ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বইয়ের ভুবন

গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ

গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ

গণমানুষের অর্থনীতি ও বঙ্গবন্ধু ,লেখক, মোহম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম, প্রকাশনা, আলোঘর প্রকাশনা, প্রচ্ছদ-শতাব্দী জাহিদ; দাম-৩৫০ টাকা

গোলাম কিবরিয়া

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১ | ১২:০০

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক ভাষণটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার মূল কথাটি ছিল মুক্তি। এ মুক্তি শব্দটির ব্যাপকতা ছিল বহুমাত্রিক। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল এই শব্দে। তিনি যে রাষ্ট্রচিন্তা করতেন তার মূলে ছিল সাধারণ মানুষ ও তাদের কল্যাণ। তার মতো করে তিনি তাই বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার কথা বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত করেছিলেন। গণমানুষের সেই অর্থনৈতিক মুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা, অবদানসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মোহম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের বই 'গণমানুষের অর্থনীতি ও বঙ্গবন্ধু'। বইটিতে মূলত মহান এই নেতার গণমানুষ নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিবৃত করার প্রয়াস পাওয়া গেছে। তবে লেখক শুধু এর মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ না রেখে গণমানুষের আর্থিক দুর্দশার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। যেখানে ব্রিটিশ ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তানে বাংলার মানুষ কীভাবে শোষিত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল সে আলোচনা প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে। পাঠক বইটি পড়ে তৎকালীন সময়ে বাঙালির অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাবেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে কী ভাবতেন এবং কীভাবে তা কার্যকর হয়েছিল তার সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়কে কয়েকটি উপশিরোনামে বিভক্ত করে আলোচনা করা হয়েছে। লেখক বইয়ের ভূমিকাংশে বইটি গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে না বলে তার আদলেই রচনার কাজ সম্পন্ন করার কথা বলেছেন। বইটির প্রথম অধ্যায়ে বাংলার ঐতিহাসিক পটভূমি স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া ছিল ঔপনিবেশিক শাসনামলে গণমানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল তার বর্ণনা। ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ ও পূর্ববাংলার আর্থিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার বর্ণনাও। এসব অংশে পাঠক ইতিহাসের হাত ধরে কল্পনার জগতে চলে যাবেন। যে জগতে দেখতে পাবেন পূর্ববাংলার মানুষকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে কী নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এসেছে বৈষম্যহীন অর্থনীতি বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, কর্মপ্রণালি ও ঐতিহাসিক সমবায় ভাবনার কথা। যে ভাবনা গণমানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে 'সমবায় দিবস' পালন করা হয় ১৯৭২ সালের ২ নভেম্বর থেকে। ১৯৭২ সালের ৩ জুন জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠায় সমবায় ভাবনার কথা তুলে ধরেন তার ঐতিহাসিক বক্তব্যে। বক্তব্যটি বইয়ে স্থান পেয়েছে। এর একাংশ ছিল-
'আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ-সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন-যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবেন। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদের সুসম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষি গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবেন। জোতদার ধনী চাষির শোষণ থেকে তারা মুক্তি লাভ করবেন সমবায়ের সংহত শক্তির দ্বারা। একইভাবে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি একজোট হয়ে পুঁজি এবং অন্যান্য উৎপাদনের মাধ্যমে একত্র করতে পারেন, তবে আর মধ্যবর্তী ধনিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতির গোষ্ঠী তাদের শ্রমের ফসলকে লুট করে খেতে পারবে না। সমবায়ের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প, যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতিত দুঃখী মানুষ। সমাজতন্ত্র স্থাপনের জন্য আমরা ইতোমধ্যে সব বড় শিল্প, ব্যাংক, পাটকল, চিনিকল, সুতাকল ইত্যাদি জাতীয়করণ করেছি। জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। আজ সমবায় পদ্ধতিতে গ্রামে গ্রামে, থানায়, বন্দরে গড়ে তুলতে হবে মেহনতি মানুষের যৌথ মালিকানা। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবেন ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবেন শ্রমের ফল ভোগের ন্যায্য অধিকার। কিন্তু এই লক্ষ্যে যদি আমাদের পৌঁছাতে হয় তবে অতীতের ঘুণে ধরা সমবায় ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে এক সত্যিকারের গণমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অতীতের সমবায় ছিল শোষক- গোষ্ঠীর ক্রীড়নক। তাই সেখানে ছিল কোটারি স্বার্থের ব্যাপক ভূমিকা। আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে ওই ধরনের ভুয়া সমবায় কোনো মতেই সহ্য করা হবে না। আমাদের সমবায় আন্দোলন হবে সাধারণ মানুষের যৌথ আন্দোলন। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান।' লেখক নিজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রাখেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে ব্যাংকিং পরিমণ্ডলে দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে লেখকের অগাধ জ্ঞান থাকায় পাঠকের সামনে সে সময়কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দারুণ দক্ষতায় তিনি তুলে ধরেছেন।
গণমানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে আন্তরিক ভালোবাসা ছিল, তা উঠে এসেছে লেখকের লেখনীতে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধুর কৃষকপ্রীতির কথা। কিশোর বয়স থেকে রাজনৈতিক জীবন পর্যন্ত কৃষকের অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে সরব ছিলেন মহান এ নেতা। লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃষি উন্নয়ন ভাবনা, স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন কর্মপ্রণালির কথা তুলে ধরেছেন; যা যে কোনো প্রজন্মের জন্য এক অসাধারণ ইতিহাস পাঠ হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর জাতীয়করণ কর্মসূচি শিরোনামের অধ্যায়ে কর্মসূচির পটভূমি, জাতীয়করণ কর্মসূচির বর্ণনা লেখক সহজ, পাঠযোগ্য ভাষায় তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ভূমিকাও উঠে এসেছে। যেখানে দেখানো হয়েছে বৈষম্য নিরসনে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কীরূপ ভূমিকা পালন করেছিল সে সময়। সবমিলিয়ে বইটি সাম্প্রতিক প্রকাশনা জগতে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে থাকবে সে আশা করা যায়।

আরও পড়ুন

×