প্রচ্ছদ
প্রসাদ কভু, কভু তবু দাসত্ব

মানস চৌধুরী
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১ | ১২:০০
লিঙ্গাচার
লিঙ্গ বিষয়ক আচারাদি নিয়ে বিদ্যাজগতে বেশ আলাপ-আলোচনা হয়ে গেছে। আর বিদ্যাজগতে কোনো আলাপ শুরু হয়ে গেলে সেটার মোটামুটি ছালচামড়া না উঠে যাওয়া পর্যন্ত আলাপ চলতেই থাকে, অন্তত যতক্ষণ না আরেকটা বা দুইটা প্রমাণ সাইজের পদবাচ্য এসে সকলকে উদ্দীপ্ত করে। মোটামুটি এমনটাই রীতি, রাজনীতির দুনিয়াতে যেমন। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, রাজনীতির দুনিয়ার তুলনায় বিদ্যাজগতে পদবাচ্যের আয়ু গুরুত্বপূর্ণভাবে কম। চটকাচটকি কম নয়। এরকমভাবে বলার কারণ হলো, মোটের উপর আমি মনে করি যে, যেভাবে ও যে-হারে নয়া নয়া ক্রিটিক্যাল পদবাচ্য বা বর্গ বা ধারণা চর্চিত হতে থাকে, তার ধারেকাছেও বিদ্যাকর্মীদের যাপিত জীবনে, বোধে, অনুভবে সেসবের আছর তেমন পড়ে না। ওগুলো রচনা কিংবা বচনার অনুষঙ্গ হয়ে থাকে মাত্র। আবারও রাজনীতির দুনিয়ার মতোই। গণতন্ত্রের বাণী ট্রাম্প বলুন না (মার্শাল) টিটো, সংশ্নিষ্ট ভোক্তাকুল খুব হৃদয়ভরে তা গ্রহণ করে থাকার কারণ নেই। ট্রটস্কি বলে থাকছিলেন কিনা জানা নেই আমার; তিনি বলে থাকলেও কিছু আসে যায় না, কারণ তিনি অশাসক ও মুখ্যত বিতাড়িত। বিদ্যাকর্মীরা এদিক থেকে অনেক সুবিধায় থাকেন। তাঁরা অপেক্ষাকৃত স্বল্পায়ু জিনিসপাতির মালিক হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের গৃহীত হবার চল অনেক তীব্র ও আন্তরিক। তবে, বলাই বাহুল্য, আমার প্রস্তাব মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছে যে, তাঁদেরকেও অত গুরুতরভাবে গ্রহণ না করাই গ্রহীতাকুলের জন্য বিচক্ষণ আচরণ হবে। তারপরও লিঙ্গের পারফরমিটি নিয়ে তুলকালাম কিছু বোঝাবুঝির জগৎ বদলে গেছে। সেই সম্মানদান আমার তরফে কম নেই তা বলতে পারি।
তবে এসব হৈচৈয়ের ঢের ঢের আগেই আমার শৈশবে আমি পুতুল খেলতাম। খেলতাম বলা চলে, আবার অন্যদের খেলায় আমি সাথিরূপে বলবৎ ছিলাম তাও বলা যায়। পয়লা দফা গুরুতর সংগঠক ছিলেন আমার মাসি, যিনি আসলে আমার থেকে মাস ছয়েকের বড় ছিলেন, এখনও অতটুকুই বড় আছেন। আর দ্বিতীয় দফার সংগঠক ছিলেন আমার ছোটবোন যিনি আমার থেকে সাড়ে তিন বছরের ছোট ছিলেন, এখনও তাই আছেন। আমার ছোটবোন নামেই মাত্র ছোটবোন। ওঁর চালচলন, হাবাগোবা বড় ভাইকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে উদ্ধারপ্রচেষ্টা, দৌড়াদৌড়ি-হুড়াহুড়ি, গুরুতর গোলযোগ বাধিয়ে এক দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারার সামর্থ্য ইত্যাদি বিচারে তিনি আমার বয়োজ্যেষ্ঠ হবার সমূহ সব গুণ ধারণ করতেন। তাঁর অতি শৈশবে একবার আমি সহপাঠীদের 'ইতরামি' (বুলিংয়ের এই বাংলা এই রচনার জন্য গ্রাহ্য হতে পারে) সহ্য করে যখন অশ্রুসজল চোখে বাসায় ফিরেছি, অন্য শিফটের ক্লাস ওয়ানে পড়া আমার ছোটবোন অগ্রজের দুর্দশা দেখে মুহূর্তকাল দেরি না করে একটা লাঠি নিয়ে এসে মায়ের কাছে ঘোষণা করে বসলেন, ওটা ঘোষণাই, কোনো অনুমতি প্রার্থনা ছিল না, তিনি এখন ওই লাঠি নিয়ে স্কুলে যাবেন। এহেন বড়বোনস্বরূপা ছোটবোন পেয়ে শৈশবে আমার ব্যর্থ পুরুষজীবন ধন্য ছিল। আবার এই বিবরণীগুলো থেকেই অতি সহজে আমার পুতুল খেলার সকল কারণই প্রতিভাত হওয়া সম্ভব। এরকম নেতৃস্থানীয়া একজন ব্যক্তিত্ব যা যা করবেন, তার সঙ্গে সেসবে সঙ্গ দেয়া খুবই সাধারণ সামাজিক-পারিবারিক আচরণের মধ্যেই পড়ে। পুতুল খেলা তো অতি অবশ্যই। দ্বিতীয়ত, আমার শক্তিসামর্থ্য আর দুনিয়ার সকল কিছুতে ভীতি-সন্ত্রস্ততা আমাকে যাবতীয় পুরুষ জগতের ক্রীড়াজগৎ থেকে নিষ্ঠুরভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আমি একদিন খেলার মাঠে নেহায়েত দর্শক হিসাবে যাই তো পরের ১৭ দিন আমার আম্মাজানের ঘ্যানঘ্যান করা লাগত যাতে আমি একটু বের হয়ে নিছক বাতাসও গায়ে লাগিয়ে আসি। আমার সমবয়সী সকল পুরুষশিশুর তুলনায় এই পরিস্থিতি বেখাপ্পা রকমের বিপ্রতীপ ছিল।
ফলে আমি যে লাগাতার আমার ছোটবোনের যাবতীয় সখীদের সঙ্গে পুতুলখেলা অব্যাহত রেখেছিলাম, ঘটনা কেবল তাই-ই নয়, বরং সাক্ষীসাবুদদের মতে আমি সেসব পুতুলের দর্জি হিসাবে অচিরেই খ্যাতি অর্জন করেছিলাম। ছোটবোনের সাথিকুল, সেইসব সমতুল্য দজ্জাল (অর্থাৎ কিনা সনাতনী সাহিত্যের পদবাচ্য হিসাবে যাকে ডানপিটে বলা হতো) নারী-শিশুরা আমাকে যারপরনাই কদর করতেন। আমার দর্জিগুণ তাদের পুতুলরাজ্যের পরিকল্পনার অবধারিত অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছিল। উত্তরকালে আমার বোনের পুতুলের জন্য আমি পুরাদস্তুর সোয়েটার বানিয়ে ফেলার ঘটনা প্রকাশ পেয়ে গেলে, দিকে দিকে শিশু ছোটবোনকুলে ক্যারিশম্যাটিক বড়ভাই হিসাবে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আমি আরো কিছু পুতুলের সোয়েটার বানিয়ে দেবার অনুরোধ পাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, লাঠিহাতে সাড়ে তিন বছরের বড় ভাইকে রক্ষাকারী যে ছোটবোনের অস্তিত্ব তা লিঙ্গের যে আচার/পারফরম্যান্সের ইঙ্গিত দেয়, তাঁর নিবিড় পুতুলখেলা তা দেয় না। উপরন্তু, তাঁর হাবাগোবা ভীতসন্ত্রস্ত (তখন তাই ছিলাম) বড়ভাইয়ের পুতুলখেলাতে এরকম নিবিড় অবিচ্ছেদ্য সাথি হয়ে পড়াতে আরো প্যাঁচালো হয়ে পড়ে পরিস্থিতি। এতদ্সংক্রান্ত বিদ্যাকর্মীরা অবশ্যই আরো সব বিদীর্ণকারী ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তবে আমাদের কাজ আপাতত এতেই চলবে।
গৃহ ও নিগ্রহ
নেটফ্লিক্স আর করোনা প্রায় একই সঙ্গে জীবনে এসেছে আমার। ফলে তামাম পৃথিবীর অধিকাংশ মধ্যবিত্তের মতোই আমার চলচ্চিত্রসেবন কিছুকাল প্রায় চলচ্চিত্রভোজন, এমনকি চলচ্চিত্রখাদনের পর্যায়ে গেছিল। নানান খোলাবাজারের মতোই এই পল্গ্যাটফর্মের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে ইংরাজি প্রভাববলয় সমেতও অন্যান্য ভাষার ছায়াছবি থাকে। খুঁজতে হতে পারে, সংখ্যায় সেগুলো কম হতে পারে, কিন্তু আছে। একদম ইন্দোনেশিয়া বা তুরস্কের ছায়াছবি পর্যন্ত। ঠিক যেরকম পাশ্চাত্যের কোনো শপিংমলে গিয়ে একটা নেপালি ধূপ/আগরবাতি বা পেশোয়ারি সালোয়ার পাবেন না- এতটা নিরাশার আপনার প্রয়োজন নেই, তেমনি নেটফ্লিক্সেও খালি হলিউড-বলিউড ভাবার কোনো কারণ নেই। সকল মালামালেরই স্যাম্পল আছে। আমার খাদনকালে স্প্যানীয়ভাষী ছবি আনব্রাইডেলড (মূল :অ্যানিমেলস সিন কোলার) দেখাটা একদমই আকস্মিক। মানে সার্ফাতে সার্ফাতে সামনে পড়া আরকি। প্রথমবার দেখে থ্রিলারখানাকে উপভোগ্যই লেগেছিল। কিন্তু তখনও লক্ষ্য করিনি যে, এটা ইবসেনের ডলস হাউজের একটা রূপান্তর, আসলে চমৎকার একটা রূপান্তর। এমনকি মুখ্যনারীর নামটাও নোরা। প্রথমবার খেয়াল যে করিনি তাতে একটু বোকা বোকা লাগল নিজের। তবে এটাও ঠিক যে, জগৎক্লাসিকের আমি তেমন কোনো পাঠক নই। ডলস হাউজ পরিচিত থাকা খানিকটা দৈবাৎ, অন্য অনেক সাহিত্য সম্বন্ধে আমার নূ্যনতম কোনো ধারণাই নাই। অ্যাডাপশন না হয়ে যদি পুকুরচুরিও হয়, আমি টের পাব না। এই ছবির কোথাও ইবসেনের নামোল্লেখ নেই। এমনকি এখন এই রচনাকালে দেখতে চেষ্টা করলাম আইএমডিবিতে আছে কিনা। নেই। পাশ্চাত্যের কপিরাইট আইন, অবলম্বন, রূপান্তর ইত্যাদি সমূহ প্যাঁচানো এবং তার সাপেক্ষে কোনোকিছু বিচার করতে আমি সাধারণভাবে রাজি থাকি না। এবং এই সূক্ষ্ণরসের অভিনয় আর হৃদয়গ্রাহী ছবিটিতে ইবসেন কীভাবে আছেন তা আবিস্কার করার কারণে বরং আমার আনন্দ বেশি হলো, তাঁর নামোল্লেখ থাকলে যা হতো না। ফলে এসব প্যাঁচানো প্রসঙ্গ। তবে এই অংশটি নিয়ে স্বতন্ত্র একটা চলচ্চিত্র-পর্যালোচনা রচনা করবার আশু কোনো পরিকল্পনা আমার নাই, সেটা জানিয়ে রাখা ভালো। চারপাশে রচনাকারদের মেলারকম 'পরামর্শক' লক্ষ্য করা যায় যাঁরা বলে থাকেন: 'এইডা একটু লম্বা কইরা উপন্যাস বানায়া ফেলতে পারেন', কিংবা 'এইডা নিয়ে একটা সিনেমা ক্যান বানান না?', কিংবা 'আপনি লেখক না? আপনেরে এমুন পল্গট দিব, কুনুদিনও শোনেন নাই'। এসব পরামর্শক গজিয়ে-ওঠার জন্য লেখকেরা সমূহ দায়ী। সেটা নিয়ে কখনো বলা যাবে। আজকে ডিসক্লেইমারের মতো জানিয়ে রাখলাম যে, আনব্রাইডেলড ছায়াছবি বিষয়ে পাঁচটি বাক্য লিখলাম বলে তা নিয়ে পর্যালোচনার আমার আশু সম্ভাবনা নাই; আর সেরকম যদি কখনো সাধ ও সময় ঘটে, তাহলে কোনো পরামর্শেরও দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না।
ইবসেনের দেখানো রাস্তাতেই হালের এই ছবিটির নায়িকা শেষমেশ ঘর ছেড়ে দেন। বা বলা দরকার পতি ছেড়ে দেন। চূড়ান্ত বিচারে পতিময় ঘরের ব্যাকরণ বদলাতে সেই বাস্তুসম্পর্কবিন্যাস ছেড়ে দেন। ইংরাজি নামে যে মরিয়াপনার ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে, সেটার নিজস্ব ধার বা ঝাঁঝ আছে। 'অদম্যা' 'অনমনীয়া' 'অপরাজিতা' যেভাবেই অনুবাদ করে নিন না কেন, বাংলা সাহিত্যধারার প্রবাহেও এইসব পদাবলিই পাবেন নারীর কর্তাসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে। তবে এটাও ঠিক বাংলায় যতটা প্রচারক্লিষ্ট বা ক্লিশে শোনাতে পারে, ততটা ইংরাজিতে নাও শুনিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বাংলায় ক্লিশে যদি শুনিয়ে থাকে, তার কি সহজ কারণ নির্ধারণ সম্ভব? এমন তো আর নয় যে, বাংলা সাহিত্যধারায় নারীস্বর প্রতিষ্ঠিত কিংবা ব্যাটাময়তা অপসৃত। কিংবা আরো সূক্ষ্ণভাবে বললে, এমন নয় যে, লিঙ্গীয় বৈষম্যের পাটাতনকে বাংলা সাহিত্য গুরুতরভাবে মীমাংসা করে ফেলেছে বলে এসব পদাবলি অধিকতর ক্লিষ্ট শোনায়। বরং, প্রস্তাব করি, এত নিবিড় প্যাট্রিয়ার্কি এখানকার সাহিত্যে, এবং সাহিত্যকারদের মধ্যে, যে এই শব্দগুলো পর্যন্ত পর্যাপ্ত কাব্যধর্মিতাসমেত রোম্যান্টিক হয়ে উঠে বসেছে, রাজনৈতিক হয়ে বসে পড়েনি ভাষায়। ফলে বাংলায় অপরাজিতা নোরা গৃহ থেকে না (ফিরে) গিয়ে ইংরেজিতে আনব্রাইডেলড নোরা আবেল ও তাঁর কথিত যুগলগৃহ থেকে রওনা দিলে এই পরিস্থিতিতে অধিক লিঙ্গীয় রাজনৈতিক শোনাচ্ছে। তিনি পরিত্যাগ করলেন গৃহ, ইবসেনেরও সেটাই ফয়সালা ছিল, সেই গৃহ যা কাগজে-কলমে যুগলের গৃহ, এমনকি এনলাইটেনমেন্ট-উত্তর খ্রিষ্টপ্রভু যে গৃহকে সমতাধর্মী বানানোর চেষ্টা করেছেন, স্বর্গলোক থেকে অবশ্যই। গৃহের মধ্যকার অসমতা ও ম্যানিপুলেশন নিয়ে বিস্তর আলাপ চলতে পারে। কখনো কখনো প্রচলিত ভোঁতাধার স্কিমেটিক নারীবাদ দিয়ে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে, তবে সেটা আজকের প্রতিপাদ্য নয়। তার থেকেও বড় কথা, দাম্পত্যমূলক ও একমুখী যৌনতার ধারণায়নপুষ্ট গৃহের ব্যাকরণ নিয়ে দু-দশটা আলাপ না করে গৃহকে সিদ্ধ ধরে এর মধ্যকার 'রোল' নিয়ে আলাপ অহেতু হতে বাধ্য। আমার বলনীয় বিষয় হলো, এখানে, ইবসেন নারীটির সংকল্প বা সম্মানবোধে ভর করে তাঁর নাটকের নাম দেননি। তিনি গৃহের ব্যাকরণে মনোযোগ দিয়েছিলেন।
'পুতুলের ঘর' এবং গৃহ 'ভাঙার' পরও নামটি তাসের ঘর নয়। ইবসেনের পুতুল প্রতিপালকের অস্তিত্বের শর্তসাপেক্ষ। পুতুলখেলার মায়ামাধুর্য থেকে ইবসেন তাঁর রসগ্রাহীদের সরান এবং খেলার পুতুলের নিষ্ফ্ক্রিয়তা ও ম্যানিপুলেশনকে বুঝতে জোর দেন। এত বছর পরও তিনি সমান অর্থবহ আছেন এই ম্যানিপুলেশনকে চিত্রিত করার কারণেই। নারীবাদী লড়াইগুলো, এর বহুবিধ স্বার্থময়তা আর বিচিত্র চিন্তাপাটাতনসমেতই, পুরুষালি ম্যানিপুলেশনকে, সূক্ষ্ণ সকল চালিয়াতিকে লাগাতার উন্মোচন ঘটাতে চেয়েছে বলে ইবসেন প্রাসঙ্গিক থেকেই গেছেন। অমল পালেকার তাঁর ২০০৫-এর ছবিতে পুতুলকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আবহ দিয়ে সামনে আনেন। পিছনে আনেন বললেও চলে। সিনেমাটির মূল কাহিনি বলতে সূত্রধর হিসাবে আসেন অন্তত দুই পুতুল। আর সিনেমা সমাপনীকালে একদল পুতুল আসেন, যতদূর মনে পড়ে জৈবশরীরের অভিনেতারা এবার পুতুলের দেহভঙ্গি নিয়ে আসেন। পালেকারের পুতুলপ্রয়োগ তাই গুণগতভাবে পল্টানধর্মী (সাবভারসিভ) আর বিপ্রতীপ (এডভারসিভ); আর ইবসেনের পুতুলপ্রয়োগের থেকে আমূল ভিন্ন।
খেলার বহুমাত্রিকতা
খেলা অত্যন্ত ব্যাপক ধরনের শব্দ বাংলা ভাষায়, এবং সেগুলো পুরাপুরি পরস্পরবিরোধী হতে সমর্থ। অন্যভাবে বললে, সকল শব্দেরই সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ অর্থ তৈরির সম্ভাবনা এর পেটের মধ্যেই নিহিত থাকে। সেটা আরেকটা সম্পূর্ণ ভিন্ন আলাপ; আর ভাষাবিদরা করলেই সবচেয়ে ভালো হয়। তবে কথা যেহেতু আমিই তুলেছি, তাই একটা দুইটা বিস্তার হিসাবে বলা চলে কোনো শব্দেরই আভিধানিক অর্থ বলে আসলে কিছু নেই। খোদ অভিধানেই, যদি আন্তরিক অভিধানপ্রণেতা তা বানিয়ে থাকেন, রাজ্যের গাদা গাদা অর্থ সন্নিবেশন করে থাকেন শব্দের বিপরীতে। তারপরও প্রয়োগগুণের অর্থ, পরিপ্রেক্ষিতের অর্থ, অর্থোদ্ঘাটনের পাত্রপাত্রীদের মনোজগতের অর্থ- এগুলো যথেচ্ছ অভিধান ফুঁড়ে বের হয়ে যেতে পারে। এটুকুই আপাতত বলবার ছিল। খেলা পদটির যে বহুমাত্রিক অর্থ তা বুঝবার জন্য নজরুলের 'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে' গানখানি সাহায্য করতে পারে, রবীন্দ্রনাথের 'খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি' সাহায্য করতে পারে, 'খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে'। যদি আমার কথার মানে দাঁড়ায় যে, এটা বাংলারই মাহাত্ম্য, তাহলে তা আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সাথে সাথেই মনে করিয়ে দেব যে ইংরাজি 'পেল্গ'ও এমন কিছু সহজ সরল নয়; এমনকি সফটওয়্যার গেমস আসারও বহু আগে থেকে 'গেম'ও সরল নয়। সারল্যের আরাধনা যাঁদের পোষায় পোষাক, ভাষা তার থেকে বহুগুণ জটিল বটে।
আনন্দময়তা থেকে পরাধীনতা, তাচ্ছিল্য থেকে লাস্যময়তা, নৈপুণ্য থেকে আত্মমগ্নতা এত এত অর্থ যে 'খেলা' তার পেটের মধ্যে ভরে রাখে তা ক্ষেত্রবিশেষে বিস্মৃত হতে পারি আমরা। এমনকি আমিও হতে পারি, যদি নেহায়েৎ অতিশয় অন্যমনস্ক থাকি। তবে বাস্তবে শব্দরাজ্যের এই মায়াবী ঘোরালো-প্যাঁচালো বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আমি বিস্মৃত থাকতে পছন্দ করি না, এমনকি একটা মুহূর্তও। এমনকি 'খেলার পুতুল' আর 'পুতুলখেলা' যৌগশব্দগুলো উচ্চারিত হবার সময়েই 'খেলার' অর্থ যে যথাক্রমে পুতুলের উপর কর্তৃত্বধারী আর পুতুলের অধীনস্থ সেটাও মনে পড়ে যায়। তার জন্য আলাদা করে গালে হাত দিয়ে ভাবতেও বসতে হয় না আমার। এই আমিটাকে যে জোর দিয়ে দিয়ে গাঢ় করে সামনে আনলাম, তা নিছকই 'আমিটা'র স্বার্থে নয়, খোদ খেলারই স্বার্থে। খেলতে-খেলতে অর্থের দুনিয়ার নানান পর্দা সরিয়ে ফেলা যায়, নানান পর্দা বা বর্ণাভাস (শেড) দিয়ে নতুন করে আস্তর দেয়া যায়, সেই সম্ভাবনাটা নেহায়েৎ কয়েকটা বাক্য লিখতে-লিখতে, বলতে-বলতে হাজির করার ক্রীড়াময়তা বা খেলাশীলতা উপভোগ করতে চেয়েছি মাত্র। খেলাই!
সক্রিয়তা/এজেন্সির কারিগরি
পুতুলখেলাতে পুতুল থাকেন সক্রিয়তার জাগরূক প্রতিনিধি হিসাবে, আপনার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। এখন চাইলে আপনি এই পরিস্থিতিকে রাবীন্দ্রিকভাবে বলতেই পারবেন আপনারই 'চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনী হলো লাল'। বহু পুরাতন, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, তবু এটা বলা চলবে। এই বলার মাধ্যমে পুতুলেরা তাঁদের অজৈব জীবনে গাঢ়ভাব পেলেন, কিন্তু তার বিনিময়ে আপনি পুতুলমালিক, এই মুহূর্তে পুতুল-খেলুড়ে, গৌণভাব পেলেন না; হারালেন না আপনার জৈবজীবনের অর্জিত গাঢ়ভাব, যদি তাই হয়। এই যে পুতুল আর আপনি একত্রেই গাঢ়ভাব পেলেন, সিরিয়াসনেস অর্জিত হলো আপনাদের স্বীয় স্বীয় অস্তিত্বদশাতে, এখানেই খেলার মাহাত্ম্য। আপনার সক্রিয়তাই পুতুলের সক্রিয়তা, আপনার প্রসাদেই পুতুল রঞ্জিত। আপনার এই প্রসাদ যতটা আত্মপ্রসাদ, ততটাই পুতুলপ্রাসাদ। পুতুলেরা তখন ওই ছোট বাক্সগুলোতে একেকজন রাজকীয় হয়ে ওঠেন, কিংবা গৃহস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা লিঙ্গভেদে রাজকন্যা কিংবা রাজপুত্রের মর্যাদালাভ করেন। কিংবা গৃহস্থের স্নেহধন্য নিছক পুত্র বা কন্যা হন। তাঁরা সেই বাক্সগুলোতে ঘুমান, জাগেন, আবার হাসিমুখে ঘুমান। তাঁরা আপনার যত্নে বানানো পোশাকগুলো পরিধান করেন, কিংবা হয়তো শীতের দিনে সোয়েটারও। তারপর আপনারই মেন্যুতে রান্নাবান্না করেন। কিংবা তাঁদের জন্য, তাঁদের হয়ে আপনি রেঁধে দেন। তখন আপনার হুকুমত চলছে নাকি পুতুলের হুকুমত সেটা অত সহজে আপনার পুথিপড়া থিউরি দিয়ে নিষ্পত্তি নাও হতে পারে। আপনি পুতুলের এই দৈনন্দিন রাজকীয় কিংবা গার্হস্থ্য জীবনযাপনের লিপিকার; আবার একাধারে পুতুলরাজ্যের বিধান অনুযায়ী আপনি এদের হুকুমপালনকারী শুধু। এইসব পুতুলেরা লিপির সমাপ্তিপর্বে আবার তাঁদের প্রাসাদে ফিরে গেলেই কেবল আপনি ছুটি পাবেন। এক-আধদিন বাবার কান ডলাতে কিংবা অন্য কোনো উত্তেজনাতে মাঝপথে পুতুলরাজ্যের নিয়ম ভেঙে আপনি যে দৌড় লাগাবেন না তা নয়। কিন্তু মোটের উপর এই বিধানের লঙ্ঘন অসম্ভব। পুতুলেরা তাই, আপনার সাপেক্ষে হলেও, জাগরূক সক্রিয়।
একদিকে এটা আপনার স্ট্ক্রিপ্টের গুণ, আপনার চিত্রলিপিমালা, আপনার কল্পনা। ছবি-আঁকিয়ে শিশুরা, তা তাঁরা যেমন চিত্রকরই হোন, সাধারণত তাঁদের প্রত্যেকটা রেখা বা বিন্দুর পাশাপাশি বিশদ সব কাহিনি বলতে থাকেন। তাঁদের কাহিনির বাইরে ওই রেখা কিংবা বিন্দুগুলোর কোনো অর্থ নির্ণয় অসম্ভব। বড়রা এই কাজগুলো করেন সাধারণত গ্রাফ ও পরিসংখ্যান দিয়ে; তবে সেটাও আরেকদিনের আলাপ। তো, শিশুদের ওই বিবরণীর মালিক যে শিশু তাঁর নিজের এজেন্সি ছাড়া তাঁর চিত্রকর্মের পাত্রপাত্রীদের এজেন্সি বোঝার চেষ্টা উদ্ভট কাজ, আপনি যেসব তত্ত্বই পড়ে আসেন না কেন। ঠিক সমরূপভাবে, পুতুলখেলার খেলোয়াড়দের এজেন্সিকে কেন্দ্রে রেখে পুতুলের এজেন্সি বুঝতে হবে। আমার প্রস্তাবই কেবল নয়, আমার দাবি রীতিমতো। এই নৈমিত্তিকতাকে নিম্নরেখা দিয়ে পাঠ করা দরকার। আপনি পুতুলপ্রাসাদটাকে টেনে বের করেন, আপনার বিবরণী সত্তা জাগ্রত হয়। আপনি মুখে সেই বাণী উচ্চারণ করতে থাকুন বা না-থাকুন আপনারই চিত্রলিপিতে পুতুলেরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আর পুতুলরাজ্যের বিধান প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে, পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেতে থাকে।
তারপর কোনো একদিন নানান কারণে, আচমকা কিংবা ধীরে ধীরে; চটজলদি সিদ্ধান্ত মোতাবেক কিংবা নিছকই খেলায়-খেলায়, খেল খেল মে, একদিন, কোনোদিন, কোনো এক এখন ভুলে-যাওয়া দিনে, সেসব পুতুলগুলো আপনার প্রসাদবঞ্চিত হতে শুরু করেন। তাঁরা তখন তাঁদের প্রাসাদে ঘুমাতে ঘুমাতে মমি হয়ে পড়েন। প্রাসাদগুলো আবার কাঠের বা টিনের বাক্সে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। এরপর কোনো একদিন যখন সেগুলোকে টেনে বের করেন আপনি, বা আপনার আশপাশের কেউ, তখন তিনি আর এসব পুতুলের অজৈব সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকেন না। সেসব অপসৃত হলেই বরং বাক্সগুলো টেনে বের করা হয়। আর পুতুলেরা তখন খেলার পুতুলে পরিণত হয়। তখন সেগুলোকে পরিত্যাগ করা যায়। আরো নিশ্চিত করে বললে, পরিত্যক্ত হয়েই তাঁরা থাকছিলেন ওসব বাক্সগুলোতে, যা কিছুকাল আগেই প্রাসাদ ছিল।
অজৈব (পরিত্যক্ত) পুতুলেরা আপনাকে পরিত্যাগ করে চলে যেতে পারেন না, নোরার মতো! ফেলে দিন!
লিঙ্গ বিষয়ক আচারাদি নিয়ে বিদ্যাজগতে বেশ আলাপ-আলোচনা হয়ে গেছে। আর বিদ্যাজগতে কোনো আলাপ শুরু হয়ে গেলে সেটার মোটামুটি ছালচামড়া না উঠে যাওয়া পর্যন্ত আলাপ চলতেই থাকে, অন্তত যতক্ষণ না আরেকটা বা দুইটা প্রমাণ সাইজের পদবাচ্য এসে সকলকে উদ্দীপ্ত করে। মোটামুটি এমনটাই রীতি, রাজনীতির দুনিয়াতে যেমন। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, রাজনীতির দুনিয়ার তুলনায় বিদ্যাজগতে পদবাচ্যের আয়ু গুরুত্বপূর্ণভাবে কম। চটকাচটকি কম নয়। এরকমভাবে বলার কারণ হলো, মোটের উপর আমি মনে করি যে, যেভাবে ও যে-হারে নয়া নয়া ক্রিটিক্যাল পদবাচ্য বা বর্গ বা ধারণা চর্চিত হতে থাকে, তার ধারেকাছেও বিদ্যাকর্মীদের যাপিত জীবনে, বোধে, অনুভবে সেসবের আছর তেমন পড়ে না। ওগুলো রচনা কিংবা বচনার অনুষঙ্গ হয়ে থাকে মাত্র। আবারও রাজনীতির দুনিয়ার মতোই। গণতন্ত্রের বাণী ট্রাম্প বলুন না (মার্শাল) টিটো, সংশ্নিষ্ট ভোক্তাকুল খুব হৃদয়ভরে তা গ্রহণ করে থাকার কারণ নেই। ট্রটস্কি বলে থাকছিলেন কিনা জানা নেই আমার; তিনি বলে থাকলেও কিছু আসে যায় না, কারণ তিনি অশাসক ও মুখ্যত বিতাড়িত। বিদ্যাকর্মীরা এদিক থেকে অনেক সুবিধায় থাকেন। তাঁরা অপেক্ষাকৃত স্বল্পায়ু জিনিসপাতির মালিক হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের গৃহীত হবার চল অনেক তীব্র ও আন্তরিক। তবে, বলাই বাহুল্য, আমার প্রস্তাব মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছে যে, তাঁদেরকেও অত গুরুতরভাবে গ্রহণ না করাই গ্রহীতাকুলের জন্য বিচক্ষণ আচরণ হবে। তারপরও লিঙ্গের পারফরমিটি নিয়ে তুলকালাম কিছু বোঝাবুঝির জগৎ বদলে গেছে। সেই সম্মানদান আমার তরফে কম নেই তা বলতে পারি।
তবে এসব হৈচৈয়ের ঢের ঢের আগেই আমার শৈশবে আমি পুতুল খেলতাম। খেলতাম বলা চলে, আবার অন্যদের খেলায় আমি সাথিরূপে বলবৎ ছিলাম তাও বলা যায়। পয়লা দফা গুরুতর সংগঠক ছিলেন আমার মাসি, যিনি আসলে আমার থেকে মাস ছয়েকের বড় ছিলেন, এখনও অতটুকুই বড় আছেন। আর দ্বিতীয় দফার সংগঠক ছিলেন আমার ছোটবোন যিনি আমার থেকে সাড়ে তিন বছরের ছোট ছিলেন, এখনও তাই আছেন। আমার ছোটবোন নামেই মাত্র ছোটবোন। ওঁর চালচলন, হাবাগোবা বড় ভাইকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে উদ্ধারপ্রচেষ্টা, দৌড়াদৌড়ি-হুড়াহুড়ি, গুরুতর গোলযোগ বাধিয়ে এক দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারার সামর্থ্য ইত্যাদি বিচারে তিনি আমার বয়োজ্যেষ্ঠ হবার সমূহ সব গুণ ধারণ করতেন। তাঁর অতি শৈশবে একবার আমি সহপাঠীদের 'ইতরামি' (বুলিংয়ের এই বাংলা এই রচনার জন্য গ্রাহ্য হতে পারে) সহ্য করে যখন অশ্রুসজল চোখে বাসায় ফিরেছি, অন্য শিফটের ক্লাস ওয়ানে পড়া আমার ছোটবোন অগ্রজের দুর্দশা দেখে মুহূর্তকাল দেরি না করে একটা লাঠি নিয়ে এসে মায়ের কাছে ঘোষণা করে বসলেন, ওটা ঘোষণাই, কোনো অনুমতি প্রার্থনা ছিল না, তিনি এখন ওই লাঠি নিয়ে স্কুলে যাবেন। এহেন বড়বোনস্বরূপা ছোটবোন পেয়ে শৈশবে আমার ব্যর্থ পুরুষজীবন ধন্য ছিল। আবার এই বিবরণীগুলো থেকেই অতি সহজে আমার পুতুল খেলার সকল কারণই প্রতিভাত হওয়া সম্ভব। এরকম নেতৃস্থানীয়া একজন ব্যক্তিত্ব যা যা করবেন, তার সঙ্গে সেসবে সঙ্গ দেয়া খুবই সাধারণ সামাজিক-পারিবারিক আচরণের মধ্যেই পড়ে। পুতুল খেলা তো অতি অবশ্যই। দ্বিতীয়ত, আমার শক্তিসামর্থ্য আর দুনিয়ার সকল কিছুতে ভীতি-সন্ত্রস্ততা আমাকে যাবতীয় পুরুষ জগতের ক্রীড়াজগৎ থেকে নিষ্ঠুরভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আমি একদিন খেলার মাঠে নেহায়েত দর্শক হিসাবে যাই তো পরের ১৭ দিন আমার আম্মাজানের ঘ্যানঘ্যান করা লাগত যাতে আমি একটু বের হয়ে নিছক বাতাসও গায়ে লাগিয়ে আসি। আমার সমবয়সী সকল পুরুষশিশুর তুলনায় এই পরিস্থিতি বেখাপ্পা রকমের বিপ্রতীপ ছিল।
ফলে আমি যে লাগাতার আমার ছোটবোনের যাবতীয় সখীদের সঙ্গে পুতুলখেলা অব্যাহত রেখেছিলাম, ঘটনা কেবল তাই-ই নয়, বরং সাক্ষীসাবুদদের মতে আমি সেসব পুতুলের দর্জি হিসাবে অচিরেই খ্যাতি অর্জন করেছিলাম। ছোটবোনের সাথিকুল, সেইসব সমতুল্য দজ্জাল (অর্থাৎ কিনা সনাতনী সাহিত্যের পদবাচ্য হিসাবে যাকে ডানপিটে বলা হতো) নারী-শিশুরা আমাকে যারপরনাই কদর করতেন। আমার দর্জিগুণ তাদের পুতুলরাজ্যের পরিকল্পনার অবধারিত অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছিল। উত্তরকালে আমার বোনের পুতুলের জন্য আমি পুরাদস্তুর সোয়েটার বানিয়ে ফেলার ঘটনা প্রকাশ পেয়ে গেলে, দিকে দিকে শিশু ছোটবোনকুলে ক্যারিশম্যাটিক বড়ভাই হিসাবে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আমি আরো কিছু পুতুলের সোয়েটার বানিয়ে দেবার অনুরোধ পাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, লাঠিহাতে সাড়ে তিন বছরের বড় ভাইকে রক্ষাকারী যে ছোটবোনের অস্তিত্ব তা লিঙ্গের যে আচার/পারফরম্যান্সের ইঙ্গিত দেয়, তাঁর নিবিড় পুতুলখেলা তা দেয় না। উপরন্তু, তাঁর হাবাগোবা ভীতসন্ত্রস্ত (তখন তাই ছিলাম) বড়ভাইয়ের পুতুলখেলাতে এরকম নিবিড় অবিচ্ছেদ্য সাথি হয়ে পড়াতে আরো প্যাঁচালো হয়ে পড়ে পরিস্থিতি। এতদ্সংক্রান্ত বিদ্যাকর্মীরা অবশ্যই আরো সব বিদীর্ণকারী ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তবে আমাদের কাজ আপাতত এতেই চলবে।
গৃহ ও নিগ্রহ
নেটফ্লিক্স আর করোনা প্রায় একই সঙ্গে জীবনে এসেছে আমার। ফলে তামাম পৃথিবীর অধিকাংশ মধ্যবিত্তের মতোই আমার চলচ্চিত্রসেবন কিছুকাল প্রায় চলচ্চিত্রভোজন, এমনকি চলচ্চিত্রখাদনের পর্যায়ে গেছিল। নানান খোলাবাজারের মতোই এই পল্গ্যাটফর্মের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে ইংরাজি প্রভাববলয় সমেতও অন্যান্য ভাষার ছায়াছবি থাকে। খুঁজতে হতে পারে, সংখ্যায় সেগুলো কম হতে পারে, কিন্তু আছে। একদম ইন্দোনেশিয়া বা তুরস্কের ছায়াছবি পর্যন্ত। ঠিক যেরকম পাশ্চাত্যের কোনো শপিংমলে গিয়ে একটা নেপালি ধূপ/আগরবাতি বা পেশোয়ারি সালোয়ার পাবেন না- এতটা নিরাশার আপনার প্রয়োজন নেই, তেমনি নেটফ্লিক্সেও খালি হলিউড-বলিউড ভাবার কোনো কারণ নেই। সকল মালামালেরই স্যাম্পল আছে। আমার খাদনকালে স্প্যানীয়ভাষী ছবি আনব্রাইডেলড (মূল :অ্যানিমেলস সিন কোলার) দেখাটা একদমই আকস্মিক। মানে সার্ফাতে সার্ফাতে সামনে পড়া আরকি। প্রথমবার দেখে থ্রিলারখানাকে উপভোগ্যই লেগেছিল। কিন্তু তখনও লক্ষ্য করিনি যে, এটা ইবসেনের ডলস হাউজের একটা রূপান্তর, আসলে চমৎকার একটা রূপান্তর। এমনকি মুখ্যনারীর নামটাও নোরা। প্রথমবার খেয়াল যে করিনি তাতে একটু বোকা বোকা লাগল নিজের। তবে এটাও ঠিক যে, জগৎক্লাসিকের আমি তেমন কোনো পাঠক নই। ডলস হাউজ পরিচিত থাকা খানিকটা দৈবাৎ, অন্য অনেক সাহিত্য সম্বন্ধে আমার নূ্যনতম কোনো ধারণাই নাই। অ্যাডাপশন না হয়ে যদি পুকুরচুরিও হয়, আমি টের পাব না। এই ছবির কোথাও ইবসেনের নামোল্লেখ নেই। এমনকি এখন এই রচনাকালে দেখতে চেষ্টা করলাম আইএমডিবিতে আছে কিনা। নেই। পাশ্চাত্যের কপিরাইট আইন, অবলম্বন, রূপান্তর ইত্যাদি সমূহ প্যাঁচানো এবং তার সাপেক্ষে কোনোকিছু বিচার করতে আমি সাধারণভাবে রাজি থাকি না। এবং এই সূক্ষ্ণরসের অভিনয় আর হৃদয়গ্রাহী ছবিটিতে ইবসেন কীভাবে আছেন তা আবিস্কার করার কারণে বরং আমার আনন্দ বেশি হলো, তাঁর নামোল্লেখ থাকলে যা হতো না। ফলে এসব প্যাঁচানো প্রসঙ্গ। তবে এই অংশটি নিয়ে স্বতন্ত্র একটা চলচ্চিত্র-পর্যালোচনা রচনা করবার আশু কোনো পরিকল্পনা আমার নাই, সেটা জানিয়ে রাখা ভালো। চারপাশে রচনাকারদের মেলারকম 'পরামর্শক' লক্ষ্য করা যায় যাঁরা বলে থাকেন: 'এইডা একটু লম্বা কইরা উপন্যাস বানায়া ফেলতে পারেন', কিংবা 'এইডা নিয়ে একটা সিনেমা ক্যান বানান না?', কিংবা 'আপনি লেখক না? আপনেরে এমুন পল্গট দিব, কুনুদিনও শোনেন নাই'। এসব পরামর্শক গজিয়ে-ওঠার জন্য লেখকেরা সমূহ দায়ী। সেটা নিয়ে কখনো বলা যাবে। আজকে ডিসক্লেইমারের মতো জানিয়ে রাখলাম যে, আনব্রাইডেলড ছায়াছবি বিষয়ে পাঁচটি বাক্য লিখলাম বলে তা নিয়ে পর্যালোচনার আমার আশু সম্ভাবনা নাই; আর সেরকম যদি কখনো সাধ ও সময় ঘটে, তাহলে কোনো পরামর্শেরও দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না।
ইবসেনের দেখানো রাস্তাতেই হালের এই ছবিটির নায়িকা শেষমেশ ঘর ছেড়ে দেন। বা বলা দরকার পতি ছেড়ে দেন। চূড়ান্ত বিচারে পতিময় ঘরের ব্যাকরণ বদলাতে সেই বাস্তুসম্পর্কবিন্যাস ছেড়ে দেন। ইংরাজি নামে যে মরিয়াপনার ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে, সেটার নিজস্ব ধার বা ঝাঁঝ আছে। 'অদম্যা' 'অনমনীয়া' 'অপরাজিতা' যেভাবেই অনুবাদ করে নিন না কেন, বাংলা সাহিত্যধারার প্রবাহেও এইসব পদাবলিই পাবেন নারীর কর্তাসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে। তবে এটাও ঠিক বাংলায় যতটা প্রচারক্লিষ্ট বা ক্লিশে শোনাতে পারে, ততটা ইংরাজিতে নাও শুনিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বাংলায় ক্লিশে যদি শুনিয়ে থাকে, তার কি সহজ কারণ নির্ধারণ সম্ভব? এমন তো আর নয় যে, বাংলা সাহিত্যধারায় নারীস্বর প্রতিষ্ঠিত কিংবা ব্যাটাময়তা অপসৃত। কিংবা আরো সূক্ষ্ণভাবে বললে, এমন নয় যে, লিঙ্গীয় বৈষম্যের পাটাতনকে বাংলা সাহিত্য গুরুতরভাবে মীমাংসা করে ফেলেছে বলে এসব পদাবলি অধিকতর ক্লিষ্ট শোনায়। বরং, প্রস্তাব করি, এত নিবিড় প্যাট্রিয়ার্কি এখানকার সাহিত্যে, এবং সাহিত্যকারদের মধ্যে, যে এই শব্দগুলো পর্যন্ত পর্যাপ্ত কাব্যধর্মিতাসমেত রোম্যান্টিক হয়ে উঠে বসেছে, রাজনৈতিক হয়ে বসে পড়েনি ভাষায়। ফলে বাংলায় অপরাজিতা নোরা গৃহ থেকে না (ফিরে) গিয়ে ইংরেজিতে আনব্রাইডেলড নোরা আবেল ও তাঁর কথিত যুগলগৃহ থেকে রওনা দিলে এই পরিস্থিতিতে অধিক লিঙ্গীয় রাজনৈতিক শোনাচ্ছে। তিনি পরিত্যাগ করলেন গৃহ, ইবসেনেরও সেটাই ফয়সালা ছিল, সেই গৃহ যা কাগজে-কলমে যুগলের গৃহ, এমনকি এনলাইটেনমেন্ট-উত্তর খ্রিষ্টপ্রভু যে গৃহকে সমতাধর্মী বানানোর চেষ্টা করেছেন, স্বর্গলোক থেকে অবশ্যই। গৃহের মধ্যকার অসমতা ও ম্যানিপুলেশন নিয়ে বিস্তর আলাপ চলতে পারে। কখনো কখনো প্রচলিত ভোঁতাধার স্কিমেটিক নারীবাদ দিয়ে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে, তবে সেটা আজকের প্রতিপাদ্য নয়। তার থেকেও বড় কথা, দাম্পত্যমূলক ও একমুখী যৌনতার ধারণায়নপুষ্ট গৃহের ব্যাকরণ নিয়ে দু-দশটা আলাপ না করে গৃহকে সিদ্ধ ধরে এর মধ্যকার 'রোল' নিয়ে আলাপ অহেতু হতে বাধ্য। আমার বলনীয় বিষয় হলো, এখানে, ইবসেন নারীটির সংকল্প বা সম্মানবোধে ভর করে তাঁর নাটকের নাম দেননি। তিনি গৃহের ব্যাকরণে মনোযোগ দিয়েছিলেন।
'পুতুলের ঘর' এবং গৃহ 'ভাঙার' পরও নামটি তাসের ঘর নয়। ইবসেনের পুতুল প্রতিপালকের অস্তিত্বের শর্তসাপেক্ষ। পুতুলখেলার মায়ামাধুর্য থেকে ইবসেন তাঁর রসগ্রাহীদের সরান এবং খেলার পুতুলের নিষ্ফ্ক্রিয়তা ও ম্যানিপুলেশনকে বুঝতে জোর দেন। এত বছর পরও তিনি সমান অর্থবহ আছেন এই ম্যানিপুলেশনকে চিত্রিত করার কারণেই। নারীবাদী লড়াইগুলো, এর বহুবিধ স্বার্থময়তা আর বিচিত্র চিন্তাপাটাতনসমেতই, পুরুষালি ম্যানিপুলেশনকে, সূক্ষ্ণ সকল চালিয়াতিকে লাগাতার উন্মোচন ঘটাতে চেয়েছে বলে ইবসেন প্রাসঙ্গিক থেকেই গেছেন। অমল পালেকার তাঁর ২০০৫-এর ছবিতে পুতুলকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আবহ দিয়ে সামনে আনেন। পিছনে আনেন বললেও চলে। সিনেমাটির মূল কাহিনি বলতে সূত্রধর হিসাবে আসেন অন্তত দুই পুতুল। আর সিনেমা সমাপনীকালে একদল পুতুল আসেন, যতদূর মনে পড়ে জৈবশরীরের অভিনেতারা এবার পুতুলের দেহভঙ্গি নিয়ে আসেন। পালেকারের পুতুলপ্রয়োগ তাই গুণগতভাবে পল্টানধর্মী (সাবভারসিভ) আর বিপ্রতীপ (এডভারসিভ); আর ইবসেনের পুতুলপ্রয়োগের থেকে আমূল ভিন্ন।
খেলার বহুমাত্রিকতা
খেলা অত্যন্ত ব্যাপক ধরনের শব্দ বাংলা ভাষায়, এবং সেগুলো পুরাপুরি পরস্পরবিরোধী হতে সমর্থ। অন্যভাবে বললে, সকল শব্দেরই সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ অর্থ তৈরির সম্ভাবনা এর পেটের মধ্যেই নিহিত থাকে। সেটা আরেকটা সম্পূর্ণ ভিন্ন আলাপ; আর ভাষাবিদরা করলেই সবচেয়ে ভালো হয়। তবে কথা যেহেতু আমিই তুলেছি, তাই একটা দুইটা বিস্তার হিসাবে বলা চলে কোনো শব্দেরই আভিধানিক অর্থ বলে আসলে কিছু নেই। খোদ অভিধানেই, যদি আন্তরিক অভিধানপ্রণেতা তা বানিয়ে থাকেন, রাজ্যের গাদা গাদা অর্থ সন্নিবেশন করে থাকেন শব্দের বিপরীতে। তারপরও প্রয়োগগুণের অর্থ, পরিপ্রেক্ষিতের অর্থ, অর্থোদ্ঘাটনের পাত্রপাত্রীদের মনোজগতের অর্থ- এগুলো যথেচ্ছ অভিধান ফুঁড়ে বের হয়ে যেতে পারে। এটুকুই আপাতত বলবার ছিল। খেলা পদটির যে বহুমাত্রিক অর্থ তা বুঝবার জন্য নজরুলের 'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে' গানখানি সাহায্য করতে পারে, রবীন্দ্রনাথের 'খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি' সাহায্য করতে পারে, 'খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে'। যদি আমার কথার মানে দাঁড়ায় যে, এটা বাংলারই মাহাত্ম্য, তাহলে তা আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সাথে সাথেই মনে করিয়ে দেব যে ইংরাজি 'পেল্গ'ও এমন কিছু সহজ সরল নয়; এমনকি সফটওয়্যার গেমস আসারও বহু আগে থেকে 'গেম'ও সরল নয়। সারল্যের আরাধনা যাঁদের পোষায় পোষাক, ভাষা তার থেকে বহুগুণ জটিল বটে।
আনন্দময়তা থেকে পরাধীনতা, তাচ্ছিল্য থেকে লাস্যময়তা, নৈপুণ্য থেকে আত্মমগ্নতা এত এত অর্থ যে 'খেলা' তার পেটের মধ্যে ভরে রাখে তা ক্ষেত্রবিশেষে বিস্মৃত হতে পারি আমরা। এমনকি আমিও হতে পারি, যদি নেহায়েৎ অতিশয় অন্যমনস্ক থাকি। তবে বাস্তবে শব্দরাজ্যের এই মায়াবী ঘোরালো-প্যাঁচালো বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আমি বিস্মৃত থাকতে পছন্দ করি না, এমনকি একটা মুহূর্তও। এমনকি 'খেলার পুতুল' আর 'পুতুলখেলা' যৌগশব্দগুলো উচ্চারিত হবার সময়েই 'খেলার' অর্থ যে যথাক্রমে পুতুলের উপর কর্তৃত্বধারী আর পুতুলের অধীনস্থ সেটাও মনে পড়ে যায়। তার জন্য আলাদা করে গালে হাত দিয়ে ভাবতেও বসতে হয় না আমার। এই আমিটাকে যে জোর দিয়ে দিয়ে গাঢ় করে সামনে আনলাম, তা নিছকই 'আমিটা'র স্বার্থে নয়, খোদ খেলারই স্বার্থে। খেলতে-খেলতে অর্থের দুনিয়ার নানান পর্দা সরিয়ে ফেলা যায়, নানান পর্দা বা বর্ণাভাস (শেড) দিয়ে নতুন করে আস্তর দেয়া যায়, সেই সম্ভাবনাটা নেহায়েৎ কয়েকটা বাক্য লিখতে-লিখতে, বলতে-বলতে হাজির করার ক্রীড়াময়তা বা খেলাশীলতা উপভোগ করতে চেয়েছি মাত্র। খেলাই!
সক্রিয়তা/এজেন্সির কারিগরি
পুতুলখেলাতে পুতুল থাকেন সক্রিয়তার জাগরূক প্রতিনিধি হিসাবে, আপনার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। এখন চাইলে আপনি এই পরিস্থিতিকে রাবীন্দ্রিকভাবে বলতেই পারবেন আপনারই 'চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনী হলো লাল'। বহু পুরাতন, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, তবু এটা বলা চলবে। এই বলার মাধ্যমে পুতুলেরা তাঁদের অজৈব জীবনে গাঢ়ভাব পেলেন, কিন্তু তার বিনিময়ে আপনি পুতুলমালিক, এই মুহূর্তে পুতুল-খেলুড়ে, গৌণভাব পেলেন না; হারালেন না আপনার জৈবজীবনের অর্জিত গাঢ়ভাব, যদি তাই হয়। এই যে পুতুল আর আপনি একত্রেই গাঢ়ভাব পেলেন, সিরিয়াসনেস অর্জিত হলো আপনাদের স্বীয় স্বীয় অস্তিত্বদশাতে, এখানেই খেলার মাহাত্ম্য। আপনার সক্রিয়তাই পুতুলের সক্রিয়তা, আপনার প্রসাদেই পুতুল রঞ্জিত। আপনার এই প্রসাদ যতটা আত্মপ্রসাদ, ততটাই পুতুলপ্রাসাদ। পুতুলেরা তখন ওই ছোট বাক্সগুলোতে একেকজন রাজকীয় হয়ে ওঠেন, কিংবা গৃহস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা লিঙ্গভেদে রাজকন্যা কিংবা রাজপুত্রের মর্যাদালাভ করেন। কিংবা গৃহস্থের স্নেহধন্য নিছক পুত্র বা কন্যা হন। তাঁরা সেই বাক্সগুলোতে ঘুমান, জাগেন, আবার হাসিমুখে ঘুমান। তাঁরা আপনার যত্নে বানানো পোশাকগুলো পরিধান করেন, কিংবা হয়তো শীতের দিনে সোয়েটারও। তারপর আপনারই মেন্যুতে রান্নাবান্না করেন। কিংবা তাঁদের জন্য, তাঁদের হয়ে আপনি রেঁধে দেন। তখন আপনার হুকুমত চলছে নাকি পুতুলের হুকুমত সেটা অত সহজে আপনার পুথিপড়া থিউরি দিয়ে নিষ্পত্তি নাও হতে পারে। আপনি পুতুলের এই দৈনন্দিন রাজকীয় কিংবা গার্হস্থ্য জীবনযাপনের লিপিকার; আবার একাধারে পুতুলরাজ্যের বিধান অনুযায়ী আপনি এদের হুকুমপালনকারী শুধু। এইসব পুতুলেরা লিপির সমাপ্তিপর্বে আবার তাঁদের প্রাসাদে ফিরে গেলেই কেবল আপনি ছুটি পাবেন। এক-আধদিন বাবার কান ডলাতে কিংবা অন্য কোনো উত্তেজনাতে মাঝপথে পুতুলরাজ্যের নিয়ম ভেঙে আপনি যে দৌড় লাগাবেন না তা নয়। কিন্তু মোটের উপর এই বিধানের লঙ্ঘন অসম্ভব। পুতুলেরা তাই, আপনার সাপেক্ষে হলেও, জাগরূক সক্রিয়।
একদিকে এটা আপনার স্ট্ক্রিপ্টের গুণ, আপনার চিত্রলিপিমালা, আপনার কল্পনা। ছবি-আঁকিয়ে শিশুরা, তা তাঁরা যেমন চিত্রকরই হোন, সাধারণত তাঁদের প্রত্যেকটা রেখা বা বিন্দুর পাশাপাশি বিশদ সব কাহিনি বলতে থাকেন। তাঁদের কাহিনির বাইরে ওই রেখা কিংবা বিন্দুগুলোর কোনো অর্থ নির্ণয় অসম্ভব। বড়রা এই কাজগুলো করেন সাধারণত গ্রাফ ও পরিসংখ্যান দিয়ে; তবে সেটাও আরেকদিনের আলাপ। তো, শিশুদের ওই বিবরণীর মালিক যে শিশু তাঁর নিজের এজেন্সি ছাড়া তাঁর চিত্রকর্মের পাত্রপাত্রীদের এজেন্সি বোঝার চেষ্টা উদ্ভট কাজ, আপনি যেসব তত্ত্বই পড়ে আসেন না কেন। ঠিক সমরূপভাবে, পুতুলখেলার খেলোয়াড়দের এজেন্সিকে কেন্দ্রে রেখে পুতুলের এজেন্সি বুঝতে হবে। আমার প্রস্তাবই কেবল নয়, আমার দাবি রীতিমতো। এই নৈমিত্তিকতাকে নিম্নরেখা দিয়ে পাঠ করা দরকার। আপনি পুতুলপ্রাসাদটাকে টেনে বের করেন, আপনার বিবরণী সত্তা জাগ্রত হয়। আপনি মুখে সেই বাণী উচ্চারণ করতে থাকুন বা না-থাকুন আপনারই চিত্রলিপিতে পুতুলেরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আর পুতুলরাজ্যের বিধান প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে, পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেতে থাকে।
তারপর কোনো একদিন নানান কারণে, আচমকা কিংবা ধীরে ধীরে; চটজলদি সিদ্ধান্ত মোতাবেক কিংবা নিছকই খেলায়-খেলায়, খেল খেল মে, একদিন, কোনোদিন, কোনো এক এখন ভুলে-যাওয়া দিনে, সেসব পুতুলগুলো আপনার প্রসাদবঞ্চিত হতে শুরু করেন। তাঁরা তখন তাঁদের প্রাসাদে ঘুমাতে ঘুমাতে মমি হয়ে পড়েন। প্রাসাদগুলো আবার কাঠের বা টিনের বাক্সে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। এরপর কোনো একদিন যখন সেগুলোকে টেনে বের করেন আপনি, বা আপনার আশপাশের কেউ, তখন তিনি আর এসব পুতুলের অজৈব সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকেন না। সেসব অপসৃত হলেই বরং বাক্সগুলো টেনে বের করা হয়। আর পুতুলেরা তখন খেলার পুতুলে পরিণত হয়। তখন সেগুলোকে পরিত্যাগ করা যায়। আরো নিশ্চিত করে বললে, পরিত্যক্ত হয়েই তাঁরা থাকছিলেন ওসব বাক্সগুলোতে, যা কিছুকাল আগেই প্রাসাদ ছিল।
অজৈব (পরিত্যক্ত) পুতুলেরা আপনাকে পরিত্যাগ করে চলে যেতে পারেন না, নোরার মতো! ফেলে দিন!
- বিষয় :
- প্রচ্ছদ
- মানস চৌধুরী