‘প্রত্যেক মানুষের মুখচ্ছবিই একেকটা গল্প’

নাসির আলী মামুন [জন্ম: ১ জুলাই ১৯৫৩] ছবি: লেখক
সাইফুল আমিন কাজল
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫ | ০০:১৭ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ | ১৩:০৯
নাসির আলী মামুন, আমাদের দেশের আলোকচিত্র শিল্পের একজন ‘ব্র্যান্ড’। আমাদের গর্ব। মূলত তাঁর হাত ধরেই দেশে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার মানুষের লক্ষাধিক ছবি তুলেছেন তিনি। দেশে-বিদেশে তার ৫০টির বেশি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাশ্চাত্যে যেমন ইউসুফ কার্শ বা রিচার্ড এভেডনরা পোর্ট্রেইট শিল্পের ‘ব্র্যান্ড’; তেমনি আমাদের দেশে তথা এই উপমহাদেশে নাসির আলী মামুন তেমনই একজন। এই পথিকৃতের মতে, ‘প্রত্যেক মানুষের মুখচ্ছবিই একেকটা গল্প।’
কবি শামসুর রাহমান তাঁকে ‘ক্যামেরার কবি’ উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি নাসির আলী মামুনকে বিশ্বের সেরা আলোকচিত্রীদের একজন মনে করতেন। চিত্রশিল্পী সুলতান বলেছিলেন, ‘নাসির আলী মামুন ছাড়া অন্য কেউ আমাকে তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করতে পারবে না।’
নাসির আলী মামুনের সব কাজের মধ্যে অন্যতম ‘লালমিয়া’ মানে শিল্পী সুলতান। অনেক বছর ধরে তাঁর ছবি তুলেছেন। অন্য কেউ এই কাজটি করতে পারেননি। এত কাছ থেকে সুলতানকে কেউ ক্যামেরায় বন্দি করতে পারেননি। সুলতান বাদে আর যাদের নিয়ে লম্বা সময় কাজ করেছেন তারা হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও কবি শামসুর রাহমান। আমেরিকায় গিন্সবার্গের ছবি তুলেছেন টানা পাঁচ বছর ধরে।
গত বছর প্রবাসী ফিল্মমেকার মকবুল চৌধুরী তাঁকে নিয়ে ‘ছায়াবন্দনা’ তথ্যচিত্রের প্রিমিয়ার শো করেন শিল্পকলায়। এটি ছিল দেশের কোনো আলোকচিত্রীকে নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র। নাসির আলী মামুনের সাক্ষাৎকারধর্মী বই ‘আলো ছায়ার নাসির আলী মামুন’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুনেম ওয়াসিফ। সেটিও ছিল কোনো আলোকচিত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত প্রথম বই। আমরা জানি, তিনি কেবল বিখ্যাত মানুষের অবয়ব তোলেন, তা কিন্তু নয়। তিনি আড়াই শতাধিক বিষয় নিয়ে ছবি তুলেছেন; যার অধিকাংশ অপ্রকাশিত। বাংলাদেশের আলোকচিত্র নিয়ে প্রচুর চিন্তাভাবনা করেন এই বরেণ্য আলোকচিত্রী। শিল্পকলায় ‘আলোকচিত্র বিভাগ’ ও সরকারিভাবে জাতীয় আর্কাইভ করার দাবি নিয়ে অনেকবার কথা বলেছেন মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেন তিনি অতি দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর ‘ঘর নাই’ সাক্ষাৎকারমূলক বইটি শহরের ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে, যাদের ‘হোমলেস’ বলে। এই ধরনের কাজও আর কেউ করেনি।
তরুণদের সবসময় উদ্দীপ্ত করেন এই বরেণ্য আলোকচিত্রী। ২০১৭ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি ফটোগ্রাফি প্রদর্শনীতে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের ফটোগ্রাফি শিখতে কোনো গুরু বা কোথাও প্রশিক্ষণ নেওয়ার দরকার নেই, ইউটিউব আর গুগল থাকলে আর কিছু লাগে না।’ এই কথা তিনি আগে ও পরে আরও অনেক জায়গায় বলেছেন। আমার মতো অনেকেরই হয়তো মনে গেঁথে গিয়েছিল।
তাঁর আরেকটি গুণ, যা অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণা দেয় তা হলো– ৭২ বছর বয়সেও তিনি থেমে নেই, এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ধরে রাখতে যেভাবে তিনি অবদান রেখে যাচ্ছেন তার জন্য এই জাতি তাঁকে স্মরণ করবে আরও শত শত বছর ধরে। তবে তাঁর স্বপ্নের ‘ফটোজিয়াম’ স্বপ্নই রয়ে গেল আজও। ৫৩ বছর ধরে মানুষের অবয়ব তিনি তুলেছেন, জাতির জন্য এটি এক ‘অমূল্য’ সম্পদ।
প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ড. নওয়াজেশ আহমেদ তাঁর কাজকে ইউসুফ কার্শ-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর প্রিয় শিল্পীর তালিকায় আছেন কার্শ, এভেডন, এনি লেইবোভিজ, রবার্ট ম্যাপেলথর্প। প্রথম তিনজনের সঙ্গেই তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে আমেরিকায়।
অনেক সংগ্রাম, আর্থিক সংকট, বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে তিনি তাঁর প্রিয় কাজটি করে যাচ্ছেন। এই বিপুল সংগ্রহ সংরক্ষণের জন্য ‘ফটোজিয়াম’ নামে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। জীবনের এই পরিণত সময়ে এসে তিনি মনে করেন, যে কাজ করে গেছেন গত পাঁচ দশক ধরে, তার মধ্য দিয়ে তাঁকে স্মরণ করবে মানুষ। নাসির আলী মামুন বলেন, ‘জীবনে কিছু দুঃখবোধ আছে। তবে এ জীবনে অসন্তুষ্ট নই। জীবন একদিন শেষ হবে। এই উপলব্ধি আনন্দ দেয় যে, ক্ষুদ্র জীবনে কিছু অন্তত করে যেতে পেরেছি।’