ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

দেশে দেশে স্বৈরশাসকের পতন

পতিত স্বৈরশাসকের গন্তব্য

গণঅভ্যুত্থান

পতিত স্বৈরশাসকের গন্তব্য

কোলাজ

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৫:১৬ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৫:২০

কী কারণে এবং কোন্ অবস্থায় একটি দেশে স্বৈরাচারের উদ্ভব হয় তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি আছে। অন্যদিকে কী কারণে একজন স্বৈরশাসকের পতন হয় সেসব নিয়েও গবেষণা আছে। পতনের পর অনেক স্বৈরশাসকেরা প্রাণ বাঁচাতে অন্য দেশে পালিয়ে যান। কেউ কেউ নিজ দেশে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। কেউ কেউ সৌভাগ্যবান: নিজ দেশেই সম্মানজনক পুনর্বাসন লাভ করেন। 
মার্শাল টিটো এরকম একজন। আমাদের ছেলেবেলায় উগান্ডার ইদি আমিনের কথা অনেক শুনেছি। দৈনিক ইত্তেফাক ও আজাদ পত্রিকায় তাঁর নানা খবরাখবর ঢের ছাপা হতো। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন নির্মম ও নৃশংস। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত উগান্ডা শাসন করেছেন। তাঁর আমলে নাগরিকদের মানবাধিকার বলে কিছু ছিল না। অবাধ দুর্নীতি, বিরোধীদের নিপীড়ন ও হত্যা এবং নানাভাবে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন ছিল উগান্ডার দৈনন্দিন রাষ্ট্রাচার। লক্ষাধিক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ইদি আমিনের শাসনামলে।

তাঞ্জানিয়ার সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে রাজধানী কাম্পালার পতন ঘটে ১৯৭৯-এর ১১ এপ্রিল। ইদি আমিন লিবিয়াতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। লিবিয়া থেকে চলে যান সৌদি আরবে। সৌদি আরব তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল এই শর্তে যে, তিনি রাজনীতিতে জড়াবেন না। কিন্তু দশ বছরে সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন ইদি আমিন। সৌদি আরব সরকারকে না জানিয়ে তিনি বিমানে চেপে জায়ের (কঙ্গো) চলে যান। উদ্দেশ্য জায়েরে বসে উগান্ডার ক্ষমতা পুনর্দখলের চেষ্টা চালাবেন। জায়ের সরকার তাঁকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করে এবং সেনেগালে পাঠিয়ে দেয়। সেনেগাল তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হয় ও ফেরত পাঠায়। শেষ পর্যন্ত ফিরে এসে সৌদি আরবেই তাঁকে পুনর্বার আশ্রয় নিতে হয়। রোগে-ভুগে ২০০৩ সালে জেদ্দার হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। নিজের দেশে ফিরে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। 

২. 

সব স্বৈরাচারী সরকার এবং একনায়কের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। ‌‌একজন একনায়ক একদিকে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে তিনি তাঁর শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য নানা কায়দা-কৌশলের আশ্রয় নেন।  সব সতর্কতা সত্ত্বেও একনায়কের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে পড়তে পারে এবং স্বৈরশাসনের জন্য প্রতিষ্ঠিত সরকার কাঠামো তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে।‌ ইতিহাসে দেখা যায়, স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে কখনও ধীর গতিতে, কখনও দ্রুত গতিতে, কখনও আকস্মিকভাবে। ‌কখনও জনগণের বিক্ষোভ ও বিপ্লব হয়েছে, কখনও সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান করেছে।

বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের দিকে তাকালে প্রথমেই কয়েকজন স্বৈরশাসকের নাম আমাদের মনে আসে: যেমন চীনের চিয়াং কাইশেক, স্পেনের ফ্রাঙ্কো, জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, কিউবার জেরারদো মাচাদো এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং (২য়) ইত্যাদি। ‌‌কোনো স্বৈরশাসক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চান না। কারণ তাঁর দুঃশাসনের সময় এমন সব কার্যকলাপ তিনি করেন যেগুলো আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য এবং শাস্তিযোগ্য। ক্ষমতার আসনটি নিশ্চিত রাখতে হলে বিরোধীদের দমন করতে হয়; সহযোগীদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও লুটের বখরা দিতে হয় এবং শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হয়। ক্ষমতাচ্যুত হলে এসব অপরাধের কারণে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। এ জন্য পতনের পর তিনি স্বেচ্ছানির্বাসন বেছে নেন। ‌ বিদেশে পালিয়ে গেলেও লাভ নেই।‌ কারণ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সেই ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার হতে পারে। যেখানেই থাকুক তাঁকে ধরে নিয়ে কাঠগড়ায় তুলে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং একনায়ক বলা হোক বা স্বৈরশাসক বলা হোক তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে যে কোনো প্রকারে হোক ক্ষমতার আসনটি আঁকড়ে থাকা। আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকা সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তা খুব কমই হয়। বরং পৃথিবীর ইতিহাসে পরাক্রমশালী শাসকের আকস্মিক পতনের ঘটনা অনেক। ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা কয়েক রকম স্বৈরশাসকের উদাহরণ পাই। তাদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রনায়ক যে ক্রমে একনায়ক এবং স্বৈরাচারে পরিণত হন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে রয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান বা অন্য কোনো পদবির উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মকর্তা যে বা যারা সমরাস্ত্রের জোরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেন এবং দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সেনাবাহিনী থেকে উদ্ভূত শাসক এবং সাধারণ রাজনীতি থেকে উদ্ভূত স্বৈরশাসকের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতার গদিতে টিকে থাকার জন্য তাদের করণকৌশলও বিভিন্ন।‌ সামরিক নেতাকে কেবল তাঁর সামরিক বাহিনীর আনুগত্যের প্রতি দৃষ্টি রাখলেই চলে। জেনারেলরা ঠিক থাকলে সব ঠিক।‌ কিন্তু রাজনৈতিক স্বৈরশাসককে একদিকে যেমন সামরিক বাহিনীকে পদানত রাখতে পারতে হয়, অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে হয়।  ‌‌

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম স্বৈরশাসকের নাম ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো। এই সামরিক জেনারেল ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি দীর্ঘ ছত্রিশ বছর স্পেন ও এ দেশের জনগণকে কঠিন নিগঢ়ে বেঁধে পদানত করে রেখেছিলেন। রাষ্ট্রের সর্ববিধ ক্ষমতা তিনি কুক্ষিগত করেছিলেন। কথিত আছে, হিটলারের চেয়েও বেশি ক্ষমতা তিনি প্রয়োগ করেছেন। তাঁর শাসনামলকেই সারা পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদী শাসন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ফ্যাসিবাদী শাসককে দেশ ছেড়ে নির্বাসন বেছে নিতে হয়নি। দেশেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সৌভাগ্য তিনি লাভ করেছিলেন। 

৩. 

স্বৈরশাসকের পতন হলেই দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসবে এরকম সমীকরণ সুনিশ্চিত নয়।‌ বহু দেশে দেখা যায় বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রক্ষমতা এক স্বৈরাচারের হাত থেকে আরেক স্বৈরাচারের হাতে চলে যায়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য,‌ গণতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য যেসব শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন পৃথিবীর বহু দেশে সেসব অনুপস্থিত। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট শাসনের গোড়াপত্তন হয়। ইতোমধ্যে একাদিক্রমে পাঁচজন একনায়ক দেশটি শাসন করেছেন। মাও সে তুং-এর পরে এসেছেন দেন শিয়াও পিং, জিয়াং জেমিন, হু জিনতাও। অতঃপর, ২০১২ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রয়েছেন শি জিনপিং। বলা হয়, চীনের শাসনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বৈরাচারমূলক।

১৯৭৯ সালে ইরানের শাসনকর্তা রেজা শাহ পাহলভিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ঠিকই কিন্তু দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয় ইসলামী শাসকমণ্ডলী। ‌ 

পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, শাসকের পরিবর্তন হয় কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা টিকে থাকে। নিকারাগুয়াতে আমরা দেখেছি, সোমোজা পরিবার ১৯৩৬ থেকে ১৯৭৯ সাল অবধি দীর্ঘ ৪৩ বছর দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। নিকারাগুয়ায় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন আনাসতাসিও সোমোজা গার্সিয়া। তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরাই ক্ষমতা দখল করে দেশের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ১৯৭৮-৭৯ পর্বে সোমোজা স্বৈরতন্ত্রের অবসান হয়; নিকারাগুয়ার ক্ষমতা দখল করে স্যানডিনিস্টারা। 

অন্যদিকে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে তিউনিসিয়ার বিক্ষোভকারী জনগণ স্বৈরাচারী শাসক সিনে বিন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং সামরিক বাহিনী এবং সুশীল সমাজ যৌথভাবে দেশটিতে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্য চেষ্টা করে সফল হয়। তথাকথিত আরব বসন্তের এটিই একমাত্র সফল উদাহরণ।

৪.

বিংশ শতাব্দীর কয়েকজন কুখ্যাত স্বৈরাচারের মধ্যে একজন হিটলার। ‌তাঁর নির্মমতা ছিল তুলনারহিত। তাঁর ফ্যাসিবাদী শাসনে লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ‌ কথিত আছে, শত্রুর হাতে ধরা পড়ার আগে হিটলার আত্মহত্যা করেছিলেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর সময় বা সুযোগ তাঁর ছিল না।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পথে। হিটলার মাটির নিচে খোদাই করে বানানো তাঁর প্রশস্ত বাঙ্কারে অবস্থান করছিলেন। এ সময় খবর আসে সোভিয়েত সেনাবাহিনী বার্লিনের কাছে চলে এসেছে; হিটলারের পতন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এ খবর পেয়ে হিটলার পিস্তল দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করেন। সেদিন ছিল ২৬ এপ্রিল ১৯৪৫। তাঁর প্রেমিকা ইভা ব্রাউনও একইভাবে আত্মহত্যা করেন। কয়েকদিন আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং দেহভস্ম মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।   

১৯৪০-এ ইতালির বেনিতো মুসোলিনি নাজি জার্মানির পক্ষাবলম্বন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইতালির পতন ঘটে ১৯৪৫ সালে। মুসোলিনির সদরদপ্তর ছিল মিলানে। ১৯৪৫-এর ২৫ এপ্রিল তিনি স্ত্রী ক্ল্যারেতা পেতাচ্চিকে নিয়ে মিলান থেকে সড়কপথে পালিয়ে যান। লক্ষ্য ছিল সুইজারল্যান্ডে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করা। দু’দিন চলার পর পথিমধ্যে তারা ধরা পড়েন সুইজারল্যান্ডের সীমান্তের কাছাকাছি ডঙ্গো নামক স্থানে, স্থানীয় বিরোধীদলীয় কর্মীদের হাতে। পরদিন মুসোলিনি ও তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। 

নিকোলায় চাউসেস্কু ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত রোমানিয়া শাসন করেন। কমিউনিজমবিরোধী প্রলম্বিত আন্দোলন ও বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে তিনি তাঁর স্ত্রী এলেনাকে নিয়ে ১৯৮৯-এর ২২ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে করে রাজধানী থেকে পালিয়ে যান। ‌ দুপুর ১২টার দিকে তারা তাদের স্নাগভ আবাসস্থলে এসে পৌঁছান। ‌ সেখান থেকে আবার হেলিকপ্টারে চড়ে পিতেস্তির দিকে। অ্যান্টিএয়ারক্র্যাফটের গোলা থেকে বাঁচতে পাইলট ভ্যাসিল মালুতান  বুখারেস্ট-তারগোভিস্তে সড়কে হেলিকপ্টার অবতরণ করান। চাউসেস্কুর লক্ষ্য ছিল তারগোভিস্তে গিয়ে পৌঁছা। দু’বার গাড়ি বদল করে শেষ পর্যন্ত গাড়ি ফেলে চাউসেস্কু তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। ‌কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বিপ্লবীরা ইতোমধ্যে সারাদেশ দখল করে নিয়েছিল। ‌খবর পেয়ে সৈন্যরা চলে আসেন এবং চাউসেস্কু এবং তাঁর স্ত্রীকে আটক করেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তাদের গ্যারিসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রোমানিয়ার টেলিভিশনে চাউসেস্কুর গ্রেপ্তারের খবর প্রচলিত হলে সারাদেশের মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে। ‌ ২৪ ডিসেম্বর তাদের বিচারের জন্য একটি মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পর দিন ২৫ ডিসেম্বর ভোর পাঁচটার দিকে চাউসেস্কুকে সামরিক গ্যারিসনের কমান্ড অফিসে নিয়ে আসা হয়। এখানেই অস্থায়ীভাবে নির্মিত বিচারালয়ে দ্রুতগতিতে মাত্র ৫৫ মিনিটে তাদের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়। ‌তাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল গণহত্যা। অভিযোগ ছিল, দেশের সাধারণ মানুষের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা এবং অন্যূন ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা, জনসম্পত্তি বিনষ্ট করা এবং বিবিধ অগ্রহণযোগ্য নীতিগ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া। দুর্নীতি করে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ তো ছিলই। বিচারের সময় চাউসেস্কু বারবার বলতে থাকেন, এই সামরিক আদালতের কাছে তিনি কোনো জবানবন্দি দেবেন না বা আনীত অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবেন না। বরং তিনি দেশের সংসদের কাছে জবাবদিহি করবেন।

সামরিক ট্রাইব্যুনাল নিকলায় চাউসেস্কু এবং তাঁর স্ত্রী এলেনা চাউসেস্কুকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে এবং তাদের সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে। ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়। ‌ বিদেশের ব্যাংকে চাউসেস্কুর এক বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ গচ্ছিত ছিল।

তাদের শেষ দুটি ইচ্ছা ছিল যেন তাদের দু’জনকে একসঙ্গে গুলি করা হয় এবং তাদের হাত যেন পেছনে বাঁধা না হয়। বেলা তিনটার কিছু আগে তাদের একটি দেয়ালের ধারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চাউসেস্কুর চোখে পানি চলে আসে। ‌তারপরেও তিনি চেঁচিয়ে বলতে থাকেন: বিশ্বাসঘাতকদের মরণ হোক, সমাজতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক, ইতিহাস আমাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবে। তারপর তিনি ইন্টারন্যাশনালের অংশ বিশেষ গাইতে থাকেন। সৈন্যদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে ১২০টি বুলেট ছুটে এসে তাদের দু’জনের শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রোমানিয়ার টেলিভিশনে চাউসেস্কুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার খবর প্রচার করা হয়।

৫.

কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট আস্কার আকায়েভ ১৯৯০ সাল থেকে ১৫ বছর কিরগিজস্তান শাসন করেছেন। তাঁর পতন হয়েছে যাকে বলা হয় ‘টিউলিপ রেভোলিউশনে’র মধ্য দিয়ে। কিরগিজস্তান ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ।‌ ১৯৯১ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আকায়েভ রিপাবলিক অব কিরগিজস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তবে এ নির্বাচনে আকায়েভ ছাড়া আর কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। পরবর্তীকালে ১৯৯৫ এবং ২০০০ সালে তিনি আরও দু’বার রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন নির্বাচনের মাধ্যমে কিন্তু এসব নির্বাচন ছিল মহাকারচুপি। ‌ ২০০২-এর মার্চ মাসে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।‌ সারাদেশে আকায়েভের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে এবং মানুষ নানাভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে।‌ ২০০৫ সালের নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়। আকায়েভের দুই ছেলে এ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ‌সবার আশঙ্কা ছিল আকায়েভ তাঁর কোনো না কোনো ছেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারপর পদত্যাগ করবেন। ‌ 

জনগণের আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে। দেশব্যাপী জনরোষ ঘনীভূত হতে থাকে। ‌ পতন সমাসন্ন টের পেয়ে আকায়েভ আলোচনার প্রস্তাব করেন। তাতে কাজ হয়নি। ‌ ২৩ মার্চ বিক্ষোভ প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য আকায়েভ তাঁর এক মন্ত্রী এবং জেনারেল প্রসিকিউটরকে বরখাস্ত করেন। ২৪ মার্চ বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতির বাসভবনে ঢুকে পড়ে এবং ক্ষমতার চৌহদ্দি দখল করে নেয়। কালক্ষেপণ না করে‌ আকায়েভ তাঁর পরিবারের সদস্য নিয়ে একটি পরিবহন বিমানযোগে দেশ ত্যাগ করেন। তিনি কাজাখস্থান হয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে রাশিয়া থেকে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন। ‌

আস্কার আকায়েভ পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। ‌এখন তিনি মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। তদুপরি প্রিগোগিন ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল ইনভেস্টিগেশন অব কমপ্লেক্স সিস্টেমসে সিনিয়র রিসার্চার হিসেবে গবেষণা করছেন। ‌এ ছাড়াও নানা গবেষণামূলক কাজে তিনি সম্পৃক্ত। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত ক্রিমিনাল প্রসিকিউশন প্রত্যাহার করা হয়েছে।

৬.

মবুতু সেসে সেকো ১৯৭১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ৩১ বছর রাষ্ট্রপতি হিসেবে জায়ের শাসন করেছেন। জায়েরের ঐতিহাসিক নাম কঙ্গো। ১৯৯৭ সালে মবুতুর পতনের দেশটির নাম পুনরায় কঙ্গো করা হয়। ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে তিনি অপরিমেয় অর্থ লোপাট করেছিলেন। মনে করা হয় তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে লুটেরা শাসক। মবুতু মনে করতেন তিনি জায়েরের জন্য অনেক কিছু করেছেন; যার তুলনা পৃথিবীতে নেই। ১৯৭২ সালে তিনি নিজেকে আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৯৬-এর শেষ দিকে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। তাতে সমর্থন দেয় রোয়ান্ডা ও উগান্ডা। সুইজারল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন ক্যান্সারে আক্রান্ত মবুতু। বিক্ষোভ প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করেননি।

১৯৯৭ সালের ১৬ মে  মবুতু ক্ষমতাচ্যুত হন। শুরু থেকেই মবুতুকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছিল ফ্রান্স। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ফ্রান্স তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি একটি পরিবহন বিমানে করে টোগোতে পালিয়ে যান। টোগোতে আশ্রয় পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কয়েকদিন যাওয়ার পরই তাঁকে বিদায় করে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মরোক্কো এই পতিত স্বৈরাচারকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়। ২৩ মে তিনি মরোক্কো এসে পৌঁছান। মাত্র চার মাস পর ৬৬ বছর বয়সে মরোক্কোর রাবাতে তাঁর মৃত্যু হয়। 

আরও পড়ুন

×