ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ

ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ

ঢেউয়ের ধাক্কায় অংশগুলোর মধ্যে সঞ্চালনের ফলে শক্তি সৃষ্টি হয়

হিল্লোল চৌধুরী

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪ | ০১:৩১ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ | ১৬:২৭

জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ও যুদ্ধবিগ্রহের চাপে বর্তমানে বিকল্প জ্বালানির সন্ধান বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ ও জোয়ারভাটার শক্তি কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে নানা গবেষণা চলছে। ১৯৭৪ সালে স্কটল্যান্ডের এক অধ্যাপক এমন এক উদ্ভাবন করেছিলেন, যা জ্বালানি ব্যবহারের ইতিহাস বদলে দিতে পারত। সেই যন্ত্রের নাম ‘এডিনবরা ডাক’। অদ্ভুত নাম হলেও ভালো করে নজর দিলে নামের উৎস আন্দাজ করা যায়। হাঁসের শরীরের পেছনের অংশ ঢেউয়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দূষণহীন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ও ব্রিটিশ সরকার এই উদ্ভাবন সম্পর্কে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিল। কারণ, এমন আইডিয়ার পেছনে বিশাল সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। অনেক জায়গাতেই ঢেউ দেখা যায়, যেখানে বিশাল শক্তি জমা রয়েছে।
হাঁসটি সারফেস অ্যাটেনুয়েটারের মতো কাজ করে। ১৯৭৩ সালের পেট্রোলিয়াম সংকটের ফলে অভাব মেটাতেই সেটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগেই পরমাণু বিদ্যুৎ জনমানসে বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছিল। হাঁসটি সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত সেই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। 
ঢেউয়ের প্রতিটি কণা কিন্তু মহাসাগর অতিক্রম করে না, বরং বাতাসের ধাক্কায় প্রায় একই জায়গায় চক্রাকারে নড়াচড়া করে। এর ফলে যে শক্তি সৃষ্টি হয়, সেটি পরের কণায় স্থানান্তরিত হয়। ঢেউয়ের উপরিভাগে সবচেয়ে শক্তিশালী সঞ্চালন ঘটে। গভীরতা বাড়লে সেই শক্তি কমতে থাকে। ।
ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ
ঢেউ থেকে জ্বালানি উৎপাদন করার একাধিক উপায় রয়েছে। যেমন পয়েন্ট অ্যাবজর্বার ব্যবহার করা যায়। সেটি পানির ওপর ভাসে এবং সব দিক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। সমুদ্রের নিচের মাটিতে নোঙর করা থাকে বলে নড়চড় হয় না। বয়া ও স্থায়ী অংশের মধ্যে সঞ্চালনের ফলে ভেতরের পিস্টন একটি জেনারেটর চালায়। সারফেস অ্যাটেনুয়েটারও কাজে লাগানো যেতে পারে। একাধিক অংশ নিয়ে তৈরি এই যন্ত্র ঢেউয়ের মুখে খাড়া হয়ে থাকে। ঢেউয়ের ধাক্কায় অংশগুলোর মধ্যে সঞ্চালনের ফলে শক্তি সৃষ্টি হয়। অসিলেটিং ওয়াটার কলাম বা স্তম্ভও সেই কাজ করে। ফাঁপা এই যন্ত্রের কিছু অংশ পানির নিচে থাকে। প্রতিটি ঢেউ ভেতরের বাতাস চেপে ধরে; যার ফলে এক টার্বাইন ঘুরতে থাকে। আজও সত্তরের দশকের মতো জ্বালানি সংকট দেখা যাচ্ছে। কার্বন নির্গমন শূন্যে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। অথচ বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে সেই চাহিদা আনুমানিক ৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
এমনই প্রেক্ষাপটে জোয়ারভাটা ও ঢেউ থেকে জ্বালানি উৎপাদন আবার গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ শীতকালের অন্ধকার দিনগুলোয় সূর্য না দেখা গেলে এবং বাতাস না বইলে জ্বালানির বিকল্প উৎসের প্রয়োজন হবে।
ঢেউ সম্পর্কে শুধু আগাম আভাস পাওয়া যায় না; সারা বছর ঢেউ নির্ভরযোগ্যভাবে সমুদ্রে গতি আনে। উইন্ড টার্বাইনের তুলনায় ওয়েভ এনার্জি প্লান্ট আরও অনেক গুণ বেশি জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। বাতাসের তুলনায় পানির ঘনত্ব কয়েকশ’ গুণ হওয়ায় এমনটা ঘটে।
২০২১ সালে ইউরোপে তার আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি ঢেউচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো জোয়ারভাটা ও ঢেউয়ের শক্তির পেছনে প্রায় সাত কোটি ইউরো বিনিয়োগ করেছে। কাগজে-কলমে ঢেউয়ের শক্তির পরিমাণ বিশ্বব্যাপী চাহিদার প্রায় তিনগুণ বেশি। বাস্তবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত এর অনুপাত প্রায় ১০ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বর্তমানে ঢেউয়ের শক্তি কাজে লাগানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্লান্টটি স্কটল্যান্ডে চালু হয়েছে। প্রবল বাতাস, বিশাল ঢেউ ও ওয়েভ এনার্জি নিয়ে গবেষণার এমন দীর্ঘ ঐতিহ্য অন্য কোথাও দেখা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুশক্তির তুলনায় ঢেউয়ের শক্তি এখনও প্রায় ২০ বছর পিছিয়ে রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বায়ু বা সৌরশক্তিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। কিন্তু অফশোর প্ল্যাটফর্মের মতো বিশেষ কিছু বাজারের জন্য এই উৎস আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। নির্গমনহীন জ্বালানির পথে ঢেউচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ভালো সমাধান সূত্র হতে পারে। সেই লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কর্মক্ষমতা ও ব্যয়ের নিরিখে বর্তমানে ওয়েভ এনার্জি অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে ভবিষ্যতের ‘এনার্জি মিক্স’-এর অংশ হিসেবে এই উৎস অনেক সুবিধা বয়ে আনতে পারে। v
সূত্র : ডয়চে ভেলে
 

আরও পড়ুন

×