শ্রদ্ধাঞ্জলি
ফিরে দেখা বুলবুল

বুলবুল চৌধুরী [১৬ আগস্ট ১৯৪৮-২৮ আগস্ট ২০২১], ছবি ::কামরুল মিথুন
ইমতিয়ার শামীম
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০
স্কুলে পড়তে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয়েছিল কায়েস আহমেদের সঙ্গে; তিনি তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন বইয়ের পাতায় কালো কালো অক্ষরে পল্লবিত নিঃসঙ্গতাবিনাশী নিঃশব্দ এক জগতে। বই পড়া হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের প্রথম নেশা। তারপর একদিন লিখতেও শুরু করলেন, কেননা কায়েস আহমেদের পাশে চলতে চলতে মনে হলো তাঁর, 'নিজে লেখক হতে না পারলে বুঝি কোনো লেখককে প্রকৃত বন্ধু করে পাওয়া দায়।' পরে অবশ্য সেই ধারণা ভেঙেছিল, কিন্তু সে কথা লিখে যেতেও বড় কুণ্ঠা ছিল তাঁর। মনের গভীরে দাগ কেটে বসা স্বীকারোক্তিটুকুই শুধু দিয়ে গেছেন তিনি,- যৌবনে সবচেয়ে বেশি বশ্যতা মেনেছিলেন কবি আবুল হাসান আর নির্মলেন্দু গুণের। তখনও তাঁর 'টুকা কাহিনী' বাজারে আসেনি, একদিন মৃত্যু এসে হরণ করে নিয়ে গেল আবুল হাসানকে। তবু কি আমরা চিনতে পারলাম তাঁর সেই হরণকারী 'যে তুমি'কে? এরও অনেক পরে একদিন আত্মহত্যা করলেন কায়েস আহমেদ। শৈশবের প্রথম বন্ধুকে হারানোর প্রায় তিন দশকের দিকে বুলবুল চৌধুরী নিজেও হাঁটলেন মহাপ্রস্থানের পথে।
মৃত্যুচিন্তা অবশ্য, যতদূর দেখেছি, বুলবুল চৌধুরীর গল্প-উপন্যাসকে তেমন একটা আক্রান্ত করেনি। এমনকি তাঁর নিজেকেও না। তাঁর সঙ্গে শেষ দেখায় যত কথাবার্তা হয়েছিল, তাতেও কোনো দুর্ভাবনা দেখিনি মৃত্যু নিয়ে। মৃত্যু আসতে পারে- কিন্তু জীবনের স্বপ্নই ছিল জীবন্ত। একটি সুবিধাজনক খাটে শুয়ে ছিলেন তিনি,- যাতে বন্ধু-দর্শনার্থীরা এলে সহজেই দেখা পেতে পারে। শিয়রের কাছে ছিল সাদা খাতা ও কলম। আমার আর মাহবুব রেজার কাছে বলছিলেন, কত কাজ জমে আছে, কত দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা দরকার তার। আর টাকাপয়সারও কত দরকার এখন! একজনকে খুঁজছিলেন তিনি কিছু জরুরি কাজে। মাহবুব রেজা তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলিয়ে দিলেন। করোনার সময় বলে নিজে থেকেই একটু দূরে বসে ছিলাম, দেখলাম, স্মার্ট ফোনে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে। 'বার বার ছোঁয়া লেগেই লাইন কেটে যায় মিয়া'-নিজেই সেই সমস্যাটা স্পষ্ট করে বললেন। শিয়রের কাগজপত্র দেখিয়ে বললাম, এবার আত্মজীবনীতে হাত দেন। টুকরো টুকরো আত্মস্মৃতি নিয়ে একটা বই আছে বটে তাঁর, কিন্তু বিটুইন দ্য লাইনস আরও অনেক কথাই অব্যক্ত রয়ে গেছে। আমরা জানতাম, সময় তাঁর ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু তিনি ক্লান্ত, যন্ত্রণাহত হওয়ার পরও উদ্ভাসিতই ছিলেন। বললেন, 'টুকা কাহিনী'র রিপ্রিন্টটায় ভয়ানক সব ভুল রয়েছে। সেসব ঠিক করছেন। আর হ্যাঁ, আত্মজীবনীও লিখবেন। ঘরের মধ্যে কোথায় কম্পিউটার বসাবেন, সেখানে কে কাজ করবেন, সবই জানালেন কথায় কথায়। খুব করে বলছিলেন, তাঁর 'গুরুদেব' আবু শাহ্রিয়ারের কথা-যিনি তাঁর প্রথম বই 'টুকা কাহিনী' ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি এ-ও বললেন, 'টানবেন নাকি মিয়া?' নাসরীন ভাবী দেয়ালের ছবিগুলো মোছামুছি করছিলেন, ঘুরে ক্ষিপ্ত চোখে জানালেন আমাকে, 'আপনে আর হুলায়া দিয়েন না।'
কথাবার্তা বলতে বলতে বুঝতে পারছিলাম, ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন বুলবুল চৌধুরী। মাহবুব রেজাকে ইঙ্গিত দিলাম ওঠার। আশাহত চোখে বিদায় দিলেন বুলবুল চৌধুরী, কিন্তু মানা করলেন না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে আমার মনে হলো, আমাদের আর দেখা হবে না। এই যে মনে হওয়া, তার আর অবসান ঘটেনি। তা বরং সত্য হয়েছে। অথচ কী অদ্ভুত, আমরা তো জীবনের গল্পই বলেছিলাম, এমনকি শেষ দেখাতেও, ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি মৃত্যু কোথাও ওত পেতে আছে। মৃত্যুচিন্তা থেকে বুলবুল চৌধুরী এত দূরে ছিলেন যে, এমনকি তাঁর গল্পে ও উপন্যাসেও এমন চরিত্র নেই, যাকে মৃত্যু খুব একটা আক্রান্ত করছে, যাকে মৃত্যুচিন্তা কখনও খুব তাড়িত করছে। মৃত্যু আছে বটে, কিন্তু মৃত্যুর বিষণ্ণতা নেই। কৈশোরের প্রিয় বন্ধু কায়েসের মৃত্যু, অকালে চলে যাওয়া তারুণ্যের বন্ধু আবুল হাসানের মৃত্যু তাঁকে নিশ্চয়ই ক্ষতবিক্ষত করেছে, কিন্তু সেই অন্তঃক্ষরণকেও তিনি বিভিন্ন লেখায় লুকিয়ে ফেলেছেন মাত্র কয়েকটি বাক্যের মধ্যে। খুনকে বরং অনেক উন্মত্ততায়, কখনও তমস নিষ্পৃহতায় উঠে আসতে দেখি বুলবুল চৌধুরীর গল্পে। বিখ্যাত 'টুকা কাহিনী'র কথাই না হয় বলা যাক, এই টুকা তো আসলে খুনই করতে চায় নায়েবকে- যে নাকি বিচ্ছিন্নতা এনেছে তার বাবা-মায়ের মধ্যে, যার কারণে সে বঞ্চিত মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে। দরিদ্রতা নাকি এই সংগোপন জিঘাংসা, কোনটা টুকাকে গভীর তৃপ্তি নিয়ে কুইচ্ছা মাছ খাওয়াতে শেখায়, কে এই প্রশ্নের জবাব দেবে? বুলবুলের গল্পে নিম্নবর্গের মানুষের এরকম ভয়ংকর দারিদ্র্য উঠে আসতে দেখি আমরা, কিন্তু তা দারিদ্র্যেরও অধিক, সেই দারিদ্র্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে কাম-ক্রোধ-ভালোবাসাও। কোনো মানুষই তো চায় না এই কুইচ্ছা খেতে, বরং মনে করে, এসব যে খায়, সাপ-ব্যাঙ খাওয়াও তার জন্যে 'ফরজ'। কিন্তু কীভাবে যে সেই কুইচ্ছাকে বঁটি দিয়ে কাটে টুকা... বুলবুল লেখেন, ''বঁটি দিয়ে মাথা আলগা করার সময় গলগলিয়ে রক্ত এসে তার হাত ভেজালো, মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটায় ফোঁটায়। আত্মতৃপ্তিতে টুকা গালাগাল দিল, ওই হালারা, ওই কুইচ্ছা খাইতে ঘিন করে তগো, না? ওই, তরা ঘিনে মরস? এমন লউ দেখছসনি কোনোসমে?''
তা হলে এই যে লউ, এই যে রক্ত, তা কি আসলে সেই নায়েবের, যার ওপর তীব্র সংগোপন ক্রোধ পুষে রাখে টুকা, কিন্তু পারে না খুন করতে? কিন্তু ঘিনঘিনে কুইচ্ছা মাছকে সে তীব্র সংগোপন ক্রোধে শিকার আর কাটাবাছা করতে করতে, রান্নাবান্না করে পেটের মধ্যে চালান করে দিতে দিতে পরিতৃপ্ত হয় নায়েবকে খুন করার আরাম নিয়ে? টুকার অন্তরীক্ষে এমনই তো দেখতে পাই আমরা। যেমন, গতকাল সে যে কুনো ব্যাঙটাকে দয়া করে ঘরের বাইরে ফেলে রেখে এসেছিল, আজও আবার সেটিকে জায়গামতো এসে বসতে দেখায় মনে মনে ক্ষেপে উঠবে কেন! ভাববে কেন, 'হালার ব্যাঙ, রাখছনে, তরে পাইছি, আতুরি-লুদরি দেইখা ছাড়মু আইজ।' মনে হয় বটে, কিন্তু আবার উঠে একটা লাঠি খুঁজে নেওয়ার ইচ্ছেও জাগে না। এইভাবে ক্রমেই আমরা নির্মিত হতে দেখি একটি চরিত্রকে, বিকশিত হতে, মর্ষকামী হয়ে উঠতে, ধর্ষকামী হয়ে উঠতে, আবার আত্মপীড়িত অনুতপ্ত মানুষ হয়ে জেগে উঠতে। বুলবুল চৌধুরী আমাদের দেখান, দারিদ্র্য মানুষকে মর্ষকামীও করে তোলে, এমন এক মর্ষকামী যাকে ধর্ষকামী থেকে আলাদা করা যায় না। তাই নায়েবের ঘোড়ার পেট বরাবর কোঁচ বসানোর সময় জিঘাংসায় জ্বলে ওঠা টুকার মনে পড়ে না, এই ঘোড়াই একদিন তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল নায়েবের চাবুকের আঘাত থেকে তার ওপর দিয়ে লাফিয়ে নাগালের বাইরে চলে গিয়ে। কিন্তু মৃত ঘোড়ার বাচ্চাটার সঙ্গে নিজের সাযুজ্য খুঁজে পেতে তেমন একটা সময় লাগে না তার। অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে নায়েবের লাথি খেয়ে একটুও কান্না পায় না তার।
অদ্ভুত আবার অদ্ভুতও নয়, অবাস্তব আবার অবাস্তবও নয়, নিম্নবর্গের মানুষের এমনই সব চালচিত্রে ভরা বুলবুল চৌধুরীর সাহিত্য। টুকাকে দিয়ে নিজের অস্তিত্বের ঘোষণাকারী বুলবুল চৌধুরীর গল্প-উপন্যাসের মূল শক্তি বোধকরি জলযাত্রায় মগ্ন সব পুরুষ, যারা মাছ শিকার করে ফেরে, মাছ ধরার নেশায় মগ্ন থাকে; আরেক মূল শক্তি নিম্নবর্গীয় সব নারী- যারা স্বামীর হাতে নিপীড়িত হতে হতেও বেঁচে থাকে, বেশ্যা হয়ে বেঁচে থাকে, কিন্তু জীবনের কাছে হার মানে না, বরং জীবনকে চেনাতে থাকে। মধ্যবিত্ত নারীও আছে তাঁর লেখাতে, আছে 'ফির বাসরের' বুলার মতো নারী, কিন্তু নিম্নবর্গের নারীই অনেক বেশি জীবন্ত তাঁর কলমে। মধ্যবিত্ত নিয়ে যখনই লিখতে গিয়েছেন, কোনো গল্প-উপন্যাস ফাঁদতে বসেছেন, তখনই যেন বুলবুলের কলম আড়ষ্ট হয়ে এসেছে। মধ্যবিত্ত হয়েও মধ্যবিত্ত জীবনের বাইরের এক জীবন যেন যাপন করে গেছেন তিনি।
বাস্তবের বাইরে বুলবুল চৌধুরী কিছুই লেখেননি, আর তাঁকে সেই বাস্তবতার জোগান দিয়েছে সংসারবাসী হওয়ার পরও সারাক্ষণ বয়ে বেড়ানো বোহেমিয়ান জীবন। আমরা অনেকেই নিম্নবর্গের জীবন নিয়ে লিখি বটে, কিন্তু সেই জীবনের বাস্তবতা খুঁজে পেতে চাই বই পড়ে, সৌখিন ভ্রমণ করে, উদারতাবশত নিজের ঘরের কামলা-জামলা কিংবা রিকশাওয়ালাদের অসমাপ্ত জবানবন্দি শোনে। কিন্তু বুলবুল চৌধুরী তাদের থেকে আলাদা; তিনি তাদের জীবনযাপন থেকেই বাস্তবতাকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত করে অভিজ্ঞান খুঁজে পেতে চেয়েছেন। নিজের জীবনযাপন নিয়ে যে সরল স্বীকারোক্তি তিনি তাঁর সঙ্গে মেশা মানুষজনের কাছে করে গেছেন, 'অতলের কথকতা'তেও প্রসঙ্গত লিখে গেছেন, তেমন সরল স্বীকারোক্তি আমরা আমাদের কোনো কথাসাহিত্যিকের আত্মকথনেই খুঁজে পাই না। বুলবুল চৌধুরী আমাদের কথাসাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযাপনের চিত্রকে ঋদ্ধ করে গেছেন, যা অধ্যাপকসুলভ নয়, যাতে কোনো মাস্টারি নেই, যাতে মিশে নেই নিম্নবর্গকে দেখার করপোরেট দৃষ্টিভঙ্গি।
'এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে' উপন্যাসটি কীভাবে লেখা হলো, সে কথা জানাতে গিয়ে বুলবুল চৌধুরী লিখেছিলেন, 'লেখালেখিতে আগে চাই বিষয়। ভাবনার আধারে সেটুকু সেজে উঠলে আসে নির্মাণের পালা। এই ধারায় কিছু রচতে বসে আমি আনন্দ-বিস্ময়ে একাকার হই বটে। পাশে পাশে আশা করি, কালের আয়নায় স্থায়ী ছাপ ফেলবার মতো রচনাই হয়ে উঠবে এটি। তারপর হয় কি, ছাপার হরফে লেখাটা পড়তে গিয়ে বেশ চুপসে যাই। ভাবি, আচ্ছা, বিষয়টা অক্ষরের বাঁধনে বাঁধতে গিয়ে যেমনটা আকাঙ্ক্ষা ধরেছিলাম, মিলল কি অতখানি?' কিন্তু বুলবুল চৌধুরী যতই চুপসে যান না কেন, যতই অতৃপ্ত থাকুন না কেন, নদীমাতৃক এই জনপদের গ্রামীণ কাঠামোকে চিনতে, নিম্নবর্গের মানুষগুলোকে চিনতে আমাদের বার বার বুলবুল চৌধুরীর কাছে ফিরে আসতে হবে।
মৃত্যুচিন্তা অবশ্য, যতদূর দেখেছি, বুলবুল চৌধুরীর গল্প-উপন্যাসকে তেমন একটা আক্রান্ত করেনি। এমনকি তাঁর নিজেকেও না। তাঁর সঙ্গে শেষ দেখায় যত কথাবার্তা হয়েছিল, তাতেও কোনো দুর্ভাবনা দেখিনি মৃত্যু নিয়ে। মৃত্যু আসতে পারে- কিন্তু জীবনের স্বপ্নই ছিল জীবন্ত। একটি সুবিধাজনক খাটে শুয়ে ছিলেন তিনি,- যাতে বন্ধু-দর্শনার্থীরা এলে সহজেই দেখা পেতে পারে। শিয়রের কাছে ছিল সাদা খাতা ও কলম। আমার আর মাহবুব রেজার কাছে বলছিলেন, কত কাজ জমে আছে, কত দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা দরকার তার। আর টাকাপয়সারও কত দরকার এখন! একজনকে খুঁজছিলেন তিনি কিছু জরুরি কাজে। মাহবুব রেজা তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলিয়ে দিলেন। করোনার সময় বলে নিজে থেকেই একটু দূরে বসে ছিলাম, দেখলাম, স্মার্ট ফোনে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে। 'বার বার ছোঁয়া লেগেই লাইন কেটে যায় মিয়া'-নিজেই সেই সমস্যাটা স্পষ্ট করে বললেন। শিয়রের কাগজপত্র দেখিয়ে বললাম, এবার আত্মজীবনীতে হাত দেন। টুকরো টুকরো আত্মস্মৃতি নিয়ে একটা বই আছে বটে তাঁর, কিন্তু বিটুইন দ্য লাইনস আরও অনেক কথাই অব্যক্ত রয়ে গেছে। আমরা জানতাম, সময় তাঁর ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু তিনি ক্লান্ত, যন্ত্রণাহত হওয়ার পরও উদ্ভাসিতই ছিলেন। বললেন, 'টুকা কাহিনী'র রিপ্রিন্টটায় ভয়ানক সব ভুল রয়েছে। সেসব ঠিক করছেন। আর হ্যাঁ, আত্মজীবনীও লিখবেন। ঘরের মধ্যে কোথায় কম্পিউটার বসাবেন, সেখানে কে কাজ করবেন, সবই জানালেন কথায় কথায়। খুব করে বলছিলেন, তাঁর 'গুরুদেব' আবু শাহ্রিয়ারের কথা-যিনি তাঁর প্রথম বই 'টুকা কাহিনী' ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি এ-ও বললেন, 'টানবেন নাকি মিয়া?' নাসরীন ভাবী দেয়ালের ছবিগুলো মোছামুছি করছিলেন, ঘুরে ক্ষিপ্ত চোখে জানালেন আমাকে, 'আপনে আর হুলায়া দিয়েন না।'
কথাবার্তা বলতে বলতে বুঝতে পারছিলাম, ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন বুলবুল চৌধুরী। মাহবুব রেজাকে ইঙ্গিত দিলাম ওঠার। আশাহত চোখে বিদায় দিলেন বুলবুল চৌধুরী, কিন্তু মানা করলেন না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে আমার মনে হলো, আমাদের আর দেখা হবে না। এই যে মনে হওয়া, তার আর অবসান ঘটেনি। তা বরং সত্য হয়েছে। অথচ কী অদ্ভুত, আমরা তো জীবনের গল্পই বলেছিলাম, এমনকি শেষ দেখাতেও, ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি মৃত্যু কোথাও ওত পেতে আছে। মৃত্যুচিন্তা থেকে বুলবুল চৌধুরী এত দূরে ছিলেন যে, এমনকি তাঁর গল্পে ও উপন্যাসেও এমন চরিত্র নেই, যাকে মৃত্যু খুব একটা আক্রান্ত করছে, যাকে মৃত্যুচিন্তা কখনও খুব তাড়িত করছে। মৃত্যু আছে বটে, কিন্তু মৃত্যুর বিষণ্ণতা নেই। কৈশোরের প্রিয় বন্ধু কায়েসের মৃত্যু, অকালে চলে যাওয়া তারুণ্যের বন্ধু আবুল হাসানের মৃত্যু তাঁকে নিশ্চয়ই ক্ষতবিক্ষত করেছে, কিন্তু সেই অন্তঃক্ষরণকেও তিনি বিভিন্ন লেখায় লুকিয়ে ফেলেছেন মাত্র কয়েকটি বাক্যের মধ্যে। খুনকে বরং অনেক উন্মত্ততায়, কখনও তমস নিষ্পৃহতায় উঠে আসতে দেখি বুলবুল চৌধুরীর গল্পে। বিখ্যাত 'টুকা কাহিনী'র কথাই না হয় বলা যাক, এই টুকা তো আসলে খুনই করতে চায় নায়েবকে- যে নাকি বিচ্ছিন্নতা এনেছে তার বাবা-মায়ের মধ্যে, যার কারণে সে বঞ্চিত মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে। দরিদ্রতা নাকি এই সংগোপন জিঘাংসা, কোনটা টুকাকে গভীর তৃপ্তি নিয়ে কুইচ্ছা মাছ খাওয়াতে শেখায়, কে এই প্রশ্নের জবাব দেবে? বুলবুলের গল্পে নিম্নবর্গের মানুষের এরকম ভয়ংকর দারিদ্র্য উঠে আসতে দেখি আমরা, কিন্তু তা দারিদ্র্যেরও অধিক, সেই দারিদ্র্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে কাম-ক্রোধ-ভালোবাসাও। কোনো মানুষই তো চায় না এই কুইচ্ছা খেতে, বরং মনে করে, এসব যে খায়, সাপ-ব্যাঙ খাওয়াও তার জন্যে 'ফরজ'। কিন্তু কীভাবে যে সেই কুইচ্ছাকে বঁটি দিয়ে কাটে টুকা... বুলবুল লেখেন, ''বঁটি দিয়ে মাথা আলগা করার সময় গলগলিয়ে রক্ত এসে তার হাত ভেজালো, মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটায় ফোঁটায়। আত্মতৃপ্তিতে টুকা গালাগাল দিল, ওই হালারা, ওই কুইচ্ছা খাইতে ঘিন করে তগো, না? ওই, তরা ঘিনে মরস? এমন লউ দেখছসনি কোনোসমে?''
তা হলে এই যে লউ, এই যে রক্ত, তা কি আসলে সেই নায়েবের, যার ওপর তীব্র সংগোপন ক্রোধ পুষে রাখে টুকা, কিন্তু পারে না খুন করতে? কিন্তু ঘিনঘিনে কুইচ্ছা মাছকে সে তীব্র সংগোপন ক্রোধে শিকার আর কাটাবাছা করতে করতে, রান্নাবান্না করে পেটের মধ্যে চালান করে দিতে দিতে পরিতৃপ্ত হয় নায়েবকে খুন করার আরাম নিয়ে? টুকার অন্তরীক্ষে এমনই তো দেখতে পাই আমরা। যেমন, গতকাল সে যে কুনো ব্যাঙটাকে দয়া করে ঘরের বাইরে ফেলে রেখে এসেছিল, আজও আবার সেটিকে জায়গামতো এসে বসতে দেখায় মনে মনে ক্ষেপে উঠবে কেন! ভাববে কেন, 'হালার ব্যাঙ, রাখছনে, তরে পাইছি, আতুরি-লুদরি দেইখা ছাড়মু আইজ।' মনে হয় বটে, কিন্তু আবার উঠে একটা লাঠি খুঁজে নেওয়ার ইচ্ছেও জাগে না। এইভাবে ক্রমেই আমরা নির্মিত হতে দেখি একটি চরিত্রকে, বিকশিত হতে, মর্ষকামী হয়ে উঠতে, ধর্ষকামী হয়ে উঠতে, আবার আত্মপীড়িত অনুতপ্ত মানুষ হয়ে জেগে উঠতে। বুলবুল চৌধুরী আমাদের দেখান, দারিদ্র্য মানুষকে মর্ষকামীও করে তোলে, এমন এক মর্ষকামী যাকে ধর্ষকামী থেকে আলাদা করা যায় না। তাই নায়েবের ঘোড়ার পেট বরাবর কোঁচ বসানোর সময় জিঘাংসায় জ্বলে ওঠা টুকার মনে পড়ে না, এই ঘোড়াই একদিন তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল নায়েবের চাবুকের আঘাত থেকে তার ওপর দিয়ে লাফিয়ে নাগালের বাইরে চলে গিয়ে। কিন্তু মৃত ঘোড়ার বাচ্চাটার সঙ্গে নিজের সাযুজ্য খুঁজে পেতে তেমন একটা সময় লাগে না তার। অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে নায়েবের লাথি খেয়ে একটুও কান্না পায় না তার।
অদ্ভুত আবার অদ্ভুতও নয়, অবাস্তব আবার অবাস্তবও নয়, নিম্নবর্গের মানুষের এমনই সব চালচিত্রে ভরা বুলবুল চৌধুরীর সাহিত্য। টুকাকে দিয়ে নিজের অস্তিত্বের ঘোষণাকারী বুলবুল চৌধুরীর গল্প-উপন্যাসের মূল শক্তি বোধকরি জলযাত্রায় মগ্ন সব পুরুষ, যারা মাছ শিকার করে ফেরে, মাছ ধরার নেশায় মগ্ন থাকে; আরেক মূল শক্তি নিম্নবর্গীয় সব নারী- যারা স্বামীর হাতে নিপীড়িত হতে হতেও বেঁচে থাকে, বেশ্যা হয়ে বেঁচে থাকে, কিন্তু জীবনের কাছে হার মানে না, বরং জীবনকে চেনাতে থাকে। মধ্যবিত্ত নারীও আছে তাঁর লেখাতে, আছে 'ফির বাসরের' বুলার মতো নারী, কিন্তু নিম্নবর্গের নারীই অনেক বেশি জীবন্ত তাঁর কলমে। মধ্যবিত্ত নিয়ে যখনই লিখতে গিয়েছেন, কোনো গল্প-উপন্যাস ফাঁদতে বসেছেন, তখনই যেন বুলবুলের কলম আড়ষ্ট হয়ে এসেছে। মধ্যবিত্ত হয়েও মধ্যবিত্ত জীবনের বাইরের এক জীবন যেন যাপন করে গেছেন তিনি।
বাস্তবের বাইরে বুলবুল চৌধুরী কিছুই লেখেননি, আর তাঁকে সেই বাস্তবতার জোগান দিয়েছে সংসারবাসী হওয়ার পরও সারাক্ষণ বয়ে বেড়ানো বোহেমিয়ান জীবন। আমরা অনেকেই নিম্নবর্গের জীবন নিয়ে লিখি বটে, কিন্তু সেই জীবনের বাস্তবতা খুঁজে পেতে চাই বই পড়ে, সৌখিন ভ্রমণ করে, উদারতাবশত নিজের ঘরের কামলা-জামলা কিংবা রিকশাওয়ালাদের অসমাপ্ত জবানবন্দি শোনে। কিন্তু বুলবুল চৌধুরী তাদের থেকে আলাদা; তিনি তাদের জীবনযাপন থেকেই বাস্তবতাকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত করে অভিজ্ঞান খুঁজে পেতে চেয়েছেন। নিজের জীবনযাপন নিয়ে যে সরল স্বীকারোক্তি তিনি তাঁর সঙ্গে মেশা মানুষজনের কাছে করে গেছেন, 'অতলের কথকতা'তেও প্রসঙ্গত লিখে গেছেন, তেমন সরল স্বীকারোক্তি আমরা আমাদের কোনো কথাসাহিত্যিকের আত্মকথনেই খুঁজে পাই না। বুলবুল চৌধুরী আমাদের কথাসাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযাপনের চিত্রকে ঋদ্ধ করে গেছেন, যা অধ্যাপকসুলভ নয়, যাতে কোনো মাস্টারি নেই, যাতে মিশে নেই নিম্নবর্গকে দেখার করপোরেট দৃষ্টিভঙ্গি।
'এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে' উপন্যাসটি কীভাবে লেখা হলো, সে কথা জানাতে গিয়ে বুলবুল চৌধুরী লিখেছিলেন, 'লেখালেখিতে আগে চাই বিষয়। ভাবনার আধারে সেটুকু সেজে উঠলে আসে নির্মাণের পালা। এই ধারায় কিছু রচতে বসে আমি আনন্দ-বিস্ময়ে একাকার হই বটে। পাশে পাশে আশা করি, কালের আয়নায় স্থায়ী ছাপ ফেলবার মতো রচনাই হয়ে উঠবে এটি। তারপর হয় কি, ছাপার হরফে লেখাটা পড়তে গিয়ে বেশ চুপসে যাই। ভাবি, আচ্ছা, বিষয়টা অক্ষরের বাঁধনে বাঁধতে গিয়ে যেমনটা আকাঙ্ক্ষা ধরেছিলাম, মিলল কি অতখানি?' কিন্তু বুলবুল চৌধুরী যতই চুপসে যান না কেন, যতই অতৃপ্ত থাকুন না কেন, নদীমাতৃক এই জনপদের গ্রামীণ কাঠামোকে চিনতে, নিম্নবর্গের মানুষগুলোকে চিনতে আমাদের বার বার বুলবুল চৌধুরীর কাছে ফিরে আসতে হবে।
- বিষয় :
- শ্রদ্ধাঞ্জলি
- ইমতিয়ার শামীম
- বুলবুল চৌধুরী