ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

প্রচ্ছদ

ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ

ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লুৎফর রহমান

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২১ | ১২:০০

সর্বজনবিদিত সত্য এই যে, বিপুল রবীন্দ্র-সৃষ্টি সম্ভারের একটা বৃহদংশ জুড়ে রয়েছে পত্রসাহিত্য। 'য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র' (শক ১৮০৩) 'য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি' ১ম খণ্ড (১৮৯১), 'য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারি' ২য় খণ্ড (১৮৯৩), 'ছিন্নপত্র' (১৮৮৫-১৮৯৫), 'জাপান-যাত্রী' (১৯১৯), 'পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি ও 'জাভাযাত্রীর পত্র (একত্রে যাত্রী, ১৯২৯), 'রাশিয়ার চিঠি' (১৯৩১) ইত্যাদি বিচিত্রনামা গ্রন্থ রয়েছে এ-তালিকায়। নামকরণের মধ্যেই স্পষ্ট যে, এগুলো সবই পত্রাকারে লেখা নয়, দিনলিপি, ভ্রমণবৃত্তান্ত এবং পত্র আঙ্গিকে রচিত। উল্লিখিত রচনাবলি কাব্য, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, ব্যঙ্গ-কৌতুক, সংগীত ইত্যাদি গরুগম্ভীর বিভিন্ন আঙ্গিকের পর্যায়ভুক্ত নয়। আমরা মোটাদাগে যাদের 'পত্রসাহিত্যে'র গোত্রভুক্ত করেছি রবীন্দ্র-গবেষক নিশ্চয়ই সেগুলো নিয়েও বিস্তর গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। উল্লেখ্য যে, 'ছিন্নপত্র'/'ছিন্নপত্রাবলী' নামের গ্রন্থটি বাঙালির চেতনায় আলাদা গুরুত্বের দাবিদার। উত্তরাধিকার চেতনা দ্বারা বিচার করলে পত্রগুলো ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৫ সালের পূর্ব বাংলার ঐতিহাসিক দলিল। পত্রগুলোর ভূগোল কুষ্টিয়া, কুমারখালীর শিলাইদহসহ পদ্মাতীরবর্তী পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, পাবনার বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, যমুনাতীরবর্তী জনপদ, শিলাইদহ থেকে কাচিঘাটা (কাচিকাঠা) হয়ে চলনবিল এবং রাজশাহীর পতিসর, কালিগ্রাম অর্থাৎ দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত সমগ্র অঞ্চল। পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, যমুনা, ছোট যমুনা, নাগর, আত্রাই, তুলসীগঙ্গা প্রভৃতি নদী ঐতিহাসিককাল থেকেই এ-অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত। অত্র অঞ্চলসমূহের জনজীবন এসব নদীর খামখেয়ালিনির্ভর। নদীর ভাঙন-গড়নের লীলার সঙ্গে অচ্ছেদ্যবন্ধনে যুক্ত কৃষিজীবী এসব জনপদের সেকালে নিরক্ষর কৃষকশ্রেণির জীবন। বন্যা-মারি-মহামারি, অজন্মা-খরার মতো প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ১৮৮৫ সালের যে-পূর্ব বাংলা রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে তারই প্রত্যক্ষ চিত্র বিদ্যমান। একজন সহমর্মীর দৃষ্টিতে অপার কৌতূহল নিয়ে তিনি প্রত্যেকটি মুহূর্তকে পর্যবেক্ষণ ও উপস্থাপন করেন। একই সঙ্গে এই জনপদের জীবন ও প্রকৃতির প্রভাব রবীন্দ্র-চৈতন্যে যে-পরিবর্তন সাধন করে পত্রপাঠে তাও অবগত হওয়া যায়। বলা যায়, রবীন্দ্র-আত্মশক্তির যথার্থ উৎসারণ ঘটে এই সময়ে, এই বাংলায়। কাব্যরচনার কাল বিবেচনায় 'মানসী', 'সোনার তরী', 'চিত্রার কাল', রবীন্দ্র-ছোটগল্পেরও সূচনাকাল। ছিন্নপত্রগুলো সে সবকিছুরই উৎস। রবীন্দ্র-সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠকের নিকট 'ছিন্নপত্র' পাঠ তাই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
কর্মহীন অবসরে ছিন্নপত্র পাঠের অভ্যাস সে অনেকদিন। পত্র, অন্তরের প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি- এই বিশ্বাস থেকেই প্রথমত পত্রপাঠে অভ্যস্ত হই। 'ছিন্নপত্র' কেনো পত্র? এমন প্রশ্নের একটা পরিস্কার উত্তর অনুসন্ধানেও এক সময় উদ্যোগী হই। ছিন্নপত্র পাঠকালে মনে হয়, সমগ্র প্রক্রিয়াটা চলমান অর্থাৎ ঘটমান বর্তমান- রবীন্দ্রনাথ বলছেন পাশে বসে শুনছি সেই অমিয়বাণী। বিবেচনা করি, রবীন্দ্রনাথের জগৎবোধ, প্রকৃতিচেতনা, উপনীষদীয় ব্রহ্মবাদ, সৌন্দর্যচেতনা, গতিতত্ত্ব, নিম্নবিত্তের জীবনচর্চা, মায়া এবং বাস্তবতা, গদ্য, পদ্য, ছোটগল্পের চেতনা ইত্যাদি বিষয়ের চিন্তাকেন্দ্র 'ছিন্নপত্রাবলী'। গ্রন্থমধ্যে মোট ২৫২টি পত্র সংযোজিত। তন্মধ্যে ৮টি পত্র নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও কবিবন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা এবং বাকি সবই ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা। কবির ভাষায় "[...] তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি।' মনের কথা, প্রত্যক্ষ উপলব্ধির কথা, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা- তাকে শিল্পিত রূপ দেবার যেমন দরকার নেই, তেমনি যুক্তি দ্বারা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবারও প্রয়োজন নেই। ফলে পত্রের উপজীব্য সত্য, রচয়িতার অনুভব, উপলব্ধিজাত সত্য। তাই 'ছিন্নপত্রে'র রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ -তাঁরই সমগ্র চৈতন্যের উদ্ভাস। প্রত্যেকটি পত্র এক একটি অখণ্ড ভাবের উৎসারণ। কখনও তা অস্তরাগে রঙিন বাংলার সান্ধ্যপ্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, কবির চেতনায় বিস্ময় জাগানিয়া রূপমাধুরী হয়ে ধরা দেয়।
'[...] পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই-যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ-যে একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।' [৪ নম্বর পত্র ]
উদ্ধৃত অংশ ১৮৮৯ সালে সম্ভবত নভেম্বর মাসে শিলাইদহ থেকে লিখিত। এ-পত্র 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' (১২৯১) পরবর্তী এবং 'মানসীকাব্য' (১৮৯০) গ্রন্থের পূর্ববর্তী সময়ের রচনা। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কবিত্বশক্তির উন্মেষপর্বে রচিত এই পত্রগুলো। এটা স্বাভাবিক যে, 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' রচনার অব্যবহিত পরে, ২৭ বছরের তরুণের চোখে তখন বৈষ্ণবীয় ভুবন- 'রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর' কিংবা 'রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল। যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল' ইত্যাদি চরণধৃত রাধারূপের আচ্ছন্নতা। কিন্তু রবীন্দ্র-চেতনায় সদ্য সমাপ্ত কাব্যের ভাবাবেশ অধিককাল স্থায়ী হয়নি। বাংলার প্রকৃতির অপরূপ রূপে মুগ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ দিনরাত্রির খেয়ায়, ষড়ঋতুর আবর্তনে নিত্যদিন পৃথিবীর রূপের যে-পরিবর্তন ঘটে চলেছে সেই অনির্বচনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করে বিস্মিত। ১৪৬ নম্বর পত্রে রামমোহন রায়ের বাংলা গ্রন্থাবলি পাঠের একটা সমালোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। 'বেদান্ত' পাঠে 'আমার মনের কোনো সংশয় দূর হয় নি।' এ কথা বলবার পরে তিনি 'বেদান্ত দর্শনের এক যৌক্তিক সমালোচনায় অবতীর্ণ হন। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য আর সকলই মায়া এ-বক্তব্যের সাথে সহমত হওয়া কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। দিনান্তে প্রকৃতির সর্ববস্তুতে স্পষ্টতায় অস্পষ্টতায়, আলো-আঁধারে, সত্যে-মিথ্যায়, রঙে-রূপে, ছায়ায়-মায়ায় যে-সত্যের উদ্ভাসন ঘটে, সেইখানেই প্রকৃত মুক্তি নিহিত। 'ছিন্নপত্রে'র এই রচনায় 'বেদান্তে'র মীমাংসা খুঁজে পেয়েছেন কবি। পত্রে তিনি লিখলেন-
'দার্শনিক বলতে পারেন, সন্ধ্যাবেলায় জগৎকে যে পরিমাণে মায়া বলে উপলব্ধি করা হয় সেই পরিমাণে মুক্তি লাভ করা যায় এবং আমি যে আনন্দ পেতে থাকি সেটা যথার্থতঃ মুক্তিরই আনন্দ - অর্থাৎ জগৎটাকে সত্য জ্ঞান করার দরুন দিনের বেলায় আমার যে একটা দৃঢ় বন্ধন থাকে, সন্ধ্যাবেলায় সমস্ত ছায়াময় হয়ে আসতেই বন্ধন অনেকটা পরিমাণে মিথিল হয়ে আসে; যখন জগৎটাকে একেবারে সম্পূর্ণই অসৎ বলে অন্তরের মধ্যে দৃঢ় উপলব্ধি জন্মাবে তখন যে একটি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করব সেই স্বাধীনতায় আমি ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হব।'
একটি সাধারণ পত্র, সচরাচর কুশলাদি খবরা-খবর আদান-প্রদানের জন্যই প্রেরিত হয়ে থাকে। প্রবাসে প্রিয়জনের সান্নিধ্যবিহীন একাকী বসবাসকালে নিজের মনের অবস্থা জানিয়ে নিকটজনকে লেখা পত্র এটি নয়, এখানে রচয়িতা প্রকৃতির এক বিশেষ অবস্থায় গূঢ় এক দার্শনিক তত্ত্বের মর্মে পৌঁছালেন কী করে তাই পত্রাকারে লিখেছেন। 'ছিন্নপত্রাবলী'র কোনো পত্রই সাধারণ ঘরোয়া কথার মালা নয় কিংবা নয় প্রয়োজনের দীর্ঘ ফিরিস্তি। প্রত্যেকটি পত্রের বিষয়বস্তুগত তাৎপর্য এগুলোকে বিশেষ এক ধরনের ব্যক্তিগত প্রবন্ধের স্তরে উন্নীত করেছে। এবং নিবিড় পাঠে দেখা যাবে ১৮৮৭ সেপ্টেম্বর হতে ১৮৯৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পত্রগুলো বিচিত্র বিষয়ে রচিত ভাবী রবীন্দ্রনাথের পরিণত প্রতিভার স্বাক্ষরবাহী রচনা। ত্রিশের কোঠার একজন তরুণের জাগতিক বিবিধ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ এবং রহস্যভেদের প্রচেষ্টা অস্বাভাবিক নয়, তাই বলে ব্যক্তিগত পত্রে সে-সবের অবতারণা অভিনব বটে। 'বেদান্ত দর্শন' বিষয়ক সমালোচনার পর ১৪৭ নম্বর পত্রে একদিকে তাঁর বিজ্ঞান চিন্তা, অপরদিকে বৈষ্ণবসাহিত্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের গভীর তত্ত্বজ্ঞানের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। বর্ষায় জলস্থলের ভেদরেখা মুছে গেছে- ভরা পদ্মায় বোটে বসে জানালাপথে প্রকৃতির দুইরূপ দেখে কবি অভিভূত।
'আমি এই জলের দিকে চেয়ে চেয়ে অনেক সময় ভাবি- বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গতিকে যদি কেবল গতিভাবেই উপলব্ধি করতে ইচ্ছে করি, তা হলে নদীর স্রোতে সেটি পাওয়া যায়। মানুষ পশু এবং তরুলতার মধ্যে যে চলাচল তাতে খানিকটা গতি খানিকটা বিশ্রাম, একটা অংশের গতি আর-একটা অংশের নিশ্চলতা। কিন্তু নদীর আগাগোড়াই চলছে- সেই জন্যে আমাদের মনের সঙ্গে, আমাদের চেতনার সঙ্গে তার একটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আমাদের শরীর আংশিকভাবে পদচালনা ক'রে অঙ্গচালনা ক'রে চলে- আমাদের মন স্বভাবতই সমগ্রতাই চলছে।'
জাগতিক সকল বস্তুই বিপরীতের দ্বন্দ্বে গতিশীল। কবি লক্ষ্য করেন বস্তুজগতে একমাত্র নদীর স্রোতে নিরবচ্ছিন্নগতি গোচরীভূত আর মানবচেতনায়। পরবর্তীকালে মনোবিজ্ঞানে স্ট্রিম অব কনশাসনেস আবিস্কার হলে রবীন্দ্র-ভাবনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটি প্রতিষ্ঠা পায়। পদ্মার জড়সত্তা ও মানুষের জীবসত্তার সাদৃশ্য চিন্তার দ্বারা কবি এক গভীর দার্শনিক প্রত্যয়ে উপনীত হন।
'[..] এই ভাদ্র মাসের পদ্মাকে একটা প্রবল মানসশক্তির মতো বোধ হয়- সে মনের ইচ্ছার মতো ভাঙছে চুরছে এবং চলছে, মনের ইচ্ছার মতো সে আপনাকে বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গে এবং অস্টম্ফুট কলসংগীতে নানা প্রকারে প্রকাশ করবার চেষ্টা করছে। বেগবান একাগ্রগামিনী নদী আমাদের মনের ইচ্ছার মতো- আর স্থির সুবিস্তীর্ণ বিচিত্রশস্যশালিনী ভূমি আমাদের ইচ্ছার সামগ্রীর মতো।'
নদী ইচ্ছে মতো চলতে চায়, প্রতিবন্ধককে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আপনার চলার পথকে প্রশস্ত করে। চলাকে স্বচ্ছন্দ করে। সেই ভাঙাগড়াই তার চলার গতির দ্যোতক। নদী এক কূল ভাঙে আর এক কূল গড়ে। সৃজনের জন্যই ভাঙন। মানুষও প্রয়োজন এবং অপ্রয়োজনের আনন্দে মনের ইচ্ছে মতো চার পাশের জগৎকে ভেঙে প্রয়োজনীয় অবয়ব দান করে। আর মানুষের উৎপন্ন বিস্তীর্ণ ফসলভরা ভূমিকে কবি ইচ্ছার সামগ্রী নামে অভিহিত করেন। অর্থাৎ ইচ্ছার উৎপন্ন হলো শস্যভরপুর বিস্তীর্ণভূমি। এ-রচনাকে নিছক ব্যক্তিগত প্রবন্ধ বলা যায় কী করে!
ভরাপদ্মা কূল ছাপিয়ে জনপদ গুঁড়িয়ে বয়ে চলেছে। 'খুব নিবিড় প্রচুর সরস সবুজের উপর খুব ঘননীল সজল মেঘরাশি মাতৃস্নেহের মতো অবনত হয়ে রয়েছে।' এই অসাধারণ প্রকৃতিক পরিবেশে থেকে থেকে আকাশে মেঘ ডাকছে গুরু গুরু। বোটের ভিতর কবি চিত্ত অধীর হয়ে উঠছে। প্রকৃতির এই পরিবর্তন কবি মনে প্রভাব ফেলে তিনি লেখেন-
'বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ষাকালের যমুনাবর্ণনা মনে পড়ে- প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই আমার মনে বৈষ্ণবকবির ছন্দোঝংকার এনে দেয়- তার প্রধান কারণ, এই-সমস্ত সৌন্দর্য আমার কাছে শূন্য সৌন্দর্য নয় - এর মধ্যে মানব-ইতিহাসের যেন সমস্ত পুরাকালীন প্রীতিসম্মিলনগাথা পূর্ণ হয়ে রয়েছে, এর মধ্যে যেন একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্ছে, এই সৌন্দর্যের মধ্যে বৈষ্ণবকবিদের সেই অনন্ত বৃন্দাবন রয়ে গেছে।'
বৈষ্ণব মহাজন পদকর্তাদের পদে রাধার বর্ষাভিসার নানাভাবে বিচিত্ররূপে বর্ণিত হয়েছে। সেখানেই জোছনাভিসার, কৃষ্ণাভিসার শত আয়োজনে বর্ণিত। কবি বলেন, বর্ষাপ্রকৃতির নানা দৃশ্য তাঁর চেতনায় বৈষ্ণবকবির পদের ছন্দোঝংকার এনে দেয়। কারণ তিনি এই পদগুলোর সৌন্দর্যকে এক ঐতিহাসিক পৌরাণিক সত্যের পটভূমিতে অনুভব করেন। তাই বৈষ্ণবপদাবলীর সৌন্দর্য তাঁর চেতনায় কেবল 'শূন্য সৌন্দর্য' নয়। ব্যক্তি হৃদয় নয়, একটি অনন্ত হৃদয়ের অফুরন্ত লীলা চিরকিশোরকিশোরী হৃদয়ের প্রেমলীলার পটভূমিতে সম্পন্ন হয়েছে। তাই সে আখ্যান অমৃতময়- বর্ষার আকাশে মেঘের অজস্র আয়োজন দেখামাত্রই চিরন্তন প্রেমিক হৃদয়, চিরবিরহী হৃদয় আকুল হয়ে ওঠে। 'বৈষ্ণবকবিতার যথার্থ মর্মের ভিতরে প্রবেশ' না করলে প্রকৃতির ভিতরে সেই বৈষ্ণবকবিতার ধ্বনি শোনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ 'সহৃদয় হৃদয় সংবেদী'ই কেবল যথার্থ রসের সন্ধান লাভ করে থাকেন।
আমরা ছিন্নপত্রের মাত্র দুটি পত্রের পাঠানুসন্ধান করেছি, তাতে প্রতীয়মান যে, তাঁর অধীত বিদ্যা থেকে রবীন্দ্রনাথ যে-সত্য অনুভব করেছেন, তাকে দৈনন্দিন প্রাকৃতিক লীলার সঙ্গে অন্বিত করেছেন। এই দুইয়ের সংশ্নেষে সৃষ্ট সত্যকেই তিনি জ্ঞানরূপে গ্রহণ করেছেন। ছিন্নপত্রের একটি পত্রে শাহজাদপুর প্রশস্তি রয়েছে।
'আমি চিঠি পাই সন্ধ্যের সময়, আর চিঠি লিখি দুপুর বেলায়। রোজ একই কথা লিখতে ইচ্ছে করে - এখানকার এই দুপুর বেলাকার কথা। কেননা, আমি এর মোহ থেকে কিছুতেই আপনাকে ছাড়াতে পারি নে। এই আলো, এই বাতাস, এই স্তব্ধতা আমার রোমকূপের মধ্যে প্রবেশ করে আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে- এ আমার প্রতিদিনকার নতুন নেশা, এর ব্যাকুলতা আমি নিঃশেষ করে বলে উঠতে পারি নে।'
'ছিন্নপত্র' 'প্রতিদিনকার নতুন নেশার' গল্প। প্রবহমান জীবন ও জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনাবলির কথকতা। এখানে আছে অকৃত্রিমতা, কতকটা আদিমতা, অপটুত্ব, ভাঙন-গড়ন কিছু হয়ে উঠবার ব্যাকুলতা। আছে সীমাহীন অনুভব। প্রহরে প্রহরে জাগতিক রূপবদলের পালা। ছিন্নপত্র রবীন্দ্র-জীবনের এক অখণ্ড অধ্যায়।

আরও পড়ুন

×