মানুষগুলো মুখোশ পরা ছিল

সনোজ কুণ্ডু
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২১ | ১২:০০
পৌষের বাতাস বিশুর রোমকূপে তীব্র কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তবুও সংঘবদ্ধ কুয়াশা ঠেলে চলে আসে খেজুরতলা জমিতে। জোড়া-বলদের কাঁধে লাঙল বেঁধে নেমে পড়ে জমি চাষে। যত তীব্র শীতই হোক না কেন জমি চাষের সময় বিশু শরীরে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া কিছুই রাখে না। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যাস। গরম কাপড় তার সর্বাঙ্গ যেন চেপে ধরে। কাজের গতি মন্থর করে। সেই কবে থেকে বৃষ্টির দেখা নেই, মাটির বুক যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। লাঙলের ফলা খটখটিয়ে উপরে উঠে আসে। ধার ক্ষয় হয়। বিশু কবজিতে জোর খাটিয়ে গুটি চেপে ধরে। 'আরে যা যা, হুট হুট-' বিশুর বেরসিক কণ্ঠ শুনে গরুর ঘুমের আড়মোড় ভাঙে। পিঠে লাঠির আঘাত পড়ার আগে গতি বাড়িয়ে দেয়। বিশু খুশিতে গদগদ হয়ে খেজুরের ডাল দিয়ে গরুর পিঠ চুলকিয়ে আরাম দেয়।
জমির মাঝামাঝি সীমানা নির্ধারণের দীর্ঘ আইল। বেশ উঁচু মাটির স্তূপ। এতটাই উঁচু যে, হালচাষের সময় প্রান্ত বদল হবার সুযোগ নেই। তবে বলদের গলায় চুলকানি উঠলে এই উঁচু আইলে গলা ঘষে সুখ পায়। এই আইলের অন্য প্রান্তে ট্রাক্টর চালিয়ে জমি চাষে ব্যস্ত মুন্তার। বিশু আইলের কাছাকাছি এলে ট্রাক্টরের শব্দটা ইচ্ছে করে বাড়িয়ে দেয়। গরু যাতে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। জমি চাষে বিরত থাকে। মুন্তার বিশুকে সহ্য করতে পারে না। শালা একটা স্বার্থপর। অকৃতজ্ঞ। এটুকু ভাবে না, আজ যে জমি চাষ করে তার সংসার চলছে, এই পাঁচ বিঘা জমি বিশুর বাবা আশুতোষ বালা মুন্তারের বাপকে উপহার দিয়েছিল। বাবুল শেখ ছিল তার প্রাণের বন্ধু। গলায় গলায় পিরিত। একসঙ্গেই কেটেছে শৈশব- কৈশোর। এক থালায় বসে ভাত না খেলে তাদের পেটের ভাত হজম হতো না। দুর্গা পূজা কিংবা ঈদ এলে আনন্দের সীমা ছিল না। বিজয় দশমীর দিনে জলিরপাড় মেলায় নৌকাবাইচ দেখতে যেত। এ অঞ্চলে যাত্রাপালা, সার্কাস, পুতুলনাচ হলে দুই বন্ধু ছিল সামনের সারির দর্শক। মুন্তার আইলের কাছে এসে গলা ফাটায়-
'হেই মালাউনের বাচ্চা, তোর গতরে শীত লাগে না?'
বিশু রসিকতার সুরে কথা বদল করে।
'নারে মুন্তার, মালাউনগো গতর গুইসাপের চামড়া দিয়ে মোড়ানো থাকে। তাগো গাইল দিয়া চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করলিও কানে শোনে না। লাঠি দিয়ে পিটাইলিও ব্যথা পায় না; যতক্ষণ পর্যন্ত ধারালো বস্তু দিয়ে শরীরে জখম করা না হয়।'
বিশুর কথা বোঝার সাধ্য মুন্তারের নেই। এই গাঁয়ের সব ভূমি-মালিক বেশিরভাগ জমি বিশুর কাছে বর্গা দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। বিশু বতর অনুযায়ী ফসল ফলায়। তবে পরিশ্রম অনুযায়ী প্রাপ্তির খাতা অনেকটা শূন্যই থাকে। তার বাপ-দাদার আমল থেকেই এই অঞ্চলের কৃষকরা ভূমি মালিকদের কাছে জিম্মি। সংসারের অভাব বাড়ছে। মাথার ওপর ঋণের ওজন বেড়েই চলেছে।
মাঠে বইছে হিম বাতাসের অদৃশ্য স্রোত। তিরতির করে নড়ছে খেজুরগাছের পাতাগুলো। ভরদুপুরেও কুয়াশা চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। 'ও বাবা, খাইয়া যাও।' মেয়ের কণ্ঠ বিশুর কানে এসে ধাক্কা দেয়। আরতি খেজুরতলায় দাঁড়িয়ে পাথারে দৃষ্টি মেলে ধরে। চারদিক কেবল শূন্যতা। তার জীবনের মতো। চিনচিন বাতাসেও যেন দীর্ঘশ্বাসের মহড়া চলছে। আরতির গোলাপি রঙের শাড়ির আঁচলটা তার শরীর থেকে ঘুড়ির মতো উড়তে চাইছে। বিশু মাজার গামছা খুলে মুখ মুছতে মুছতে আরতির মুখোমুখি হয়। কিছুদিন ধরেই তাদের মান-অভিমান চরমে। বিশু মেয়েকে বলে, 'তোর মায় কিছু মুখে দেয় নাইরে তুলি?'
'সেই বিয়ানে খেজুরের রস দিয়া মুড়ি খাইছে।' তুলি কটকটা গলায় বলে।
তুলি খেজুরতলায় পড়ে থাকা একটা ছেঁড়া ঘুড়ি ওড়াতে বৃথা চেষ্টা করে। ওর কতদিনের ইচ্ছা একটা লাল ঘুড়ি আকাশে ওড়াবে। ঘুড়ির সঙ্গে তার মনটাও ভাসিয়ে দেবে চাঁদের দেশে।
মুন্তারকে দেখে আরতির অসহ্য লাগে। মাথায় ঘোমটা বাড়িয়ে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু মুন্তারের যে শকুনের দৃষ্টি। এড়িয়ে যাওয়া অতটা সহজ ছিল না। তা অবশ্য আরতির থেকে ভালো কেই-বা জানে! ট্রাক্টর বন্ধ করে সে আরতির গা ঘেঁষে দাঁড়ায়-
'ও বৌদি, আমাগো প্যাটে খিদা লাগে না?' বলতে বলতে নির্লজ্জের মতো ফেনাভাতের থালে হাত ডুবিয়ে দেয়। সুন্দরী বৌদির হাতের ফেনাভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। মনের জিহ্বা দিয়েও বৌদির হলুদ অঙ্গের লকলকে শরীর চেটে খায়।
'ও বৌদি, তুমি বিশুরে কী এমন কছম দিলা কওদি? মানুষটা জন্মের লাহান তাস খেলা ছাইড়া দিলো। দোহাই তুমার, কছম উঠাইয়া নাও বৌদি। কেবল আরেকটা দিন বিশুরে বাজিতে আমার কাছে হাইরা যাবার দাও! আমার জীবনটা আবার ধন্য হবি।'
আরতির চোখে লাল দৃষ্টির ধার। হৃদয়টা খচখচিয়ে ওঠে। বিশুর ইচ্ছে হয় লাঙলের তীক্ষষ্ট ফলা বদমাশটার বুকে বসিয়ে দিতে। আরতি কালবিলম্ব না করে বাড়ি চলে যায়।
হঠাৎ বিশুর দৃষ্টি পড়ে লাঙলের ফলার দিকে। মাটির প্রকাণ্ড চাকার সাথে উঠে আসে একটি মাথার খুলি। খুলির কিছুটা পাশেই ছিল একটি জং-ধরা কলম। দুটো জিনিস পাশাপাশি থাকায় তার মনটা দড়াম করে ওঠে। একটা অপ্রত্যাশিত ঝড় তাকে যেন তছনছ করে দিতে চাইছে।
বিশু এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাটিমাখা মুণ্ডুটা গামছায় মুড়িয়ে রাখে। কেউ দেখলেই সর্বনাশ। কত ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে। এই গামছার পুঁটলি মুন্তারের চোখে পড়লে নিশ্চিত শালা খুলে দেখতে চাইবে হীরা-মাণিক্য আছে কিনা। বহু বছর আগে এ অঞ্চলে পুকুর খনন কিংবা জমি চাষের সময় কৃষকের লাঙলের ফলায় সোনাভর্তি পিতলের ঘটি পাওয়ার নজির আছে। কিন্তু বিশুর কি আর সেই ভাগ্য! সে বুদ্ধি খাটিয়ে আইলের ঘাস কেটে গামছা ভর্তি করে। ঘাসের নিচে ডুবিয়ে রাখে মুণ্ডুটা। কলমটা রাখে ফাঁকা মুণ্ডুর ভেতর। সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গলে ঘাপটি মেরে থাকে। এবার মুণ্ডুটা ভালো করে ওলটপালট করে দেখে। মুণ্ডুর পেছনে একটা সরু ছিদ্র। হয়তো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মুণ্ডুটা তার বাবার নয় তো! এ মুহূর্তে বাবার মুখখানা চোখের পর্দায় দোল খায়। বুকের ভেতর কী এক আর্তনাদ খচখচিয়ে ওঠে। শহরের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা একদিন গভীর রাতে তার বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। আর সে ফিরে আসেনি। লাশটাও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিশুর বাবা আশুতোষ বালা ছিল কৃষক আন্দোলনের তুখোড় নেতা। কৃষকদের প্রাণের মানুষ। সারাক্ষণ পরনে থাকত সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। বাড়ির উঠোনে গলা ছেড়ে শ্যামা সংগীত গাইত। মুন্তারের বাপের সাথে যাত্রাপালায় নায়কের অভিনয় করত। তার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে কথা বলার কেউ ছিল না। বন্ধুরা তাকে ডাকত নেতাজি সুভাষ বলে।
ছোটবেলা থেকেই শরীরের গড়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। শরীরে ছিল সিংহের শক্তি। দু'তিনজনও কুস্তি লড়ে হারাতে পারেনি। হাডুডু খেলায় ছিল ভীষণ পটু। বিপক্ষ দলের তিন-চারজন খেলোয়াড়কে টেনে-হিঁচড়ে নিজের সীমানায় নিয়ে আসত।
পণ্ডিত মশাই একদিন আশুতোষের রেজাল্টের সংবাদ নিয়ে আসেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আশু ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। সেই সুসংবাদটা ঝড়ের গতিতে গ্রামবাসীর কানে পৌঁছে যায়। তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে, ফুলের মালা নিয়ে তাদের গর্বিত রাজপুত্তুরকে বরণ করে নেয়। এমন বিদ্বান যে গাঁয়ে দ্বিতীয়জন নেই।
মায়ের পরামর্শে আশুতোষ একদিন মামা সুধীরের সাথে কলকাতা চলে আসে। ভালো চাকরি পেলে সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাবারও চিন্তা করে। সুধীর কলকাতায় ট্যাক্সি চালায়। উল্টোডাঙ্গা দেশবন্ধু পার্কের পেছনে বাড়িও করেছে। আশুর মামি শিখা বাড়িতে সেলাই শেখার স্কুল খুলেছে। বলা যায় সুখেই আছে। অশান্তি একটাই- বিয়ের পাঁচ বছর পার হলেও সন্তানের মুখ দেখা হয়নি। আশুতোষ একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি পায়। বছর দুয়েক সেখানে কাজ করে। বেশ কিছু টাকাও জমায়। এক দালালের কাছে মায়ের জন্যও টাকা পাঠাতে থাকে। মামির কাছে সেলাই শিখতে আসা সবিতার সাথে তার ভালোবাসা হয়। মামার মতেই একদিন দুজনে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। উল্টোডাঙ্গা রোডেই আলাদা একটি বাসা ভাড়া নেয়। দেড় বছরের মাথায় ওদের ঘর আলোকিত করে আসে একটি পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় বিশু।
পশ্চিম বাংলার রাজনীতি তখন টালমাটাল। সাল্ফ্রাজ্যবাদী আন্দোলন বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্যে চাপা উত্তেজনায় ঠাসা। গ্রামের দিকে বেশি অশান্তি চলছে। ভূমি মালিকদের সাথে কৃষকদের মুখোমুখি সংঘর্ষ লেগেই আছে। পুলিশও ভূমি মালিকের পক্ষ নেয়। নিরীহ কৃষকদের ওপর চালায় সীমাহীন নির্যাতন। পদ্মার উত্তালের মতো কৃষককুলও ফুঁসে ওঠে। দীর্ঘকাল ধরে ওদের বুকে জ্বলছে পরাজয়ের আগুন। এখন সময় এসেছে প্রতিশোধ নেবার। শিলিগুড়ি শহরের খুব কাছে নকশালবাড়ি গ্রামে পুলিশ হিংস্র হয়ে ওঠে। নির্বিচারে গুলি চালায় নিরস্ত্র কৃষকদের বুকে। মুহূর্তেই নকশালবাড়ির মাটি রক্তে প্লাবিত হয়ে যায়। কৃষক গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলে। চারদিকে খুনোখুনি, লুটতরাজ, বোমাবাজি চলতে থাকে। আশুতোষ খবর শুনে মামাকে না জানিয়ে সেদিন নকশালবাড়ি আসে। বিক্ষোভে তার বুকে যেন অগ্নিগিরি জ্বলতে থাকে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সে মেনে নিতে পারে না। নকশালদের অসংখ্য বীরত্বের কাহিনি তাকে সাহসী করে তোলে। কিছুদিনের ব্যবধানে মাওবাদী বিদ্রোহ শুরু হলে গোটা বাংলায় ভয়াল পরিস্থিতি দেখা দেয়। আশুতোষের মাথাটা রাজনৈতিক চক্ররথে ঘুরপাক খায়। সে বুঝে উঠতে পারে না, নকশাল বিদ্রোহের সঙ্গে মাওবাদীদের সম্পর্ক কী?
আশুতোষ ভাবে, তার দেশের ভূমি মালিক, জোতদারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষকদের প্রতিবাদী করতে হবে। ওই রাঘববোয়ালদের উচিত শিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত কৃষককুলের মুক্তি নেই।
আশু একদিন শিলিগুড়ির কৃষকসভায় হাজির হয়। তখন মঞ্চে ছিলেন নকশাল বাহিনীর তুখোড় নেতা জঙ্গল সাঁওতাল, চারু মজুমদারসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। আশু নিজের আবেগকে চাপা রাখতে না পেরে সাহস করে মঞ্চে ওঠে। চারু মজুমদারের পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানায়। একটি চিরকুটে কৃষককুলের মুক্তির তিনটি পরামর্শ লিখে দেয়। চারু মজুমদার আশুকে বুকে টেনে বাহবা দেয়। মাইকে আশুর হাত উঁচু করে পরিচয় করিয়ে দেয়-'আশুতোষ বালা। নকশাল বাহিনীর আগামী দিনের নেতা।' আরও কত কী প্রশংসা।
সেদিন সকালে উল্টোডাঙ্গা রোডে নকশালপন্থি একটি ঝটিকা মিছিল নেমেছিল চারু মজুমদারের মুক্তির দাবিতে। আশুতোষ ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। সে খবরের কাগজ পড়ে দেখে চারু মজুমদার দমদম জেলে বন্দি। মুহূর্তেই সে দমদম যাবার বাসে উঠে বসে। কারাগারের সামনে চারু মজুমদারের মুক্তির দাবিতে একাই বিক্ষোভ দেখায়। অনশনের হুমকি দেয়। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক আশুতোষের সাক্ষাৎকার নিতে আসে। সেই মুহূর্তে পুলিশ আশুকে ধরে নিয়ে যায়। সপ্তাহখানেক জেলের ঘানিও টানতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জানতে পারে, তার চাকরিটা আর নেই। চরম অপমানে একদিন সে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে দেশে ফিরে আসে।
আশুতোষের দেশে ফিরে আসার খবর মুহূর্তেই গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রিয় মানুষটাকে দেখতে সবাই ছুটে আসে। সবার মনে সে কী আনন্দ! তাদের ঘরের ছেলে ফিরে এসেছে। মুহূর্তেই একটা দুঃসংবাদ আশুকে শোকাহত করে। সে মাথায় হাত দিয়ে সটাং করে কাচারিঘরের মাটিতে বসে পড়ে। কৃষকপাড়ার নিখিলদা আর নেই। তাকে খুন করা হয়েছে। সেই খুনটা করেছে তারই প্রাণের বন্ধু বাবুল শেখ। আশু দেশে না থাকার কারণে কিছু ভূমি মালিক বাবুলকে দলে ভেড়ায়। মাত্র পাঁচ হাজার টাকার লোভে নিখিলের পিঠে কাস্তে দিয়ে কোপাতে যায়। ফাঁকা জমিতে দুজনার ভেতর ধস্তাধস্তি চলে। একপর্যায়ে কাস্তের কোপ নিখিলের মাথায় গিয়ে লাগে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। বাবুল শেখ এখন জেলে। দিনরাত পাগলের মতো কাঁদে। তার একটাই কথা নিখিলকে সে খুন করতে চায়নি। পিঠে আঘাত করার কথা ছিল। হারু কাজির মুখে কথাগুলো শুনে আশুতোষ বোবার মতো বসে থাকে। শোকে পাথর যেন। ধিক্কার দেয় বন্ধুকে। এমন একটা নরপশু তার বন্ধু!
আশুতোষ রাজনীতির পাশাপাশি নিজের বাড়িতে পাঠশালা খুলে বসে। সংগ্রামী জীবনের সাথে যুক্ত হয় নতুন পদবি 'আশু মাস্টার'। সকাল থেকেই তাদের উঠোনে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়সী মানুষের ভিড় লেগে থাকত। নিজের পয়সা খরচ করে আশু মাস্টার ছাত্রদের কিনে দিতেন স্লেট, চক আর আদর্শলিপি বই। সারাদিন ছাত্রদের মুখে গুনগুন করে শোনা যেত স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের মধুর স্বর।
নলদিঘির মানুষ তখন নকশাল আন্দোলনের কিছুই জানে না। এতদিনে আশুতোষের জ্ঞান-বুদ্ধি-নেতৃত্ব আরও বেশি শানিত হয়েছে। সে যে গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে। শোবার ঘরে চারু মজুমদারের বিশাল এক ছবি টাঙিয়ে রাখে।
নলদিঘিতেও তখন ভূমি মালিকদের নির্যাতন চরমে। শোষিত কৃষক শ্রেণি তখন বড় অসহায়। কোণঠাসা। ভূমি মালিকরা দিনের পর দিন কৃষকদের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে। তাদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে বতর অনুযায়ী ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে। বছর ঘুরে সেই সুদের টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যায়। কৃষকের ঋণ শোধ হয় না। মালিকের পা ধরে কান্নাকাটি করে। তারা কৌশলে কৃষকদের সুদের টাকা না নিয়ে তাদের অংশের ফসল কেড়ে নেয়।
ভূমিহীন কৃষকদের ওপর এমন অত্যাচার আশুতোষ সহ্য করতে পারে না। সে কালসাপদের বিষদাঁত ভাঙার প্রতিজ্ঞা করে। তা না হলে নলদিঘির কৃষকদের বাঁচানো যাবে না।
আশুতোষ একদিন গভীর রাতে কৃষকদের নিয়ে আলোচনায় বসে। ভূমি মালিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে বলে। ফসলের অর্ধেক পাবার দাবিতে সবাই সোচ্চার হয়। প্রতিটি কৃষকের ঘরে দেশি অস্ত্র রাখার পরামর্শ দেয়। প্রয়োজনে তারা নলদিঘিকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেবে।
একদিন শীতের কুয়াশাভেজা রাতে শহর থেকে কমিউনিস্ট পার্টির দু'জন বর্ষীয়ান নেতা আশুতোষের বাড়ি আসে। হাতে দেয় এক হাজার টাকা। তিন ডজন লাল গেঞ্জি। গেঞ্জির পেছনে লেখা- দুনিয়ার মজদুর এক হও। কাস্তে প্রতীক চিহ্নিত একটি রক্তবর্ণ পতাকা হাতে দিয়ে বলে, যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকে এই পতাকাকে সম্মান করে যেও। জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে। একদিন তোমাদেরও পতাকা হবে। আশুতোষ সাহস করে বলেছিল, নকশাল আন্দোলনের সাথে আপনাদের রাজনীতির কী সম্পর্ক?
সিনিয়র নেতাটি বলেছিল, 'সব নদীই কিন্তু সাগরের মোহনায় মিলে যেতে চায় আশুতোষ।'
তারা দেরি না করে চারু মজুমদারের ছবিতে স্যালুট জানিয়ে চলে যায়।
ভূমি মালিক, জোতদার শ্রেণি মিলে শহর থেকে ভাড়াটে গুন্ডা এনে নলদিঘির কৃষকের ওপর লেলিয়ে দেয়। এরই মাঝে দুজন কৃষক খুন হলে নলদিঘি যেন বিদ্রোহের দাবানলে রূপ নেয়। দলে দলে পুলিশ আসে। মালিকদের পক্ষে গুণকীর্তন করে। মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ভরে চলে যায়। কেউ সাক্ষ্য দেবার সাহস করে না। আশুতোষ জানে, আকবর ভাই, নিখিলদাকে কারা খুন করেছে। সে নিজে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেবার প্রস্তুতি নেয়।
শ্রাবণের সেই রাতটি ছিল সত্যিই ভয়ংকর। গোয়েন্দাবাহিনীর পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকধারী তিনজন লোক আশুতোষের বাড়ি আসে। গোপন কথা আছে বলে তারা আশুকে খেজুরতলা মাঠে নিয়ে যায়। মমতা উদ্বিগ্ন মনে ছেলের পথের দিকে চেয়ে থাকে। একপর্যায়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। সবিতাও বিশুকে নিয়ে পড়শিদের ডেকে ওঠায়। প্রতিবেশীরা আশুতোষকে খুঁজতে নামে। দক্ষিণ পাড়ার কৃষকরাও তাদের নেতাকে সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। কিন্তু আশুতোষের হদিস মেলে না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গত হয়ে গেলেও আশুতোষ আর ফিরে আসে না। সবার ধারণা তাকে খুন করা হয়েছে। ছেলে হারানোর শোকে কিছুদিন পরই মমতার মৃত্যু হয়।
২.
তেলশূন্যতায় কুপির সলতেটা তিরতির করে কাঁপছে। স্বরবর্ণের অক্ষরগুলো তুলির চোখে বড়ই ধূসর। মাথা নিচু করে ট্যা ট্যা চোখে বইয়ের অক্ষর খোঁজে। একসময় কুপিটা ধপ করে নিভে যায়। 'ও মা, ঘরতো আন্ধার হইয়া গ্যালো!'
আরতির চোখে লাফিয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ। এ সংসারে এসে তার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। ছোপ ছোপ অন্ধকার হাতড়িয়ে মেয়েকে কোলে নেয়। বুকে তার কষ্টের তুফান- 'মারে, তুই মামা বাড়ি হাঁইট্যা যা। এইহানে থাকলি না খাইয়া মরতি হবি।' তুলি কিছুই বোঝে না। সে বোঝে মায়ের অপার স্নেহ-ভালোবাসা। আরতির আদর পেয়ে যেমন এ ঘরের ইঁদুর-টিকটিকি-আরশোলারাও ছেড়ে যেতে পারেনি! চরম অভাবে পুষ্টিহীনতায় ধুঁকছে ঘরের বিড়ালটিও। বিশু গামছায় প্যাঁচানো ঘাসগুলো গরুর মুখের দিকে ছুড়ে ফেলে কাঁপতে কাঁপতে বারান্দায় দাঁড়ায়। চাপাস্বরে বলে-
'ও আরতি, দরজাডা খুলো।'
'মা বাবা আইছে-' তুলির কটকটা গলা।
'এতো আন্ধার ক্যান বউ?'
'আমার রক্ত দিয়া কুপি জ্বালাতি কও মশাই?' আরতির কণ্ঠে ক্ষোভের তুবড়ি।
এমন অন্ধকারটাই যেন বিশুর প্রত্যাশা ছিল। এক দমে সে আরতির চোখকে ফাঁকি দিয়ে চৌকির তলে মুণ্ডুটা ঠেলে রাখে। ফস্ করে ম্যাচকাঠি জ্বালিয়ে বিড়ি ধরায়। দমভর্তি ধোঁয়া অন্ধকারে ঘুরপাক খায়। কুপির সলতেটা বাড়িয়ে আগুন জ্বালায়। সেই আগুনেই দেখে বউয়ের আগুনমুখ।
'যতই অভিমান করো, আমি তুমারে ছাড়া বাঁচতি পারবো না আরতি।'
'প্যাঁচাল বহু শুনছি মশাই। অভাবী সংসারে ভালোবাসা আর বাতাসের মধ্যি কোনো তফাৎ নাই।'
'তুমি এইরহম কইরা কথা কও ক্যান বউ?'
'কী আর কবো! বিয়ার সুমায় আমার বাপের দিয়া ভ্যানগাড়িহান তুমি বেইচ্যা তাস-পাশা খেলছো। বাড়ির ব্যাবাক হাঁস-মুরগি খোয়াইছো! আমার নিজ হাতে লাগানো দুইডা কাঁঠাল গাছ শেষ করছ। বাকি আছি কেবল আমি। আমারেও বিক্রি কইরা দাও।'
'তোমারে বিক্রি করবো আমি? মুখে আনতি পারলা বউ।'
'মোনে কইরা দ্যাহো দি, তুলি প্যাটে আসার আগে তুমি মুন্তারের কাছে তাস খেইল্যা হারছিলা। তিন দিন আগানে-বাগানে পলাইয়া ছিলা। বাগানে গলায় দড়ি দিয়া মরবার গেছিলা। মুন্তার রামদা দিয়া তুমারে কুপাইতি আইছিলো। আমি তুমারে বাঁচাইছি মশাই। তুমার বিছানায় মুন্তারের সাথে একখান রাইত কাটাইছি। দেহ দিয়া তোমার দেনা শোধ করছি।'
আজও সেই কলঙ্কিত রাত আরতিকে তাতিয়ে বেড়ায়। মনে পড়লেই শরীর ঘিনঘিন করে। স্বামী থাকতেও পরপুরুষের সাথে শরীর মেলাতে বাধ্য হয়েছে। মুন্তারের পায়ে ধরে আরতির সে কী আকুতি! 'আমারে তুমি নষ্ট কইরো না মুন্তার ভাই। আমি ঢেঁহিতি ধান ভাইনা, গুড় জ্বালাইয়া তুমার ঋণ শোধ করবো। মা-কালির দিব্বি খাইয়া কইলাম। এমন সুযোগ হাতছাড়া করার মানুষ মুন্তার নয়। সে হারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে দেখেছিল স্বর্গ থেকে নেমে আসা জীবন্ত দেবীকে। যার শরীরময় গন্ধরাজ ফুলের সৌরভ। কী সুঠাম দেহ। মেদহীন পেট। ধবধবা ফর্সা। কমলালেবুর মতো দুগালে টোল পড়া। কপালের সিঁদুরকে মনে হয় পড়ন্ত বিকেলের ডুবে যাওয়া লালবর্ণ সূর্য। বুকটা যেন সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ।
মুন্তারের পশুশক্তির কাছে পরাজিত হয়ে আরতি নেতিয়ে পড়ে। চিৎকার করে তার কলঙ্কটাকে রটাতে চায়নি। মুখে শাড়ির আঁচল দিয়ে সারারাত সহ্য করেছিল পশুটার নির্যাতন।
অমাবস্যা রাত। আকাশও মেঘলা। সন্ধ্যা থেকেই চাঁদের মুখ দেখা যায়নি। শজনে গাছটায় জোড়া হুতুম পেঁচা একটানা গলা সেধে যাচ্ছে। ঐ গাছটায় সব অলক্ষুণে পাখির উৎপাত হয়েছে। সারাদিন গাছটায় যেন আস্তানা গেড়ে বসে শুকুনের দল। ভরদুপুরে বুড়ো শকুনটা বিশুর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। এ বাড়িতে কোনোদিন লক্ষ্মী পেঁচা বেড়াতে আসেনি। এরই নাম কপাল!
বিশুর মনের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের তোলপাড়। এই মুণ্ডুটা তার চোখের পর্দায় বার বার ভেসে ওঠে। মাথার উপর যেন ঘুড়ির মতো পাক খায়। তার ইচ্ছে হয় রাত গভীর হলে মুণ্ডুটা সে ভালো করে দেখবে। এসব আজগুবি চিন্তা তার শিরা-উপশিরা খামচে ধরে। আরতি মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় ঘুমে বিভোর। বিশু কেবল বালিশে মাথা রেখে দিক বদল করে। বুকের ভেতর কী যেন মোচড় খায়। একসময় ভাবনার অথৈ সমুদ্রে ডুবসাঁতার খেলতে খেলতে চোখের পাতা মিলে আসে।
রাত গভীর হলে তার আঙিনায় চারজন মানুষ আসে। সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তোলে-
'বিশু তোমার লুকিয়ে রাখা কলমটি আমরা নিতে এসেছি-'
তাদের ভেতর তিনজন মুখোশপরা। একজন স্বাভাবিক। পরনে তার পায়জামা-পাঞ্জাবি। পরিচয় জানতে চাইলে তারা গর্বের সাথে নিজেদের পরিচয় দেয়। কেউ নেতা, সাংবাদিক, মন্ত্রী। কিন্তু চতুর্থ ব্যক্তি একেবারেই চুপ। বিশু তার কাছে পরিচয় জানতে চাইলে লোকটি মোহনীয় সুরে বলে- 'এত গুণী মানুষের কাছে আমি অতি নগণ্য একটি মানুষ। তবে মুখোশধারী নই। আমি গর্বিত এই ভেবে যে, আমি একজন মাস্টারমশাই। সমাজে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতেই আমার জন্ম হয়েছে।
বিশু মাস্টারমশাইরে মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ঠিক যেন তার বাবার চেহারা। যাত্রার নায়কের মতো পরিপাটি চুল। কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। লোকটি ভীষণ মিষ্টভাষী। তার বাবার মতো। চৌকির নিচ থেকে গামছার গিঁট খুলে দেখে, মাথার খুলিটি সেখানে নেই। কলমটি শুধু পড়ে আছে। বিশু কলমটি হাতের মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে। মাস্টারমশাই বলছে- 'বিশু, তুমি একজন মাস্টারের ছেলে। কিছুতেই ওই কলমটি ওদের হাতে দেওয়া উচিত হবে না। ওরা সবাই তৈলমর্দনকারী। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। জাতির সাথে প্রতারণা করে। কলমটি ওরা অসৎ কাজে ব্যবহার করে পবিত্রতা নষ্ট করবে। তার চেয়ে ভালো হবে সেটাই, যদি তুমি কলমটি আমাকে দাও।'
বিশু তড়িঘড়ি করে কলমটি মাস্টারমশাইকে দেবে বলে ঘরে ছুটে যায়। যেখানে গিয়ে এবার দেখে শুধু মুণ্ডুটাই পড়ে আছে কলমটি নেই।
জমির মাঝামাঝি সীমানা নির্ধারণের দীর্ঘ আইল। বেশ উঁচু মাটির স্তূপ। এতটাই উঁচু যে, হালচাষের সময় প্রান্ত বদল হবার সুযোগ নেই। তবে বলদের গলায় চুলকানি উঠলে এই উঁচু আইলে গলা ঘষে সুখ পায়। এই আইলের অন্য প্রান্তে ট্রাক্টর চালিয়ে জমি চাষে ব্যস্ত মুন্তার। বিশু আইলের কাছাকাছি এলে ট্রাক্টরের শব্দটা ইচ্ছে করে বাড়িয়ে দেয়। গরু যাতে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। জমি চাষে বিরত থাকে। মুন্তার বিশুকে সহ্য করতে পারে না। শালা একটা স্বার্থপর। অকৃতজ্ঞ। এটুকু ভাবে না, আজ যে জমি চাষ করে তার সংসার চলছে, এই পাঁচ বিঘা জমি বিশুর বাবা আশুতোষ বালা মুন্তারের বাপকে উপহার দিয়েছিল। বাবুল শেখ ছিল তার প্রাণের বন্ধু। গলায় গলায় পিরিত। একসঙ্গেই কেটেছে শৈশব- কৈশোর। এক থালায় বসে ভাত না খেলে তাদের পেটের ভাত হজম হতো না। দুর্গা পূজা কিংবা ঈদ এলে আনন্দের সীমা ছিল না। বিজয় দশমীর দিনে জলিরপাড় মেলায় নৌকাবাইচ দেখতে যেত। এ অঞ্চলে যাত্রাপালা, সার্কাস, পুতুলনাচ হলে দুই বন্ধু ছিল সামনের সারির দর্শক। মুন্তার আইলের কাছে এসে গলা ফাটায়-
'হেই মালাউনের বাচ্চা, তোর গতরে শীত লাগে না?'
বিশু রসিকতার সুরে কথা বদল করে।
'নারে মুন্তার, মালাউনগো গতর গুইসাপের চামড়া দিয়ে মোড়ানো থাকে। তাগো গাইল দিয়া চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করলিও কানে শোনে না। লাঠি দিয়ে পিটাইলিও ব্যথা পায় না; যতক্ষণ পর্যন্ত ধারালো বস্তু দিয়ে শরীরে জখম করা না হয়।'
বিশুর কথা বোঝার সাধ্য মুন্তারের নেই। এই গাঁয়ের সব ভূমি-মালিক বেশিরভাগ জমি বিশুর কাছে বর্গা দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। বিশু বতর অনুযায়ী ফসল ফলায়। তবে পরিশ্রম অনুযায়ী প্রাপ্তির খাতা অনেকটা শূন্যই থাকে। তার বাপ-দাদার আমল থেকেই এই অঞ্চলের কৃষকরা ভূমি মালিকদের কাছে জিম্মি। সংসারের অভাব বাড়ছে। মাথার ওপর ঋণের ওজন বেড়েই চলেছে।
মাঠে বইছে হিম বাতাসের অদৃশ্য স্রোত। তিরতির করে নড়ছে খেজুরগাছের পাতাগুলো। ভরদুপুরেও কুয়াশা চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। 'ও বাবা, খাইয়া যাও।' মেয়ের কণ্ঠ বিশুর কানে এসে ধাক্কা দেয়। আরতি খেজুরতলায় দাঁড়িয়ে পাথারে দৃষ্টি মেলে ধরে। চারদিক কেবল শূন্যতা। তার জীবনের মতো। চিনচিন বাতাসেও যেন দীর্ঘশ্বাসের মহড়া চলছে। আরতির গোলাপি রঙের শাড়ির আঁচলটা তার শরীর থেকে ঘুড়ির মতো উড়তে চাইছে। বিশু মাজার গামছা খুলে মুখ মুছতে মুছতে আরতির মুখোমুখি হয়। কিছুদিন ধরেই তাদের মান-অভিমান চরমে। বিশু মেয়েকে বলে, 'তোর মায় কিছু মুখে দেয় নাইরে তুলি?'
'সেই বিয়ানে খেজুরের রস দিয়া মুড়ি খাইছে।' তুলি কটকটা গলায় বলে।
তুলি খেজুরতলায় পড়ে থাকা একটা ছেঁড়া ঘুড়ি ওড়াতে বৃথা চেষ্টা করে। ওর কতদিনের ইচ্ছা একটা লাল ঘুড়ি আকাশে ওড়াবে। ঘুড়ির সঙ্গে তার মনটাও ভাসিয়ে দেবে চাঁদের দেশে।
মুন্তারকে দেখে আরতির অসহ্য লাগে। মাথায় ঘোমটা বাড়িয়ে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু মুন্তারের যে শকুনের দৃষ্টি। এড়িয়ে যাওয়া অতটা সহজ ছিল না। তা অবশ্য আরতির থেকে ভালো কেই-বা জানে! ট্রাক্টর বন্ধ করে সে আরতির গা ঘেঁষে দাঁড়ায়-
'ও বৌদি, আমাগো প্যাটে খিদা লাগে না?' বলতে বলতে নির্লজ্জের মতো ফেনাভাতের থালে হাত ডুবিয়ে দেয়। সুন্দরী বৌদির হাতের ফেনাভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। মনের জিহ্বা দিয়েও বৌদির হলুদ অঙ্গের লকলকে শরীর চেটে খায়।
'ও বৌদি, তুমি বিশুরে কী এমন কছম দিলা কওদি? মানুষটা জন্মের লাহান তাস খেলা ছাইড়া দিলো। দোহাই তুমার, কছম উঠাইয়া নাও বৌদি। কেবল আরেকটা দিন বিশুরে বাজিতে আমার কাছে হাইরা যাবার দাও! আমার জীবনটা আবার ধন্য হবি।'
আরতির চোখে লাল দৃষ্টির ধার। হৃদয়টা খচখচিয়ে ওঠে। বিশুর ইচ্ছে হয় লাঙলের তীক্ষষ্ট ফলা বদমাশটার বুকে বসিয়ে দিতে। আরতি কালবিলম্ব না করে বাড়ি চলে যায়।
হঠাৎ বিশুর দৃষ্টি পড়ে লাঙলের ফলার দিকে। মাটির প্রকাণ্ড চাকার সাথে উঠে আসে একটি মাথার খুলি। খুলির কিছুটা পাশেই ছিল একটি জং-ধরা কলম। দুটো জিনিস পাশাপাশি থাকায় তার মনটা দড়াম করে ওঠে। একটা অপ্রত্যাশিত ঝড় তাকে যেন তছনছ করে দিতে চাইছে।
বিশু এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাটিমাখা মুণ্ডুটা গামছায় মুড়িয়ে রাখে। কেউ দেখলেই সর্বনাশ। কত ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে। এই গামছার পুঁটলি মুন্তারের চোখে পড়লে নিশ্চিত শালা খুলে দেখতে চাইবে হীরা-মাণিক্য আছে কিনা। বহু বছর আগে এ অঞ্চলে পুকুর খনন কিংবা জমি চাষের সময় কৃষকের লাঙলের ফলায় সোনাভর্তি পিতলের ঘটি পাওয়ার নজির আছে। কিন্তু বিশুর কি আর সেই ভাগ্য! সে বুদ্ধি খাটিয়ে আইলের ঘাস কেটে গামছা ভর্তি করে। ঘাসের নিচে ডুবিয়ে রাখে মুণ্ডুটা। কলমটা রাখে ফাঁকা মুণ্ডুর ভেতর। সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গলে ঘাপটি মেরে থাকে। এবার মুণ্ডুটা ভালো করে ওলটপালট করে দেখে। মুণ্ডুর পেছনে একটা সরু ছিদ্র। হয়তো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মুণ্ডুটা তার বাবার নয় তো! এ মুহূর্তে বাবার মুখখানা চোখের পর্দায় দোল খায়। বুকের ভেতর কী এক আর্তনাদ খচখচিয়ে ওঠে। শহরের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা একদিন গভীর রাতে তার বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। আর সে ফিরে আসেনি। লাশটাও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিশুর বাবা আশুতোষ বালা ছিল কৃষক আন্দোলনের তুখোড় নেতা। কৃষকদের প্রাণের মানুষ। সারাক্ষণ পরনে থাকত সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। বাড়ির উঠোনে গলা ছেড়ে শ্যামা সংগীত গাইত। মুন্তারের বাপের সাথে যাত্রাপালায় নায়কের অভিনয় করত। তার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে কথা বলার কেউ ছিল না। বন্ধুরা তাকে ডাকত নেতাজি সুভাষ বলে।
ছোটবেলা থেকেই শরীরের গড়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। শরীরে ছিল সিংহের শক্তি। দু'তিনজনও কুস্তি লড়ে হারাতে পারেনি। হাডুডু খেলায় ছিল ভীষণ পটু। বিপক্ষ দলের তিন-চারজন খেলোয়াড়কে টেনে-হিঁচড়ে নিজের সীমানায় নিয়ে আসত।
পণ্ডিত মশাই একদিন আশুতোষের রেজাল্টের সংবাদ নিয়ে আসেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আশু ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। সেই সুসংবাদটা ঝড়ের গতিতে গ্রামবাসীর কানে পৌঁছে যায়। তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে, ফুলের মালা নিয়ে তাদের গর্বিত রাজপুত্তুরকে বরণ করে নেয়। এমন বিদ্বান যে গাঁয়ে দ্বিতীয়জন নেই।
মায়ের পরামর্শে আশুতোষ একদিন মামা সুধীরের সাথে কলকাতা চলে আসে। ভালো চাকরি পেলে সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাবারও চিন্তা করে। সুধীর কলকাতায় ট্যাক্সি চালায়। উল্টোডাঙ্গা দেশবন্ধু পার্কের পেছনে বাড়িও করেছে। আশুর মামি শিখা বাড়িতে সেলাই শেখার স্কুল খুলেছে। বলা যায় সুখেই আছে। অশান্তি একটাই- বিয়ের পাঁচ বছর পার হলেও সন্তানের মুখ দেখা হয়নি। আশুতোষ একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি পায়। বছর দুয়েক সেখানে কাজ করে। বেশ কিছু টাকাও জমায়। এক দালালের কাছে মায়ের জন্যও টাকা পাঠাতে থাকে। মামির কাছে সেলাই শিখতে আসা সবিতার সাথে তার ভালোবাসা হয়। মামার মতেই একদিন দুজনে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। উল্টোডাঙ্গা রোডেই আলাদা একটি বাসা ভাড়া নেয়। দেড় বছরের মাথায় ওদের ঘর আলোকিত করে আসে একটি পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় বিশু।
পশ্চিম বাংলার রাজনীতি তখন টালমাটাল। সাল্ফ্রাজ্যবাদী আন্দোলন বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্যে চাপা উত্তেজনায় ঠাসা। গ্রামের দিকে বেশি অশান্তি চলছে। ভূমি মালিকদের সাথে কৃষকদের মুখোমুখি সংঘর্ষ লেগেই আছে। পুলিশও ভূমি মালিকের পক্ষ নেয়। নিরীহ কৃষকদের ওপর চালায় সীমাহীন নির্যাতন। পদ্মার উত্তালের মতো কৃষককুলও ফুঁসে ওঠে। দীর্ঘকাল ধরে ওদের বুকে জ্বলছে পরাজয়ের আগুন। এখন সময় এসেছে প্রতিশোধ নেবার। শিলিগুড়ি শহরের খুব কাছে নকশালবাড়ি গ্রামে পুলিশ হিংস্র হয়ে ওঠে। নির্বিচারে গুলি চালায় নিরস্ত্র কৃষকদের বুকে। মুহূর্তেই নকশালবাড়ির মাটি রক্তে প্লাবিত হয়ে যায়। কৃষক গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলে। চারদিকে খুনোখুনি, লুটতরাজ, বোমাবাজি চলতে থাকে। আশুতোষ খবর শুনে মামাকে না জানিয়ে সেদিন নকশালবাড়ি আসে। বিক্ষোভে তার বুকে যেন অগ্নিগিরি জ্বলতে থাকে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সে মেনে নিতে পারে না। নকশালদের অসংখ্য বীরত্বের কাহিনি তাকে সাহসী করে তোলে। কিছুদিনের ব্যবধানে মাওবাদী বিদ্রোহ শুরু হলে গোটা বাংলায় ভয়াল পরিস্থিতি দেখা দেয়। আশুতোষের মাথাটা রাজনৈতিক চক্ররথে ঘুরপাক খায়। সে বুঝে উঠতে পারে না, নকশাল বিদ্রোহের সঙ্গে মাওবাদীদের সম্পর্ক কী?
আশুতোষ ভাবে, তার দেশের ভূমি মালিক, জোতদারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষকদের প্রতিবাদী করতে হবে। ওই রাঘববোয়ালদের উচিত শিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত কৃষককুলের মুক্তি নেই।
আশু একদিন শিলিগুড়ির কৃষকসভায় হাজির হয়। তখন মঞ্চে ছিলেন নকশাল বাহিনীর তুখোড় নেতা জঙ্গল সাঁওতাল, চারু মজুমদারসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। আশু নিজের আবেগকে চাপা রাখতে না পেরে সাহস করে মঞ্চে ওঠে। চারু মজুমদারের পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানায়। একটি চিরকুটে কৃষককুলের মুক্তির তিনটি পরামর্শ লিখে দেয়। চারু মজুমদার আশুকে বুকে টেনে বাহবা দেয়। মাইকে আশুর হাত উঁচু করে পরিচয় করিয়ে দেয়-'আশুতোষ বালা। নকশাল বাহিনীর আগামী দিনের নেতা।' আরও কত কী প্রশংসা।
সেদিন সকালে উল্টোডাঙ্গা রোডে নকশালপন্থি একটি ঝটিকা মিছিল নেমেছিল চারু মজুমদারের মুক্তির দাবিতে। আশুতোষ ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। সে খবরের কাগজ পড়ে দেখে চারু মজুমদার দমদম জেলে বন্দি। মুহূর্তেই সে দমদম যাবার বাসে উঠে বসে। কারাগারের সামনে চারু মজুমদারের মুক্তির দাবিতে একাই বিক্ষোভ দেখায়। অনশনের হুমকি দেয়। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক আশুতোষের সাক্ষাৎকার নিতে আসে। সেই মুহূর্তে পুলিশ আশুকে ধরে নিয়ে যায়। সপ্তাহখানেক জেলের ঘানিও টানতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জানতে পারে, তার চাকরিটা আর নেই। চরম অপমানে একদিন সে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে দেশে ফিরে আসে।
আশুতোষের দেশে ফিরে আসার খবর মুহূর্তেই গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রিয় মানুষটাকে দেখতে সবাই ছুটে আসে। সবার মনে সে কী আনন্দ! তাদের ঘরের ছেলে ফিরে এসেছে। মুহূর্তেই একটা দুঃসংবাদ আশুকে শোকাহত করে। সে মাথায় হাত দিয়ে সটাং করে কাচারিঘরের মাটিতে বসে পড়ে। কৃষকপাড়ার নিখিলদা আর নেই। তাকে খুন করা হয়েছে। সেই খুনটা করেছে তারই প্রাণের বন্ধু বাবুল শেখ। আশু দেশে না থাকার কারণে কিছু ভূমি মালিক বাবুলকে দলে ভেড়ায়। মাত্র পাঁচ হাজার টাকার লোভে নিখিলের পিঠে কাস্তে দিয়ে কোপাতে যায়। ফাঁকা জমিতে দুজনার ভেতর ধস্তাধস্তি চলে। একপর্যায়ে কাস্তের কোপ নিখিলের মাথায় গিয়ে লাগে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। বাবুল শেখ এখন জেলে। দিনরাত পাগলের মতো কাঁদে। তার একটাই কথা নিখিলকে সে খুন করতে চায়নি। পিঠে আঘাত করার কথা ছিল। হারু কাজির মুখে কথাগুলো শুনে আশুতোষ বোবার মতো বসে থাকে। শোকে পাথর যেন। ধিক্কার দেয় বন্ধুকে। এমন একটা নরপশু তার বন্ধু!
আশুতোষ রাজনীতির পাশাপাশি নিজের বাড়িতে পাঠশালা খুলে বসে। সংগ্রামী জীবনের সাথে যুক্ত হয় নতুন পদবি 'আশু মাস্টার'। সকাল থেকেই তাদের উঠোনে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়সী মানুষের ভিড় লেগে থাকত। নিজের পয়সা খরচ করে আশু মাস্টার ছাত্রদের কিনে দিতেন স্লেট, চক আর আদর্শলিপি বই। সারাদিন ছাত্রদের মুখে গুনগুন করে শোনা যেত স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের মধুর স্বর।
নলদিঘির মানুষ তখন নকশাল আন্দোলনের কিছুই জানে না। এতদিনে আশুতোষের জ্ঞান-বুদ্ধি-নেতৃত্ব আরও বেশি শানিত হয়েছে। সে যে গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে। শোবার ঘরে চারু মজুমদারের বিশাল এক ছবি টাঙিয়ে রাখে।
নলদিঘিতেও তখন ভূমি মালিকদের নির্যাতন চরমে। শোষিত কৃষক শ্রেণি তখন বড় অসহায়। কোণঠাসা। ভূমি মালিকরা দিনের পর দিন কৃষকদের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে। তাদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে বতর অনুযায়ী ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে। বছর ঘুরে সেই সুদের টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যায়। কৃষকের ঋণ শোধ হয় না। মালিকের পা ধরে কান্নাকাটি করে। তারা কৌশলে কৃষকদের সুদের টাকা না নিয়ে তাদের অংশের ফসল কেড়ে নেয়।
ভূমিহীন কৃষকদের ওপর এমন অত্যাচার আশুতোষ সহ্য করতে পারে না। সে কালসাপদের বিষদাঁত ভাঙার প্রতিজ্ঞা করে। তা না হলে নলদিঘির কৃষকদের বাঁচানো যাবে না।
আশুতোষ একদিন গভীর রাতে কৃষকদের নিয়ে আলোচনায় বসে। ভূমি মালিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে বলে। ফসলের অর্ধেক পাবার দাবিতে সবাই সোচ্চার হয়। প্রতিটি কৃষকের ঘরে দেশি অস্ত্র রাখার পরামর্শ দেয়। প্রয়োজনে তারা নলদিঘিকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেবে।
একদিন শীতের কুয়াশাভেজা রাতে শহর থেকে কমিউনিস্ট পার্টির দু'জন বর্ষীয়ান নেতা আশুতোষের বাড়ি আসে। হাতে দেয় এক হাজার টাকা। তিন ডজন লাল গেঞ্জি। গেঞ্জির পেছনে লেখা- দুনিয়ার মজদুর এক হও। কাস্তে প্রতীক চিহ্নিত একটি রক্তবর্ণ পতাকা হাতে দিয়ে বলে, যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকে এই পতাকাকে সম্মান করে যেও। জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে। একদিন তোমাদেরও পতাকা হবে। আশুতোষ সাহস করে বলেছিল, নকশাল আন্দোলনের সাথে আপনাদের রাজনীতির কী সম্পর্ক?
সিনিয়র নেতাটি বলেছিল, 'সব নদীই কিন্তু সাগরের মোহনায় মিলে যেতে চায় আশুতোষ।'
তারা দেরি না করে চারু মজুমদারের ছবিতে স্যালুট জানিয়ে চলে যায়।
ভূমি মালিক, জোতদার শ্রেণি মিলে শহর থেকে ভাড়াটে গুন্ডা এনে নলদিঘির কৃষকের ওপর লেলিয়ে দেয়। এরই মাঝে দুজন কৃষক খুন হলে নলদিঘি যেন বিদ্রোহের দাবানলে রূপ নেয়। দলে দলে পুলিশ আসে। মালিকদের পক্ষে গুণকীর্তন করে। মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ভরে চলে যায়। কেউ সাক্ষ্য দেবার সাহস করে না। আশুতোষ জানে, আকবর ভাই, নিখিলদাকে কারা খুন করেছে। সে নিজে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেবার প্রস্তুতি নেয়।
শ্রাবণের সেই রাতটি ছিল সত্যিই ভয়ংকর। গোয়েন্দাবাহিনীর পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকধারী তিনজন লোক আশুতোষের বাড়ি আসে। গোপন কথা আছে বলে তারা আশুকে খেজুরতলা মাঠে নিয়ে যায়। মমতা উদ্বিগ্ন মনে ছেলের পথের দিকে চেয়ে থাকে। একপর্যায়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। সবিতাও বিশুকে নিয়ে পড়শিদের ডেকে ওঠায়। প্রতিবেশীরা আশুতোষকে খুঁজতে নামে। দক্ষিণ পাড়ার কৃষকরাও তাদের নেতাকে সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। কিন্তু আশুতোষের হদিস মেলে না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গত হয়ে গেলেও আশুতোষ আর ফিরে আসে না। সবার ধারণা তাকে খুন করা হয়েছে। ছেলে হারানোর শোকে কিছুদিন পরই মমতার মৃত্যু হয়।
২.
তেলশূন্যতায় কুপির সলতেটা তিরতির করে কাঁপছে। স্বরবর্ণের অক্ষরগুলো তুলির চোখে বড়ই ধূসর। মাথা নিচু করে ট্যা ট্যা চোখে বইয়ের অক্ষর খোঁজে। একসময় কুপিটা ধপ করে নিভে যায়। 'ও মা, ঘরতো আন্ধার হইয়া গ্যালো!'
আরতির চোখে লাফিয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ। এ সংসারে এসে তার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। ছোপ ছোপ অন্ধকার হাতড়িয়ে মেয়েকে কোলে নেয়। বুকে তার কষ্টের তুফান- 'মারে, তুই মামা বাড়ি হাঁইট্যা যা। এইহানে থাকলি না খাইয়া মরতি হবি।' তুলি কিছুই বোঝে না। সে বোঝে মায়ের অপার স্নেহ-ভালোবাসা। আরতির আদর পেয়ে যেমন এ ঘরের ইঁদুর-টিকটিকি-আরশোলারাও ছেড়ে যেতে পারেনি! চরম অভাবে পুষ্টিহীনতায় ধুঁকছে ঘরের বিড়ালটিও। বিশু গামছায় প্যাঁচানো ঘাসগুলো গরুর মুখের দিকে ছুড়ে ফেলে কাঁপতে কাঁপতে বারান্দায় দাঁড়ায়। চাপাস্বরে বলে-
'ও আরতি, দরজাডা খুলো।'
'মা বাবা আইছে-' তুলির কটকটা গলা।
'এতো আন্ধার ক্যান বউ?'
'আমার রক্ত দিয়া কুপি জ্বালাতি কও মশাই?' আরতির কণ্ঠে ক্ষোভের তুবড়ি।
এমন অন্ধকারটাই যেন বিশুর প্রত্যাশা ছিল। এক দমে সে আরতির চোখকে ফাঁকি দিয়ে চৌকির তলে মুণ্ডুটা ঠেলে রাখে। ফস্ করে ম্যাচকাঠি জ্বালিয়ে বিড়ি ধরায়। দমভর্তি ধোঁয়া অন্ধকারে ঘুরপাক খায়। কুপির সলতেটা বাড়িয়ে আগুন জ্বালায়। সেই আগুনেই দেখে বউয়ের আগুনমুখ।
'যতই অভিমান করো, আমি তুমারে ছাড়া বাঁচতি পারবো না আরতি।'
'প্যাঁচাল বহু শুনছি মশাই। অভাবী সংসারে ভালোবাসা আর বাতাসের মধ্যি কোনো তফাৎ নাই।'
'তুমি এইরহম কইরা কথা কও ক্যান বউ?'
'কী আর কবো! বিয়ার সুমায় আমার বাপের দিয়া ভ্যানগাড়িহান তুমি বেইচ্যা তাস-পাশা খেলছো। বাড়ির ব্যাবাক হাঁস-মুরগি খোয়াইছো! আমার নিজ হাতে লাগানো দুইডা কাঁঠাল গাছ শেষ করছ। বাকি আছি কেবল আমি। আমারেও বিক্রি কইরা দাও।'
'তোমারে বিক্রি করবো আমি? মুখে আনতি পারলা বউ।'
'মোনে কইরা দ্যাহো দি, তুলি প্যাটে আসার আগে তুমি মুন্তারের কাছে তাস খেইল্যা হারছিলা। তিন দিন আগানে-বাগানে পলাইয়া ছিলা। বাগানে গলায় দড়ি দিয়া মরবার গেছিলা। মুন্তার রামদা দিয়া তুমারে কুপাইতি আইছিলো। আমি তুমারে বাঁচাইছি মশাই। তুমার বিছানায় মুন্তারের সাথে একখান রাইত কাটাইছি। দেহ দিয়া তোমার দেনা শোধ করছি।'
আজও সেই কলঙ্কিত রাত আরতিকে তাতিয়ে বেড়ায়। মনে পড়লেই শরীর ঘিনঘিন করে। স্বামী থাকতেও পরপুরুষের সাথে শরীর মেলাতে বাধ্য হয়েছে। মুন্তারের পায়ে ধরে আরতির সে কী আকুতি! 'আমারে তুমি নষ্ট কইরো না মুন্তার ভাই। আমি ঢেঁহিতি ধান ভাইনা, গুড় জ্বালাইয়া তুমার ঋণ শোধ করবো। মা-কালির দিব্বি খাইয়া কইলাম। এমন সুযোগ হাতছাড়া করার মানুষ মুন্তার নয়। সে হারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে দেখেছিল স্বর্গ থেকে নেমে আসা জীবন্ত দেবীকে। যার শরীরময় গন্ধরাজ ফুলের সৌরভ। কী সুঠাম দেহ। মেদহীন পেট। ধবধবা ফর্সা। কমলালেবুর মতো দুগালে টোল পড়া। কপালের সিঁদুরকে মনে হয় পড়ন্ত বিকেলের ডুবে যাওয়া লালবর্ণ সূর্য। বুকটা যেন সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ।
মুন্তারের পশুশক্তির কাছে পরাজিত হয়ে আরতি নেতিয়ে পড়ে। চিৎকার করে তার কলঙ্কটাকে রটাতে চায়নি। মুখে শাড়ির আঁচল দিয়ে সারারাত সহ্য করেছিল পশুটার নির্যাতন।
অমাবস্যা রাত। আকাশও মেঘলা। সন্ধ্যা থেকেই চাঁদের মুখ দেখা যায়নি। শজনে গাছটায় জোড়া হুতুম পেঁচা একটানা গলা সেধে যাচ্ছে। ঐ গাছটায় সব অলক্ষুণে পাখির উৎপাত হয়েছে। সারাদিন গাছটায় যেন আস্তানা গেড়ে বসে শুকুনের দল। ভরদুপুরে বুড়ো শকুনটা বিশুর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। এ বাড়িতে কোনোদিন লক্ষ্মী পেঁচা বেড়াতে আসেনি। এরই নাম কপাল!
বিশুর মনের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের তোলপাড়। এই মুণ্ডুটা তার চোখের পর্দায় বার বার ভেসে ওঠে। মাথার উপর যেন ঘুড়ির মতো পাক খায়। তার ইচ্ছে হয় রাত গভীর হলে মুণ্ডুটা সে ভালো করে দেখবে। এসব আজগুবি চিন্তা তার শিরা-উপশিরা খামচে ধরে। আরতি মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় ঘুমে বিভোর। বিশু কেবল বালিশে মাথা রেখে দিক বদল করে। বুকের ভেতর কী যেন মোচড় খায়। একসময় ভাবনার অথৈ সমুদ্রে ডুবসাঁতার খেলতে খেলতে চোখের পাতা মিলে আসে।
রাত গভীর হলে তার আঙিনায় চারজন মানুষ আসে। সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তোলে-
'বিশু তোমার লুকিয়ে রাখা কলমটি আমরা নিতে এসেছি-'
তাদের ভেতর তিনজন মুখোশপরা। একজন স্বাভাবিক। পরনে তার পায়জামা-পাঞ্জাবি। পরিচয় জানতে চাইলে তারা গর্বের সাথে নিজেদের পরিচয় দেয়। কেউ নেতা, সাংবাদিক, মন্ত্রী। কিন্তু চতুর্থ ব্যক্তি একেবারেই চুপ। বিশু তার কাছে পরিচয় জানতে চাইলে লোকটি মোহনীয় সুরে বলে- 'এত গুণী মানুষের কাছে আমি অতি নগণ্য একটি মানুষ। তবে মুখোশধারী নই। আমি গর্বিত এই ভেবে যে, আমি একজন মাস্টারমশাই। সমাজে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতেই আমার জন্ম হয়েছে।
বিশু মাস্টারমশাইরে মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ঠিক যেন তার বাবার চেহারা। যাত্রার নায়কের মতো পরিপাটি চুল। কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। লোকটি ভীষণ মিষ্টভাষী। তার বাবার মতো। চৌকির নিচ থেকে গামছার গিঁট খুলে দেখে, মাথার খুলিটি সেখানে নেই। কলমটি শুধু পড়ে আছে। বিশু কলমটি হাতের মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে। মাস্টারমশাই বলছে- 'বিশু, তুমি একজন মাস্টারের ছেলে। কিছুতেই ওই কলমটি ওদের হাতে দেওয়া উচিত হবে না। ওরা সবাই তৈলমর্দনকারী। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। জাতির সাথে প্রতারণা করে। কলমটি ওরা অসৎ কাজে ব্যবহার করে পবিত্রতা নষ্ট করবে। তার চেয়ে ভালো হবে সেটাই, যদি তুমি কলমটি আমাকে দাও।'
বিশু তড়িঘড়ি করে কলমটি মাস্টারমশাইকে দেবে বলে ঘরে ছুটে যায়। যেখানে গিয়ে এবার দেখে শুধু মুণ্ডুটাই পড়ে আছে কলমটি নেই।
- বিষয় :
- সনোজ কুণ্ডু
- মুখোশ