যেন মৃতদেহ আগুনে পুড়ে ফেলা হয় সে নির্দেশও দিয়েছিলেন। রাশিয়ানরা হিটলারের বাঙ্কারে প্রবেশ করে ১৯৪৫ সালের ২ মে। কিন্তু হিটলার তখন মৃত। জাতিগত বিদ্বেষপরায়ণ জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, সারা পৃথিবীতে নিজের দলের একক শাসন কায়েম করার অসম্ভব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য কোটি কোটি মানুষের হত্যাকারী নিষ্ঠুর হিটলার মারা গেলেন কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করে। হিটলারের পতনের পরই সারা পৃথিবী জাতিগত বর্ণবিদ্বেষগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে একত্রিত হলো, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করল, অনেক দেশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে চলে যাওয়ার সময় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের নামে ভাগ করে দিয়ে যায় ভারতবর্ষকে। কিন্তু ভাষাগত ব্যবধান ও সংস্কৃতিগত পার্থক্যের কারণে পাকিস্তান নামক দেশটিতে প্রথম থেকেই প্রচুর মতানৈক্য তৈরি হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।
১৯৬৮ সালের নভেম্বরের শুরু থেকে ১৯৬৯-এর মার্চের শেষ পর্যন্ত এই গণঅভ্যুত্থানে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ যুক্ত হয়। যুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব রাজনৈতিক দল : কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ লেখক, কবি, সংগীতশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ সবাই। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক মুহাম্মদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানবাসী আওয়াজ তোলে অত্যাচারী সামরিক শাসন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের জেলে পাঠানোর বিরুদ্ধে। এতসব প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের কারণে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে নিজের শাসনভার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। বাংলাদেশি বাঙালিরা মূলত ১৯৭১-এর স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বতন্ত্র দেশ গঠন করল, ঠিক সেই সময়ে পৃথিবীর আরেকদিকে উত্থান হলো একজন সামরিক স্বৈরশাসকের। অগাস্তো পিনোশে (১৯১৫-২০০৬) ছিলেন চিলির সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা। যিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে নিজের পরিচয় স্পষ্ট করেছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি সামরিক জান্তার নেতা ছিলেন। যে সামরিক জান্তা ১৯৭৪ সালে তাঁকে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে এবং এভাবেই তিনি চিলির স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন। ১৯৮০ সালের এক গণভোটের নতুন সংবিধানে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যে কারণে ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চিলির ইতিহাসে সর্বোচ্চ লম্বা সময় দেশ শাসন করেন। মুক্তবাজার অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পিনোশের সামরিক সরকার নিউ লিবারেলিজমকে অনুসরণ করে অর্থনীতির উদারীকরণ বাস্তবায়িত করে, এর সঙ্গে যুক্ত হয় মুদ্রা স্থিতিশীলতা, স্থানীয় শিল্পকারখানা থেকে শুল্ক সুরক্ষা সরিয়ে নেওয়া হয়, সামাজিক নিরাপত্তাসহ শত শত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগকে বেসরকারীকরণ করা হয়। বেশ কিছু সরকারি সম্পত্তি বাজার চলতি মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বিক্রি করা হয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে, যার মধ্যে সংযুক্ত ছিল এমনকি তাঁর নিজের জামাতাও। এসব পদক্ষেপের কারণে চিলিতে দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে, অন্যদিকে জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যায় কল্পনাতীত হারে। ১৯৮৮ সালের গণভোটে পিনোশের প্রেসিডেন্ট থাকার বিপক্ষে ৫৬ শতাংশ ভোট পড়ে। যার ফলে প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস নির্বাচন গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যায়। এরপর ১৯৯০ সালে পিনোশে পিছু হটেন, যদিও ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পিনোশে চিলির সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলাসহ ৩০০ ফৌজদারি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়, এ ছাড়া কর ফাঁকি ও অর্থ আত্মসাতের মামলাও হয় তাঁর নামে। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালের ১০ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় এই স্বৈরশাসকের।