ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বইয়ের ভুবন

ইতিহাসের পথরেখায় চিলমারী

ইতিহাসের পথরেখায় চিলমারী

মনন রেখা চিলমারী বন্দর, সম্পাদক-মিজানুর রহমান নাসিম, প্রচ্ছদ-আল নোমান, দাম-৩০০ টাকা

গোলাম কিবরিয়া

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এক গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগকেন্দ্র ছিল চিলমারী। সেই বন্দর-চিলমারীকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। বাংলার নদ-নদীর তীরে তীরে আরও যেসব চিলমারী ছিল সেসবও এখন প্রায় বিলীন। কিন্তু চিলমারীর মতো বন্দরগুলোকে ঘিরে যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরম্পরা রয়েছে সেটাই হতে পারত আমাদের ইতিহাসচর্চার প্রধান এক ধারা। মিজানুর রহমান নাসিম সম্পাদিত মনন রেখার 'চিলমারী বন্দর' সংখ্যা ইতিহাসচর্চার ভালো নজির রেখেছে। 'হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে'- এই ভাওয়াইয়া গান সকলেরই কম বেশি শোনা। বন্দরের কারণে সবাই না চিনলেও এই গানের কারণে কুড়িগ্রাম জেলার উপজেলা চিলমারী কে না চেনে? এক সময় এই বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। বাংলার আটটি বৃহৎ নদীবন্দরের অন্যতম ছিল চিলমারী বন্দর। এ চিলমারী বন্দরসংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ব্রিটিশ আমলে বড় বড় জাহাজ চলাচল করত, পণ্যবোঝাই জাহাজ নোঙর করত। ভারতের কোচবিহার, আসাম, মেঘালয় এবং চীন ও মিয়ানমার থেকে আসত এসব পণ্যবাহী জাহাজ। আসাম ও কলকাতা রুটের মাঝে দাঁড়িয়ে এ চিলমারী বন্দর। একসময় পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল চিলমারী বন্দর। পাট কেনাবেচা, প্রসেসিং, দেশি-বিদেশি জাহাজের আসা-যাওয়া, দেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ী ও পাইকারদের আনাগোনায় মুখর ছিল এ বন্দর রাত-দিন। চিলমারী বন্দরে পাটের কারবার শুরু হয় তিরিশের দশকে। ব্রহ্মপুত্রের কোলঘেঁষে কয়েক কিলোমিটারব্যাপী ছিল বন্দরের অবস্থান। প্রশাসনিক ভবন, কাস্টমস অফিস, পাটের গোডাউন। জুট ট্রেডিং কোম্পানিসহ প্রায় ৩০টি পাটকল ও কোম্পানি এখানে কারবার জুড়ে বসে। স্থাপন করে বিশাল বিশাল পাটগুদাম। পাট প্রসেসিং ও বেল তৈরির মেশিন স্থাপিত হয়। পাট ক্রয়, বাছাই ও বেল তৈরির কাজে অনেক শ্রমিক এখানে কাজ করতেন প্রতিদিন। এর বাইরে শত শত বেপারি, কৃষক, ফড়িয়াদের আগমন হতো এখানে। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার গরুর গাড়ির মাধ্যমে দূরদূরান্ত থেকে পাট এনে নারায়ণগঞ্জ, দৌলতপুর, খুলনা, চট্টগ্রামসহ নানা এলাকায় সরবরাহ করা হতো। বিদেশেও রপ্তানি করা হতো উন্নত মানের পাট। সে সময়ে আসামের সঙ্গে ফেরি সার্ভিস চালু ছিল। বলা চলে, বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ ও পরিবহনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চিলমারী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কুড়িগ্রাম বা চিলমারীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। চিলমারীর দুঃখ কম নয়। ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে এই বন্দর অবস্থিত। নদীভাঙনের ফলে চিলমারী বন্দরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চিলমারী দীর্ঘদিন ধরে গরু-মহিষের জন্য বিখ্যাত। একটি ছোট ইউনিয়ন হওয়া সত্ত্বেও এখানে গরু-মহিষের সংখ্যা বেশি। চাষাবাদ ছাড়াও যানবাহনের প্রধান মাধ্যম এখানে গরু-মহিষ। দশ বছর আগেও গরুর গাড়ি ছিল চিলমারীর প্রধান যানবাহন। যে কোনো মালপত্র টানা, নতুন বউয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া সব কাজই চলত গরুর গাড়িতে। এখন গরুর গাড়ি কমে গেছে, পাশাপাশি এসেছে বাস, কোস্টার, টেম্পো, ভ্যানগাড়ি ও রিকশা। কিন্তু চর এলাকায় যেতে হলে একমাত্র অবলম্বন নৌকা। চিলমারী বন্দরে ইঞ্জিনচালিত ভাড়া নৌকা সবসময় পাওয়া যায়। চিলমারী নদীবন্দর ঐতিহ্যের ধারক, উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা, আন্তঃসীমানা সহযোগিতার অংশ। বিশ্বের সব জায়গায় ইতিহাসচর্চার নানান ধারা ও পদ্ধতি আছে। প্রধান একটা ধারা হিসেবে রাজত্ব করছে শাসকদের জয়-পরাজয়ের ইতিহাস। তার বিপরীতে সাধারণ মানুষ, তাদের জীবন-জীবিকা এবং প্রাণ-প্রকৃতিকে মনোযোগের কেন্দ্রে রেখে ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজও বড় কম নয়। আর সেদিক থেকে 'মনন রেখা' একটি বড় পদক্ষেপ বলাই যায়।
চিলমারীর ভূ-প্রকৃতি থেকে খাদ্যাভাস পর্যন্ত ৪৩২ পৃষ্ঠার অসামান্য এই সংকলন আমাদের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ এক সম্পদ হয়ে গেল। এতে চরের কৃষাণীর মিষ্টিকুমড়া চাষের গল্প যেমন আছে, তেমনি আছে চিলমারী নিয়ে নন্দিতা বাগচীর উপন্যাসের কথাও। আসাম, পূর্ববাংলা আর ব্রহ্মপুত্রপাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি বুঝতে চিলমারীকে জানা প্রয়োজন। বিভিন্ন লেখকের লেখায় 'মনন রেখা' চিলমারী বন্দর সংখ্যা চিলমারীবিষয়ক অসামান্য এক দলিল। মিজানুর রহমান নাসিমের 'মনন রেখা' বাংলা প্রকাশনার অতুলনীয় এ কাজটি সব প্রজন্মের জন্যে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

আরও পড়ুন

×