ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

রাসেল’স ভাইপার নিয়ে যা হচ্ছে

রাসেল’স ভাইপার নিয়ে যা হচ্ছে

রাসেল’স ভাইপার

 আশিকুর রহমান সমী

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪ | ২৩:১৭ | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪ | ১৫:৫৯

সাপ উদ্ধারের সরঞ্জাম আর রেসকিউ দল নিয়ে রাত ১০টার দিকে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে চলেছেন অনন্যা। উদ্দেশ্য– সেখানে এক গৃহস্থের বাড়িতে রাসেল’স ভাইপার ঢুকে পড়েছে জানিয়ে ফোন দেওয়া হয়েছে। কৌতূহলী অনন্যার মন বলছে, এটা রাসেল’স ভাইপার হতেই পারে না; কারণ এ সাপ ঘরের ভেতরে ঢোকে না। পৌঁছানোর পর দেখতে পান অসংখ্য মানুষের ভিড় সেই বাড়িতে। হাতে লাঠি। কোনোরকম সাপটা বের করতে পারলেই তাকে মানুষের গৃহে প্রবেশের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। ঘরে ঢুকতেই ইঁদুরের দলের দিকে চোখ পড়ল অনন্যার। বুঝতে বাকি নেই কী কারণে এই গৃহে সাপ। মনে সংকল্প তাঁর– যে করেই হোক নিরাপদে উদ্ধার করতে হবে নির্বিষ সাপটিকে। সতর্কতার সঙ্গে ঘরের আলমারির নিচ থেকে উদ্ধার হয় ‘ঘরগিন্নি’ নামের সাপটি। অবমুক্ত করেন প্রকৃতিতে। সাপ কত হাজার হাজার টাকার সম্পদ ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করে, সে সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা নেই। উল্টো তাকে মারার জন্য এত আয়োজন।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রাণিবিদ ড. আলী রেজা খানের প্রকাশিত বই ‘ওয়াইল্ড লাইফ অব বাংলাদেশ’-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাপের জাত ১০৫টি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান এবং গবেষক আবু সাইদ প্রকাশিত বই ‘বাংলাদেশের সাপ ও সর্পদংশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাপের প্রজাতিগত সংখ্যা ১১৯টি।

রাসেল’স ভাইপার প্রসঙ্গ 
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বাস্তবের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে রাসেল’স ভাইপার। বাংলাদেশে এ সাপ চন্দ্রবোড়া নামে পরিচিত। বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে কোনো সাপ দেখলেই মানুষ মেরে ফেলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। মারা পড়ছে অনেক বিপন্ন প্রজাতির সাপ। অবিষধর সাপও বাদ যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, এটি নাকি আমাদের দেশে বাইরে থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। এ তথ্য পুরোপুরি ভিত্তিহীন। রাসেল’স ভাইপার প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে আছে এবং স্থানীয় প্রজাতির সাপ। ১৯২৯ সালে পি জে ব্যানার্জি প্রকাশিত ‘হ্যান্ডবুক অব স্নেকবাইট’ বইয়ে ২২টি রাসেল’স ভাইপার দংশনের কথা উঠে আসে যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী অঞ্চলের। এ ছাড়া বাংলাদেশে রাসেল’স ভাইপারের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ফনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ বইয়ের মাধ্যমে।

বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী বিদ্যার পথপ্রদর্শক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেনের ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বন্যপ্রাণী বিদ্যার বই ‘এন ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য ওয়াইল্ড লাইফ অব বাংলাদেশ’ বইয়ে উল্লেখ আছে এই রাসেল’স ভাইপারের নাম এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে বিশেষ করে রংপুরে এর বিস্তৃতির কথা বলা হয়। দেশের খ্যাতিমান গবেষকদের প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চল এবং পদ্মা অববাহিকার ওপরের অঞ্চল এ সাপের প্রধান আবাসস্থল। পদ্মা অববাহিকায় অবস্থানের কারণে বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, স্রোতসহ বিভিন্ন কারণে পদ্মা অববাহিকা সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে এই সাপ অন্য এলাকায় ছড়িয়েছে।

নামটি যেভাবে এলো
রাসেল’স ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার ভারী দেহ, ত্রিকোণা মাথা, তূলনামূলক ছোট লেজ। বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন পাঁচ ধরনের ভাইপারের মধ্যে রাসেল’স ভাইপার অন্যতম।
১৭৯৬ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের সাপ নিয়ে প্যাট্রিক রাসেল প্রকাশ করেন ‘এন অ্যাকাউন্ট অব ইন্ডিয়ান সার্পেন্ট’ বইটি। তিনিই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে ভারতের করোমানদেল উপকূল থেকে রাসেল’স ভাইপারের নমুনা সংগ্রহ করেন। এ তথ্য তিনি বইয়ে উল্লেখ করেন। তিনি সাপটির যথাযথ পরিচয় দিতে পারেননি। তবে সাপটি যে বিষধর এটি উল্লেখ করেন। এরপর ১৭৯৭ সালে জর্জ শ এবং তাঁর সহলেখকরা ‘কলোবার রাসেলি’ নামে সাপটির নামকরণ করেন প্যাট্রিক রাসেলের নাম অনুসারে। এরপর ১৮৬৪ সালে ‘দ্য রেপটাইলস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ বইয়ে এ সাপটির নাম পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ ভারত থেকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি।

যে কারণে বেড়েছে চন্দ্রবোড়ার সংখ্যা
সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রের ওপর ভিত্তি করে দাবি করা হয়েছে রাসেল’স ভাইপারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, ভারত থেকে বন্যার পানিতে আসছে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ইত্যাদি। পাশাপাশি কেউ কেউ দাবি করেছেন, এ সাপ নাকি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অথচ সম্প্রতি চন্দ্রবোড়ার সংখ্যা বাড়ার পেছনে রয়েছে অন্য কারণ। এই বাড়ার মূলে রয়েছে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্যপ্রাণী নিধন।

২০০০ সালে আইইউসিএন, বাংলাদেশ প্রকাশিত তথ্যমতে, বাংলাদেশে রাসেল’স ভাইপারের অবস্থা ছিল মহাবিপন্ন। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, এ সাপ হুমকির কাছাকাছি। তার মানে বাংলাদেশ থেকে কখনোই এই সাপ বিলুপ্ত হয়নি। অনেকে ধারণা করে থাকেন, খাদ্য এবং আবাসস্থলের সুবিধা এবং প্রকৃতি থেকে শিকারি প্রাণী কমে যাওয়ায় এদের বংশবৃদ্ধি সহজ হয়েছে। এ সাপ সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। রেপটাইলস ডেটাবেজের তথ্য অনুযায়ী, রাসেল’স ভাইপার শরীরের মধ্যেই ডিম নিষিক্ত করে এবং শরীরের মধ্যেই ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়ে পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা প্রসব করে। এরা গড়ে ৫০টি বাচ্চা উৎপাদন করে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যাটি আরও বেশি। তবে আগে প্রাকৃতিকভাবেই ওদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত থাকত। মাংসাশী প্রাণী যেমন– শিয়াল, বনবিড়াল, বেজি, মেছোবাঘ, গুইসাপ, শঙ্খিনী সাপ, কেউটে সাপ, বিভিন্ন শিকারি পাখি যেমন– তিলা নাগ ঈগল, বক, মদনটাক, কাস্তেচরা, পেঁচা এই সাপের বাচ্চা ও পূর্ণাঙ্গ সাপ খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখত। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমেই নষ্ট হয়েছে মানুষের হাতে। এর ফলে অনুকূল পরিবেশে বেড়েছে চন্দ্রবোড়ার সংখ্যা।

উপকারী প্রাণী
চন্দ্রবোড়া একটি উপকারী প্রাণী। এ সাপ পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাখছে অবদান অর্থনীতিতেও। বছরে ইঁদুরের আক্রমণে যে হাজার কোটি টাকার ফসল ক্ষতি হতো, তা রক্ষা পায় সাপের কারণে। সাপ ফসলের ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে ইঁদুর জাতীয় প্রাণী ও কীটপতঙ্গ খায়। যদি সঠিক হিসাব করা হয় তাহলে হয়তো দেখা যাবে গড়ে একটি সাপ তার সারাজীবনে কয়েক লাখ টাকার ফসল রক্ষা করে। 

অ্যান্টিভেনম নিয়ে গুজব
রাসেল’স ভাইপার আগ্রাসী প্রজাতির সাপ নয়। এটি ঝোপঝাড় কিংবা ফসলের ক্ষেতে চুপচাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকে। মানুষের উপস্থিতিতে জোরে হিস হিস শব্দ করে বা চলে যায়; মানুষ আক্রমণ না করলে বা নিজেকে আক্রান্ত মনে না করলে সে কখনোই আক্রমণ করে না। তবে অসাবধানতার কারণে, যেমন রাতে অন্ধকার হাঁটতে গিয়ে, ফসলের ক্ষেতে সাপের গায়ে পায়ের আঘাত পড়লে কামড় দেয়। তবে সর্পদংশনের পরপরই যদি দ্রুত, বিশেষ করে ১০০ মিনিটের মধ্যে হসপিটালে নিয়ে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয়, তাহলে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যথাযথ চিকিৎসা নিলে ৯০ শতাংশ রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। দেশের সব উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।

গুজব উঠেছে বাংলাদেশে কোনো অ্যান্টিভেনম নেই রাসেল’স ভাইপারের। বাস্তবতা হলো–আমাদের দেশে যে অ্যান্টিভেনমগুলো আছে, তা গোখরা, কেউটে, স-স্কেলড ভাইপার ও রাসেল’স ভাইপারের জন্য কার্যকর। তবে সবকিছু নির্ভর করবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়া এবং যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের ওপর। যত দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হবে, তত দ্রুত রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

বাংলাদেশে এখনও প্রত্যন্ত এলাকার অনেক মানুষ ওঝানির্ভর। ২০১৮-১৯ সালে উত্তরবঙ্গে সাপ নিয়ে মানুষের ধারণা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামানের নেতৃত্বে একটি গবেষণা চালানো হয়। ‘স্টুডেন্ট পারসেপশন অন স্নেইক ইন নর্থওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন সাপ ক্ষতিকর প্রাণী। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন সাপ মানুষকে আক্রমণ করে। ৯২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ এলাকায় সাপ মারতে দেখেছেন। ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেরাই সাপ মেরেছেন আর ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সাপ মারার মাধ্যমে আনন্দ পান। ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন সাপের মণি আছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীরা জানান, সাপুড়ের বিনের তালে সাপ নাচে। ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন সাপ দুধ খায়। অথচ প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, সাপ কোনো ধরনের তরল খাদ্য গ্রহণে অক্ষম। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন সাপ প্রতিশোধ নিতে পারে। গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘এশিয়ান জার্নাল অব এথনোবায়োলজি’ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। 

শৈশব থেকেই আমাদের দেশে মানুষের মধ্য থাকে সাপ নিয়ে কুসংস্কার বাসা বাঁধতে থাকে। একটা সময় গিয়ে তা মানুষ সাপ দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। তাই প্রয়োজন গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি। এ জন্য স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে তাদের শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। গ্রামীণ পর্যায়ে ওঝাদের সর্পদংশন প্রতিরোধে ট্রেনিং দেওয়া যেতে পারে। কারণ সঠিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সর্পদংশন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গ্রামীণ পর্যায়ে ওঝারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। বসতবাড়ি ইঁদুর ও পোকামাকড় মুক্ত রাখা খুবই জরুরি। এ জন্য বসতবাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে। পাশাপাশি মাংসাশী প্রাণী যেমন– বনবিড়াল, বেজি, শিয়াল, গুইসাপ সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে।

লেখক: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ ও গবেষক, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন

×