ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

দুঃসহ সেই ৩২ দিন ভুলতে চান তারা

অপহৃত নাবিকদের ফেরার অপেক্ষা

দুঃসহ সেই ৩২ দিন ভুলতে চান তারা

জাহাজ

সারোয়ার সুমন

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:৩১

‘দুসংবাদটা আসে রমজানের প্রথম দিনেই। জলদস্যুরা জিম্মি করেছে ছেলেকে– এমন খবর শুনে মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। আমাদের পুরো জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। মাটি হয়ে যায় ঈদের আনন্দও। কেউ নতুন পোশাক পরেনি। ছেলে ফিরলে সেদিনই ঈদ হবে আমাদের। সেদিন ভুলে যাব সব দুঃখ। ভুলে যেতে চাইব সেই ৩২ দিনের দুঃসহ স্মৃতিও’– এক নিঃশ্বাসে মনের কথা এভাবেই বলেন শাহনুর আক্তার। তিনি জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া নাবিক আতিকুল্লাহ খানের মা। আতিকুল্লাহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা।

শুধু শাহনুর আক্তার নন; দুঃসহ সেই স্মৃতি ভুলতে চান এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাইদুজ্জামান সাঈদের বাবা আবদুল কাইয়ুমও। তিনি বলেন, ‘সোমালি জলদস্যুদের হাতে সাইদুজ্জামানের আটকের খবরের পর দিনগুলো যেন বিভীষিকাময় কেটেছে। এর মধ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতর চলে এলেও ঈদের খুশি ছিল না পরিবারে। ছেলের মুক্তির খবর শোনার পর আমাদের পরিবারে স্বস্তি এসেছে।’ সাইদুজ্জামান সাঈদের স্ত্রী মান্না তাহরিন বলেন, ‘আমাদের বুকের ওপর যে পাথর চেপে ছিল, সেটি নেমে গেছে। এই খবর শোনার পর ঈদের আনন্দ আমরা যেন নতুন করে উপভোগ করছি। সে যেদিন ফিরবে সেদিনই ঈদ হবে আমাদের ঘরে।’

রুদ্ধশ্বাস ৩২ দিন 
গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটি তখন সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। জাহাজে ছিলেন ২৩ জন নাবিক। তারা সবাই বাংলাদেশি। মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিল জাহাজটি। অস্ত্রের মুখে জাহাজ ছিনিয়ে নিয়ে নাবিকদের জিম্মি করে জলদস্যুরা জাহাজটি নিয়ে যায় সোমালিয়া উপকূলের দিকে। জলদস্যুরা জাহাজটিকে সোমালিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পান্টল্যান্ড রাজ্যের জিফল উপকূলে নিয়ে যায়। তীর থেকে মাত্র দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে জাহাজটি নোঙর করা হয়। সেখানেই ৩২ দিন জিম্মি করে রাখা হয় নাবিকদের। এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা পরিবারের কাছে পাঠানো অডিও বার্তায় জানান, মুক্তিপণ না দিলে জলদস্যুরা তাদের এক এক করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। এরপর উৎকণ্ঠায় পড়েন জিম্মিদের স্বজনরা। এমভি আবদুল্লাহ ও নাবিকদের জিম্মি করার ৯ দিনের মাথায় ২০ মার্চ প্রথমবার জলদস্যুদের প্রতিনিধিরা জাহাজের মালিকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। এরপর দু’পক্ষের মধ্যে দেনদরবার চলতে থাকে, যার ইতি টানা হয় ১৪ এপ্রিল– নববর্ষে।

যেভাবে উৎকণ্ঠার সমাপ্তি
৩২ দিনের উৎকণ্ঠার পর নতুন বছরের প্রথম দিন সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি মিলেছে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ আর ২৩ বাংলাদেশি নাবিকের। জলদস্যুদের কবলে পড়ে গত ১২ মার্চ যে উৎকণ্ঠা শুরু হয়, মুক্তিপণ দিয়েই তার অবসান ঘটে। বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ও নাবিকদের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দেয় জলদস্যুরা। তার আগে ছোট্ট একটি উড়োজাহাজ বারবার চক্কর দিচ্ছিল জিম্মি থাকা এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চারপাশে। তখন ২৩ নাবিকের সবাই এলেন জাহাজের ডেকে। ২৩ জন অক্ষত ও নিরাপদে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর মালিকপক্ষ মুক্তিপণের টাকা দিতে সম্মতি দেয়। এরপর ছোট্ট সেই উড়োাজাহাজ তিনটি চক্কর দেয় জাহাজের একপাশে। প্রতিটি চক্করে পানি নিরোধক সাদা ট্যাপে মোড়ানো ডলার ভর্তি ব্যাগ ফেলা হয় ওপর থেকে। দুটি স্পিডবোটে থাকা সাতজন জলদস্যু এই তিনটি ব্যাগ সাগর থেকে তুলে নেয়। তারা ব্যাগ বুঝে পাওয়ার পর উডে়াজাহাজটি চলে যায়। এর প্রায় আট ঘণ্টা পর বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত ৩টায় জাহাজসহ ২৩ নাবিককে মুক্তি দেয় জলদস্যুরা। ডলারভর্তি ব্যাগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি কেএসআরএম গ্রুপের ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত। তিনি শুধু বলেন, ‘কোড অব কন্ডাক্ট’-এর কারণে আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’ মুক্তিপণের বিষয়টি কেউ স্বীকার না করলেও জাহাজটি এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ। সেখানে পণ্য খালাস শেষে নাবিকদের দেশে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হবে। শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘জাহাজে জলদস্যু ছিল ৬৫ জন। মধ্যরাতে ৯টি বোটে করে তারা চলে যায়। জাহাজটি এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে। সেখানে নোঙর করার পর নাবিকদের অপশন আছে ফ্লাইট কিংবা জাহাজে আসার। এমভি জাহান মণি ১০০ দিন ছিল। নাবিকদের তখন ভিসা সমস্যা ছিল। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে সেই সমস্যা নেই। তাই জাহাজটিকে দুবাই থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম নিয়ে আসব আমরা। নাবিকরা যে যেভাবে আসতে চান, সেভাবেই নিয়ে আসব। এটা তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে।’

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মোজাহেদুল ও নুর উদ্দিন
১৫ বছর ধরে জাহাজে চাকরি করছেন জেনারেল স্টুয়ার্ড মোহাম্মদ নুর উদ্দিন। কিন্তু এখন আর জাহাজে থাকতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। কত তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। ১৭ এপ্রিল সকালেও স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলেছেন। ফারদিন নূর নামে আড়াই বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে তাঁর। জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘শারীরিকভাবে কোনো অসুস্থতা নেই আমার স্বামীর। তবে মানসিকভাবে সে খুব বিপর্যস্ত। আমাকে বারবার বলছে তার কিছু ভালো লাগছে না। খাওয়াদাওয়াও ঠিকমতো করতে পারছে না। ফিরে এলে তাকে মানসিক ডাক্তার দেখাব।’ দেশে ফেরার পর নুর উদ্দিন দু-তিন মাস বিশ্রামে থাকবেন বলেও জানান তিনি। জান্নাতুল আরও বলেন, ‘শরীর সুস্থ থাকলে অনেক কিছু করা যাবে। কিন্তু মানসিকভাবে সে যদি সুস্থ না থাকে তাহলে তো বিকল্প ভাবতে হবে আমাদের।’

সমকালের সঙ্গে কথা হয় সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর মা ফেরদৌস আক্তারের। মোজাহেদুলও দুবাই থেকে বিমানে ফিরতে চান দেশে। ফেরদৌস আক্তার বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে এখন প্রতিদিনই কথা হয়। আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছে তারা। আমাদেরও দুশ্চিন্তা কমেছে। তবে টেনশন থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি এখনও। ছেলে বলেছে, তার মানসিক অবস্থা ভালো নেই। দ্রুত দেশে ফিরতে চায়। জাহাজে করে দেশে ফিরতে গেলে আরও ৭-৮ দিন লাগবে। তাই দুবাই থেকে বিমানে দেশে ফিরবে বলে জানিয়েছে সে। তবে কবে, কোথায়, কীভাবে আসবে– তা এখনও জানে না সে। এটা জাহাজের মালিকপক্ষ ঠিক করবে।’ 

আরও পড়ুন

×